নিজস্ব প্রতিবেদকঃ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে প্রায়ই বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। বস্তির আগুনের রহস্যজট যেনো খুলতে চায় না কখনোই। এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনগুলোও আলোর মুখ দেখে না।
বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে বাববার পুড়ে ছাই হচ্ছে দরিদ্র অসহায় মানুষের সংসার, ভস্মীভূত হচ্ছে তাদের সুখের স্বপ্ন। কিন্তু বস্তিতে বারবার সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত হলেও বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় না। ফলে বিষয়টি অনেকের কাছে একটি রহস্যজনক বিষয় হিসেবেই থেকে যায়।
গত রবিবার (২২ নভেম্বর) দুপুরে বনানীর কড়াইল বিটিসিএল কলোনিতে অগ্নিকান্ডে পুড়েছে বেশ কিছু ঘর। এর পরের দিন সোমবার (২৩ নভেম্বর) রাতে মহাখালীর সাততলা বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে পুুড়ে গেছে দেড় শতাধিক ঘর ও দোকান। এর কয়েক ঘণ্টা পর মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) বিকালে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের (বিহারিপল্লী) জহুরি মহল্লার বস্তিতে আগুনে পুড়ে গেছে শতাধিক ঘরবাড়ি। এ বছর ১১ মার্চ রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরের ট-ব্লকের একটি বস্তিতে আগুন লেগে শত শত ঘর পুড়ে যায়। ৮ ফেব্রুয়ারি মহাখালী টিএন্ডটি মাঠের পাশে (বনানী ১ নম্বর রোড সংলগ্ন) বেদে বস্তিতে আগুনে পুড়ে ছাই হয় প্রায় তিন শতাধিক ঘর। এই অগ্নিকাণ্ডের পর খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই নেয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। এর আগে ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ভাসানটেকের আবুলের বস্তি ও জাহাঙ্গীরের বস্তির প্রায় ১ হাজার ঘর। ২০১৯ সালের ১৭ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর এলাকায় চলন্তিকা বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে কয়েকশ ঘর পুড়ে যায়।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে রাজধানীসহ সারা দেশে ২৮টি বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় শিশু-নারীসহ মারা গেছে ১৮ জন। ২০১৮ সালে সারা দেশে ১৬৫টি বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে শুধু ঢাকায়ই ৩৩ বার বস্তিতে আগুন লাগে।
রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বনানীর কড়াইল বস্তিতে। গত ১০ বছরে এই বস্তি আগুনে পুড়েছে ১৭ বার। এসব আগুন স্বাভাবিক কারণে লেগেছে এমনটি মনে করে না বস্তিবাসীরা। তাদের অভিযোগ, এসব আগুন তাদের উচ্ছেদের লক্ষ্যে নাশকতা। ২০১৮ সালের ১১ মার্চ ভোরে রাজধানীর পল্লবীর বস্তিতে ভয়াবহ আগুনের ঘটনাও নাশকতার অংশ বলে অভিযোগ করে ওই বস্তির বাসিন্দারা।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বস্তিগুলোকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি ও নানা ধরনের বাণিজ্য চলে আসছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ও গ্যাস-বিদ্যুৎ-ওয়াসাসহ সেবা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। এসব বস্তি ঘিরে মাদকদ্রব্যের বাজারও গড়ে উঠেছে। যেহেতু বস্তিগুলোর অধিকাংশই সরকারি খাসজমির ওপর গড়ে উঠেছে, তাই স্থানীয় প্রভাবশালীরা এই জমি দখলের ব্যাপারে সবসময় তৎপর থাকে। এ কারণে ভূমি দখল, আধিপত্য বিস্তার, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও নাশকতা সৃষ্টিসহ বস্তি দখল করতে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
বস্তিতে বারবার আগুন লাগার নেপথ্যে বস্তিবাসীরা নাশকতা, দখলবাজি, উচ্ছেদের কৌশলকে দায়ী করলেও ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত প্রতিবেদন বেশিরভাগ সময়ই আলোর মুখ দেখেনি। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে প্রায়ই বলা হয়, ‘নানা কারণেই বস্তিতে আগুন লাগে। তাদের তদন্তে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট ও গ্যাসের পাইপের লিক থেকে আগুনের কারণ উঠে এসেছে। তবে আগুন যে লাগানো হয়, তাও অমূলক নয়। বস্তিতে আগুন লাগার পেছনে কোনো মহলের প্রভাব তো থাকেই।’
আমরাও মনে করি, দুর্ঘটনার কারণে বস্তিতে বারবার আগুন লাগে না। বরং ক্ষেত্রবিশেষ উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে আগুন দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই এসব অগ্নিকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত জরুরি। কেননা যেকোনো মানুষের বসতবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধ। ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে এসব অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিচার এবং শাস্তি দিতে হবে। সেই সঙ্গে বস্তিবাসীদের উন্নয়নে সরকার যেসব প্রকল্প হাতে নিয়েছে সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি।