আন্তর্জাতিক ডেস্কঃকরোনাভাইরাস মহামারি সমস্যার জরুরি সমাধান বের করার অর্থ বিজ্ঞানীদের ঝুঁকি এবং শর্টকাট নিতে হতে পারে। এখনো অনেক আকাঙ্ক্ষার সেই টিকা ধরাছোঁয়ার বাইরে। লাখো মানুষের ভবিষ্যত যে কোভিড -১৯-এর একটি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ওপর নির্ভর করছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যা এই মহামারি থেকে সুরক্ষার একমাত্র নিশ্চিত পথ।
এই সপ্তাহে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিন নিয়ে পরীক্ষার বিষয়টি আশাবাদ প্রসঙ্গে রাখতে হবে এবং বিজ্ঞানীরা যেসব বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন তাও বোঝা প্রয়োজন। যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
ভ্যাকসিন শিকারীরা ক্ষুদ্র অদৃশ্য এক শত্রুকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, যা কোষের অভ্যন্তরে জৈবিক নৈপুণ্য দেখিয়ে মানুষের জীবনকে থামিয়ে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভ্যাকসিন বা টিকা মূলত আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রশিক্ষণ দেয়। প্রচলিত টিকাগুলো মূলত ভাইরাসটির একটি দুর্বল সংস্করণ তৈরি করে কাজ করে। এর কাজ হচ্ছে, শরীরে ওই বিশেষ ভাইরাসপ্রতিরোধী সক্ষমতা গড়ে তোলা, যাতে তারা সংক্রমণ এড়াতে পারে।
এ পদ্ধতিতে অনেক ভ্যাকসিন তৈরি করা হলেও এখন এটি মৌলিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, সদ্য বিকাশযুক্ত ভাইরাস আশানুরূপ নিরীহ না হতেও পারে।এ জন্য ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সতর্কতার সঙ্গে ও ধীরে ধীরে চালাতে হবে। এ রোগের ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর চিকিৎসা নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মহামারির সময় ধীর গতির পদ্ধতিতে এগোনোর সুযোগ কম।
সুতরাং এটি সম্ভবত অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয় যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার রাডারে যে ৭৬ টি ভ্যাকসিন পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে কেবল দুটিই এই প্রচলিত পদ্ধতির পক্ষে গেছে। বাকিগুলো দ্রুতগতির পরীক্ষা পদ্ধতিতে গেছে. যেখানে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পক্ষে পুরো ভাইরাসকে দেখে এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অস্ত্র প্রস্তুতের প্রয়োজন পড়ে না। এর বদেলে কোভিড-১৯ এর স্পাইক প্রোটিন দেখেই ব্যবস্থা নিতে পারে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অগ্রগতি এই প্রতিরক্ষা বিকাশে বিজ্ঞানীদের সৃজনশীলতার সুযোগ করে দিয়েছে।
গত জানুয়ারি মাসে স্পাইক প্রোটিনের জেনেটিক সিকোয়েন্স জানার পর থেকেই ভ্যাকসিন তৈরির জন্য বিশ্বের অনেক গবেষক দল দ্রুতগতিতে কাজ করে চলেছেন।তবে এসব প্রযুক্তির অধিকাংশই অপ্রমাণিত এবং যেকোনও পরীক্ষার সাফল্যের নিশ্চয়তা দিতে পারে না।চলতি সপ্তাহে রেমডেসিভির ওষুধের ক্ষেত্রে ঠিক এটাই ঘটতে দেখা গেল। এসব পরীক্ষায় অংশ নেওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নৈতিকতার প্রশ্ন উঠতে পারে। এর চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, টিকা পাওয়া গেলে তা সবার আগে কারা তা পাবে।
করোনাভাইরাসের টিকা তৈরিতে দ্রুত কাজ এগিয়ে চলেছে। কোভিড -১৯ এর জেনেটিক সিকোয়েন্স জানুয়ারীতে প্রকাশিত হওয়ার ঠিক আট সপ্তাহ পর মার্কিন বায়োটেক সংস্থা মর্ডানা আরএনএ ভ্যাকসিনের প্রথম ক্লিনিকাল পরীক্ষা চালায়। চলতি সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন আরএনএ ভ্যাকসিন পরীক্ষার জন্য সরকারের কাছ থেকে ২ কোটি ২৫ লাখ পাউন্ড তহবিল পেয়েছে। তারা এমন এক পদ্ধতিতে এ ভ্যাকসিন তৈরি করতে যাচ্ছে, যা আগে পরীক্ষিত নয়।ইম্পেরিয়াল টিমের গবেষক রবিন সাটক বলেন, কয়েকটি গবেষক দল প্রাণীর ওপর পরীক্ষার ধাপটি বাদ দিয়েছে কারণ তাদের প্রযুক্তি মানুষের ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য তৈরি করা।
এর বাইরে চীনা ভ্যাকসিন কোম্পানি ক্যানসিনো বায়োলজিকস তাদের টিকা মানবদেহে প্রয়োগ করে পরীক্ষা চালাচ্ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সারাহ গিলবার্টের নেতৃত্বেও ভ্যাকসিন নিয়ে পরীক্ষা চলছে। এ দুটি ক্ষেত্রেই গবেষকেরা নিরীহ ভাইরাস ব্যবহার করে ভ্যাকসিনের টিকা তৈরির চেষ্টা করছেন।এর আগে তাদের উদ্ভাবিত পদ্ধতি ইবোলার মতো ভাইরাসের ক্ষেত্রে পরীক্ষা করা হয়েছে।
আরেক ধরনের পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ইনোভিও নামের একটি প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার ছোট বায়োটেক কোম্পানি ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যাল করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য একটি ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকদের কাছ থেকে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার অনুমোদন পাওয়ার পর সুস্থ স্বেচ্ছাসেবকদের শরীরে এ ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করছে প্রতিষ্ঠানটি। ইনোভিও তাদের ভ্যাকসিন তৈরির প্রচেষ্টায় বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ও কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনসের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছে। তারা ভ্যাকসিন তৈরিতে ডিএনএ ব্যবহার করে যাতে কোষে স্পাইক তৈরিতে বিশেষ নির্দেশনা পাঠানো হয়। এ প্রক্রিয়ায় শত্রু স্পাইক প্রোটিন বের করে দেওয়া হয়।
ইনোভিওর প্রধান নির্বাহী জোসেফ কিম বলেন, ‘এটি সত্যি যে এখন বাজারে কোনো প্রমাণিত আরএনএ বা ডিএনএ ভ্যাকসিন নেই। তবে এটা কেবল সময়ের অপেক্ষা মাত্র।’
আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে, প্রচুর স্পাইক প্রোটিন তৈরি করে তা সরাসরি ইনজেকশনের মাধ্যমে পুশ করার কৌশল। ওষুধ প্রস্তুতকারক দুই জায়ান্ট কোম্পানি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন (জিএসকে) ও সানোফি এ নিয়ে কাজ করছে। সানোফি ২০০০ সালে তৈরি সার্সের জন্য তৈরি একটি ভ্যাকসিনের পুনব্যবহার ও জিএসকে অ্যাডজুভান্ট নামের উপাদান সরবরাহ করছে।
আটটি ভ্যাকসিনের জন্য অর্থায়ন করা কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস (সিইপিআই) এর প্রধান নির্বাহী রিচার্ড হ্যাচেট বলেন, ‘এসব পদ্ধতির মধ্যে কোনটি বেশি প্রতিশ্রুতিশীল, তা এখনই বলা যায় না। অনেক ভ্যাকসিন দ্রুত পরীক্ষার জন্য চলে আসছে, আবার অনেকগুলো দারুণ প্রতিশ্রুতিশঅণ হিসেবে উঠে আসার অপেক্ষায়।আমরা যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি, তা হলো দ্রুত ভ্যাকসিন তৈরির চাপ।’
এত টিকার মধ্যে কিছু আগেই প্রাণীদেহে পরীক্ষায় বাদ পড়বে। কিছু টকিা পরীক্ষার প্রথম ধাপে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে বাদ যাবে।আবার কোনো টিকা কাজ করবে না—এমন আশঙ্কাও আছে। হার্ভার্ডের এপিডেমিওলজির অধ্যাপক মার্কাস লিপসিচের মতে, ‘যুক্তিসঙ্গত অনুমান হলো প্রায় এক বছরের মধ্যে আংশিক সুরক্ষা থাকতে পারে। তবে ভালো সুরক্ষার জন্যে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে ।এ মুহূর্তে এটা পুরোটাই অনুমাননির্ভর।’
এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক দিক হচ্ছে, কোভিড-১৯ জেনেটিকভাবে স্থিতিশীল। এর স্পাইক প্রোটিন পরিবর্তিত হয়নি। সাধারণ ফ্লুর ক্ষেত্রে এর জিন দ্রুত বদলে যায় বলে প্রতিবছর নতুন ভ্যাকসিন লাগে।
আশার কথা হচ্ছে, লকডাউন ও অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়ায় মহামারিটি নিয়ন্ত্রণে থাকায় অনেক পরীক্ষা থেমে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। পোর্টন ডাউনের পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল ইনফেকশন সার্ভিসের গবেষণা প্রধান মাইলস ক্যারল বলেন, ভ্যাকসিনের প্রতিরক্ষামূলক ক্ষমতা দেখানোর জন্য কতজনকে ভ্যাকসিন দিচ্ছেন তার একটি নির্দিষ্ট হিট রেট দরকার।
গার্ডিয়ান জানিয়েছে, সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ এক বা একাধিক টিকা পাওয়ার আশা করা যাচ্ছে, যা কার্যকর ও নিরাপদ হতে পারে। তবে টিকা হিসেবে লাইসেন্স পাওয়ার জন্য এটি পর্যাপ্ত নয়। তবে জরুরি প্রয়োজনে সরকার এসব টিকা ব্যবহারের কথা আলোচনা করছে।
দৈনিক প্রত্যয়/ জাহিরুল মিলন