দৈনিক প্রত্যয় ডেস্কঃ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রকোপে আজ বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। ইতোমধ্যে এই ভাইরাসের বিষাক্ত ছোবলে দিশেহারা বিশ্বের ২১৩টি দেশটি ও অঞ্চল। এসব দেশে এখন পর্যন্ত (শনিবার বেলা পৌনে ১১টা) আক্রান্ত হয়েছে ৪৬ লাখ ২৮ হাজার ৫৫৫ জন। মৃত্যু হয়েছে ৩ লাখ ৮ হাজার ৬৫৪ জনের।
মহামারী করোনাভাইরাস শুধু মানুষের শরীরে নয়, আমূল পরিবর্তন এনেছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও। এই মুহূর্তে ঘর থেকে বের হলেই মাস্ক আমাদের সঙ্গী। সেই সঙ্গে যতটুকু সম্ভব আমরা সবাই চেষ্টা করছি শারীরিক দূরত্ব মেনে চলতে।
বারে বারে হাত ধুচ্ছি। হাতে মাখছি হ্যান্ড স্যানিটাইজার। এছাড়াও লকডাউনে অনলাইনের উপর নির্ভরতা বেড়েছে।
করোনাভাইরাস আঘাত হানার আগে পাবলিক প্লেসে এমন অনেক জিনিস ব্যবহারে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম, যেগুলো আর পরবর্তীতে থাকবে না। লকডাউন একবার উঠে গেলেই করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে উঠে যাবে সেগুলোও। একনজরে দেখে নেওয়া যাক সেই জিনিসগুলো কী?
লিফটের বোতাম
লিফটের বোতাম আমরা ব্যবহার করি অফিসে, শপিং মলে আরও অন্যান্য জায়গায়। আর সেই বোতামে আরও বহু মানুষই হাত দিয়ে থাকে সারাদিনে। নিউইয়র্কের একটি আর্কিটেকচার ফার্মের সদস্য মাইকেল সাইরাকিউজের মতে, ‘এলিভেটরের বোতাম এরপর থেকে আর দেখা যাবে না। কারণ এর থেকে সংক্রমণের আশঙ্কা অনেক বেশি।’
সাইরাকিউজ আরও বলছেন, ‘এলিভেটর বা লিফট ব্যবহার করতে বোতামের জায়গায় অন্য কোনও সুবিধা থাকবে। যেমন ফোনের সেন্সর কাজে লাগিয়ে, বিল্ডিং পাস, ফেস রেকগনিশন সিস্টেম বা আপনার গলার স্বর ব্যবহৃত হতে পারে।’
পাবলিক বিল্ডিংয়ে দরজার হাতল
দরজার হাতল বা ফ্রিজ-আলমারির হাতল এই কোভিড সংক্রমণকালে ভয়ঙ্কর তা নিশ্চয়ই জানেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এবার থেকে হাসপাতাল বা অফিসের বিল্ডিংয়ের দরজায় আর হাতল থাকবে না। আর যদি হাতল থাকেও, তা ব্যবহার করা যাবে না। তাহলে কী ‘খুল যা সিম সিম’ বললেই দরজা খুলবে? বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, মোশন অপারেটেড দরজা বা গতি নির্ভর দরজাই আপাতত ভবিষ্যত। অর্থাৎ যে দরজা কনুই দিয়ে ঠেললেই খুলে যাবে। যদিও অনেকেই মনে করছেন, অফিস বা হাসপাতালগুলো এরপর থেকে স্বয়ংক্রিয় দরজার ব্যবস্থা রাখতে পারে।
ক্যাশ রেজিস্টার
ডিজিটাল যুগেও দোকানপাটে বা শপিং মলে কেনাকাটা করতে গিয়ে কার্ডের থেকেও বেশি পরিমাণে নগদ টাকাই দিয়ে থাকেন বহু মানুষ। আর বহু সংখ্যক মানুষের হাত থেকে নগদ টাকা নেওয়াটাও যে এই সংকটকালে একটা ঝুঁকির বিষয় তা বোধ হয় আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই শপিং মল থেকে আরও অন্যত্র এবার ক্যাশ বা নগদ টাকা নেওয়ার ব্যবস্থা চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই বিষয়ে গবেষক মাইকেল সাইরাকিউজের বক্তব্য, ‘ক্রেডিট কার্ড বা ডেবিট কার্ড এবং টাচ-ফ্রি ইলেকট্রনিক পেমেন্টের দিকেই এগোবে সব প্রতিষ্ঠান।’
স্টাইলাস পেন
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যে কোনও ট্রানজেকশনের পর সচরাচর আমাদের সই করতে হয়। অনলাইন অর্ডার, এমনকি ক্যুরিয়ার এলেও স্বাক্ষর করতে হয়। আর সেই স্বাক্ষরের জন্য একটি বিশেষ কলম ব্যবহার করা হয়। সেই স্টাইলাস কলম বহু মানুষ ব্যবহার করে থাকেনম যা এই মুহূর্তে ব্যবহার করা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। গবেষক সাইরাকিউজ বলছেন, ‘এরপর থেকে এই স্টাইলাস পেন বা কলমের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবে। আর সেই জায়গায় ব্যবহৃত হতে পারে ইলেকট্রনিক অথেনটিকেশন। ফেস অথবা ভয়েস রেকগনাইজ করার জন্য বিশেষ সফ্টওয়্যারও ব্যবহৃত হতে পারে।’
সোয়াইপ কার্ড মেশিন
নগদের থেকে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করলে সংক্রমণের ভয় থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকা যায়-তা আমাদের জানা। কিন্তু সেই কার্ড সোয়াইপ করার মেশিনটি নিয়েও ভয়ের কারণ রয়েছে। আর্কিটেক্ট কলিন হায়েনজেন্টসের কথায়, ‘একটা কার্ড সোয়াইপ করার মেশিনে সারাদিনে বহু মানুষ হাত দিচ্ছেন। তাই কোভিড পরবর্তী সময়ে এই মেশিন আর ব্যবহৃত হবে না বলেই মনে হচ্ছে।’ তাহলে উপায়? বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা, এর পরে কন্ট্যাক্টলেস কার্ড বা ট্যাপ-এনাবেলড কার্ড রিডারের ব্যবহারই বাড়বে। এই পদ্ধতিতে আপনার কার্ড একটি কোডিংয়ের মারফত ট্রানজাকশন সম্পন্ন করে।
ম্যানুয়াল স্যুইচ
লাইট হোক বা ফ্যান অগুনতি মানুষ বহু বার ব্যবহার করে থাকেন সেই স্যুইচ। যা আদতে ব্যাকটিরিয়া এবং ভাইরাসের আখড়া। এমনকী ২০১২ সালে আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবাইলোজির পক্ষে গবেষণা করে দেখা গিয়েছিল যে, ৯টি হোটেল রুমের লাইটের স্যুইচে সব থেকে বেশি পরিমাণে ভাইরাসের উপস্থিতি। আর্কিটেক্ট গাই গেইয়ারের কথায়, ‘এই ঝুঁকি এড়াতে ম্যানুয়াল স্যুইচ বন্ধ করে দেওয়াই উচিত। সেই জায়গায় ভয়েস বা গতিকে কাজে লাগিয়ে স্যুইচ অন করার চিন্তাভাবনা করতে হবে।’
এটিএমের বোতাম
ভবিষ্যতে ক্যাশলেস ট্রানজাকশনের দিকেই এগোচ্ছে গোটা দুনিয়া। কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে আমাদের নগদ টাকার প্রয়োজন পড়তেই পারে। আর সে ক্ষেত্রে আমাদের ভরসা এটিএম। তবে এই এটিএমের বোতাম নিয়ে সংক্রমণের একটা ভয় থেকেই যায়। কারণ প্রতিনিয়ত সেই বোতাম টিপে চলেছেন বহু মানুষ। আর্কিটেক্ট গাই গেইয়ারও এই বিষয়টি নিয়ে যথেষ্টই সন্দিহান। তার বক্তব্য, ‘বোতাম প্রেস করে টাকা তোলার ব্যবস্থা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত। সেই জায়গায় ভয়েস অ্যাক্টিভেটেড এটিএম আসবে। অর্থাৎ আপনার গলার স্বরের মাধ্যমেই টাকা তুলতে পারবেন আপনি।’
সেলফ সার্ভিস পেট্রল পাম্প
বিদেশের বহু জায়গাতেই সেলফ সার্ভিস পেট্রল পাম্পের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে মনে করা হচ্ছে, আবার সেই আগের মতোই ফুল সার্ভিস পেট্রল বা গ্যাস পাম্পের ব্যবস্থা ফিরে আসবে। অর্থাৎ পেট্রল পাম্পের কোনও কর্মীই আপনার গাড়িতে পেট্রল ভরে দেবেন না। নিউজার্সি-তে ইতিমধ্যেই পুরনো সেই ব্যবস্থা ফিরেও এসেছে। আর্কিটেক্ট গাই গেইয়ারও সেই কথাই বলছেন।
কফি মেশিন
অফিসে বা অনেক জায়গাতেই আমাদের সঙ্গে থাকে কফি মেশিন। সেই মেশিনের বোতাম টিপলেই বেরিয়ে আসে কফি। কিন্তু করোনার এই সংক্রমণকালে কফি মেশিন ব্যবহার করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ওই এক কফি মেশিন বহু মানুষ ব্যবহার করে থাকেন। বোতামেও হাত যায় তাদের। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যে ভাবে একদম ঘরোয়া উপায়ে চা-কফি আমরা বাড়িতে বানিয়ে থাকি, সেই ভাবেই আবার অফিস বা হাসপাতালে এবং নানান জায়গায় যেখানে কফি মেশিন ব্যবহৃত হয়, সেখানে চা-কফি বানানো হবে।
বোতাম টিপে সাবান পানি
অফিস, শপিং মল, নার্সিংহোম এবং অন্যান্য বেশ কিছু জায়গায় আমরা বাথরুমে একটি বিশেষ বোতাম টিপলেই সাবান পানি পেয়ে যাই। করোনার কালবেলায় যা অত্যন্ত রিস্কের বিষয়। কারণ বহু নোংরা হাত ওই বোতাম টিপে সাবান নিচ্ছে। তাহলে উপায়? ক্লিনিকাল রিসার্চার এবং মেডিক্যাল অ্যাডভাইজার উর্বিশ কে প্যাটেল বলছেন, ‘এবার সেন্সর এমবেডেড হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং লিকুইড সাবান সব জায়গায় চলে আসবে।’
ডিপিআর/ জাহিরুল মিলন