প্রত্যয় আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘ বিপুল ভোটে ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং ১৯৬৭ সালের পর থেকে ইসরাইলের ফিলিস্তিন দখলের অবসান ঘটানো অনুমোদন করে একটি প্রস্তাব পাস করেছে।
গত ২৬ নভেম্বর সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটি এই প্রস্তাবের অনুমোদন দিয়েছে। এই কমিটি কাজ করে থাকে মানবাধিকার ও মানবিক বিষয়াবলি নিয়ে। প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দেয় ১৬৩টি দেশ। বিপক্ষে পাঁচটি দেশ- যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, মাইক্রোনেশিয়া ও নাউরো। ভোট দানে বিরত ছিল ১০টি দেশ- অস্ট্রেলিয়া, ক্যামেরুন, গুয়েতেমালা, হন্ডুরাস, কিরিবাতি, পালাউ, পাপুয়া নিউগিনি, রুয়ান্ডা, টোগো ও টোঙ্গা।
এই প্রস্তাবে জোর তাগিদ রয়েছে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের অধিকারের প্রতি। জোর দেয়া হয়েছে অনতিবিলম্বে ইসরাইলি দখলের অবসান ঘটিয়ে ‘দুই-রাষ্ট্র’ কায়েমের মাধ্যমে ইসরাইলি বা উহুদি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে।
প্রস্তাবটি ফিলিস্তিনের পক্ষে পাস করা ২০টি প্রস্তাবের প্যাকেজেরই একটি অংশ, যা জতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে প্রতি বছর পাস করা হয়। এর দুই দিন পর সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে আরেকটি প্রস্তাব পাস করে সব মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের স্বীকৃতি জানিয়ে। ৭১টি দেশের সৌজন্য সমর্থন নিয়ে পাকিস্তান এ প্রস্তাব উত্থাপন করলে ১৯৩ সদস্যের এই পরিষদে তা পাস হয় কোনো ভোটাভুটি ছাড়াই, সর্বসম্মতিক্রমে। ১৯৮১ সাল থেকে পাকিস্তান এই প্রস্তাব স্পন্সর করে আসছে।
এতে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় কাশ্মির ও ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের সেই সব মানুষের প্রতি, যারা এখনো লড়ে চলেছে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এসব প্রস্তাব ও এই ভোটচিত্র নির্দেশ করে, বিশ্ববাসী কী চায়? এ ধরনের বিপুল বিশ্ব সমর্থন নিয়ে একের পর এক প্রস্তাব পাস হচ্ছে, কিন্তু এগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না কেন- সে প্রশ্ন বিশ্বের প্রতিটি শান্তিকামী মানুষের। এর অন্তর্নিহিত কারণ বহু।
আমরা অতীতে ফিলিস্তিন সম্পর্কিত প্রতিটি প্রস্তাবের বেলায় একই ধরনের ভোটচিত্র দেখেছি, জেনেছি ফিলিস্তিন সমস্যা প্রশ্নে বিশ্ববাসীর চাওয়া কী এবং এর প্রতি বিশ্বের মানুষের কী বিপুল মাত্রার সমর্থন রয়েছে। বিপুল সমর্থন নিয়ে পাস করা এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্ববাসীর এই প্রত্যাশার বিপরীতে কার্যক্ষেত্রে বারবার অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই অবস্থান থেকে সরে এসে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলে, বহু আগেই ফিলিস্তিনে ইসরাইলের দখলদারিত্বের অবসান ঘটত। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে দেখা যেতো ইসরাইল ও ফিলিস্তিন নামের দুই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে। যুক্তরাষ্ট্র কখনো নানা কূটচাল চালিয়ে ও কখনো ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগে ইসরাইলের প্রতি বারবার সমর্থন জানিয়ে এই ফিলিস্তিন সমস্যাকে জিইয়ে রেখেছে। সর্বশেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ইসরাইল পেয়েছে ‘অনন্য প্রাণসখা’ হিসেবে। ট্রাম্প প্রশাসন যেমনি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন বহুল আলোচিত দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানসূত্র, তেমনি ইসরাইলকে সক্রিয় সহযোগিতা দিয়েছেন জেরুসালেমকে এককভাবে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুসালেমে স্থানান্তর করে, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি বসতি আরো সম্প্রসারণে প্ররোচিত করে। সেই সাথে সবশেষে তিনি উপস্থাপন করেছেন আরো ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ইসরাইলের গিলে খাওয়ার লক্ষ্যে প্রণীত ’ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’। এই চুক্তি ঘোষণা দিয়ে তিনি সাথে সাথে এও ঘোষণা করেছেন, এটি হচ্ছে ফিলিস্তিনের জন্য শেষ সুযোগ, তাই তো বলা হচ্ছে- ট্রাম্প হচ্ছেন ইসরাইলের অকৃত্রিম প্রাণসখা।
এর সত্যতা মিলে ইসরাইলের সাম্প্রতিক সময়ের অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনে ক্ষিপ্রতায়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও লিকুদ পার্টির সদস্য মিকি জোহার খ্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর পত্রিকাকে বলেছেন, ‘এই দিনগুলো’ হচ্ছে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলের ভূখণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অপ্রতিস্থাপনীয় সুযোগ। তিনি আরো বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, আমাদের বন্ধু পেসিডেন্ট ট্রাম্প ও প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এই সুযোগটা নেবেন।’ সহজেই অনুমেয়, মিকি জোহার ‘এই দিনগুলো’ বলতে ট্রাম্প প্রশাসনের অবশিষ্ট কয়েক সপ্তাহের কথাই বলেছেন। ট্রাম্পের পরাজয় ইতোমেধ্যেই ইসরাইলিদের মধ্যে এক ধরনের ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাপারটি ইসরাইলি নেসেটেও আলোচিত হয়েছে। তাদের ধারণা- নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরাইলের অব্যাহত ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ নীতির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারেন। এ কথা অনস্বীকার্য, ট্রাম্প তার আমলে ইসরাইলকে পুরনো ও নতুন ইহুদি বসতি সম্প্রসারণে সক্রিয় সহযোগিতা দিয়েছেন। এমন কথাও চালু আছে- ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইসরাইলকে এই কাজটি জরুরি ভিত্তিতে করতে উৎসাহিত করেছেন। সে জন্যই হয়তো ট্রাম্প প্রশাসনের শেষ সময়ে ইসরাইল এই সম্প্রসারণ কর্মকাণ্ড আরো গতিশীল করে তুলেছে।
এদিকে খবর আসছে- ইসরাইলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছে বেলজিয়াম। পশ্চিম তীরের অধিকৃত ফিলিস্তিন এলাকায় বেলজিয়ামের অর্থায়নে বেশ কিছু বাড়িঘর ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছিল। ইসরাইল সেগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। গত ৬ নভেম্বর বেলজিয়াম সরকার এই ধ্বংসের নিন্দা জানিয়েছে। এই অবাঞ্ছিত ধ্বংসযজ্ঞের জন্য বেলজিয়াম সরকার ক্ষতিপূরণ চায়। ইসরাইল দ্রুত তাতে ‘না’ বলে দেয়। এরপর দুর্বল কূটনৈতিক ফিসফিসানি হয়তো চলবে, কিন্তু ইসরাইল পশ্চিম তীরের এসব বাড়িঘর বা অবকাঠামো ভাঙা থামাবে না। বেলজিয়াম বা অন্য কোনো ইইউ দেশ ক্ষতিপূরণও পাবে না।
আমরা লক্ষ করেছি- অন্যান্য দেশসহ ইইউ দেশগুলোর অদ্ভুত বিদেশ-নীতি রয়েছে ফিলিস্তিন প্রশ্নে, যা এক ধরনের দ্বিচারিতা। এখনো ‘দুই-রাষ্ট্র’ভিত্তিক সমাধানের ক্ষেত্রে ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন। ইইউ প্রায় চার দশক ধরে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়ে তোলার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তহবিল জুগিয়েছে ফিলিস্তিনি অবকাঠামোতে। এটি সবার জানা, ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে চলায় ওস্তাদ। দেশটি মানে না দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এবং সাড়া দেয় না- ফিলিস্তিনে সামরিক দখলদারিত্ব অবসানে যেকোনো ধরনের বাহ্যিক চাপের প্রতি। ইসরাইল তার পরিকল্পিত অবস্থানে পৌঁছার জন্য সক্রিয়ভাবে নিয়মিত ধ্বংস করে চলেছে ইইউ অর্থায়নে নির্মিত প্রকল্পগুলো। কারণ, ইসরাইলের লক্ষ্য ইউরোপিয়ানদের এই বার্তাটি দেয়া- ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র অর্জনে তাদের সমর্থন দেয়ার বিষয়টি ইসরাইল প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করে। ‘ইউরো-মেড মনিটর’-এর দেয়া তথ্য মতে- ইসরাইল শুধু ২০১৯ সালেই ২০৪টি ফিলিস্তিনি অবকাঠামো ধ্বংস করেছে দখল করা পূর্ব জেরুসালেমে। পশ্চিম তীরের ‘সি’ এলাকায় অনেক বাড়িঘর ও অবকাঠামো ধ্বংস করেছে ইসরাইল।