বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:
করোনা সময়ে প্রতিটি দিনই সকালে আশঙ্কায় ঘুম ভাঙে বাঙালির। তবু বাংলা–তথা ভারতে করোনা সংক্রমণের অধোগতিতে একটু অন্য রকম স্বপ্ন এবং আশায় বাঁচতে চাইছেন সকলে। তবু বৃহস্পতিবার সকালটা মোটেই সুখবর দেয়নি বাঙালিকে। সাতসকালেই বিদ্যুৎ চমকের মতো ছড়িয়ে পড়ে একটি খারাপ খবর। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নেই। সকলেই চমকে ওঠেন তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে। তার পরই আসতে থাকে একের পর এক শোক বার্তা। গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী প্রমুখ। শোকাহত বাংলার পরিচালক থেকে শিল্পী মহলও।
এদিন দক্ষিণ কলকাতায় নিজের বাড়িতেই প্রয়াত হন এই স্বনামধন্য পরিচালক। বয়স হয়েছিল ৭৭। সকালে তাঁকে ডাকতে তাঁর ঘরে গিয়েছিলেন স্ত্রী সোহিনী দাশগুপ্ত। কিন্তু দেখেন, সাড়া মিলছে না তাঁর। শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। শরীরে প্রাণ নেই। ঘুমের মধ্যেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। চিকিৎসক আসেন। তাঁকে দেখে মৃত বলে ঘোষণা করেন। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন বুদ্ধদেববাবু। কিডনির সমস্যাও ছিল। ডায়ালিসিস চলছিল। এদিনও তাঁর ডায়ালিসিস হওয়ার কথা ছিল। তাঁর দুই মেয়েই মুম্বইয়ে থাকেন। করোনা বিধিনিষেধের কারণে তাঁরা কলকাতায় আসতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বলেছেন, ‘নিজের সিনেমা ও কবিতার মাধ্যমে আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতিকে উর্বর করেছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তাঁর প্রয়াণে আমরা একজন অতুলনীয় শিল্পীকে হারালাম। তাঁর পরিবারকে আমার সমবেদনা জানাই।’ ট্যুইট করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি লিখেছেন, ‘শ্রীবুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মৃত্যুতে আমি গভীর শোকাহত। তাঁর সৃষ্টি সমাজের সব শ্রেণির মানুষের কথা বলত। এক প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী এবং কবিও ছিলেন তিনি। তাঁর পরিবার এবং অগুনতি গুণগ্রাহীর প্রতি আমার সমবেদনা জানাই। ওম শান্তি।’
শোক প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। শোক বার্তায় তিনি লিখেছেন, ‘ভারতের সুযোগ্য সন্তান বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রয়াণে আমি গভীর শোকাহত। তাঁর সিনেমা পরিচালনার কথা চিরকাল মনে রাখবে ভারতবাসী।’শোক প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইটে লিখেছেন, ‘বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রয়াণে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি।’ রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী লিখেছেন, ‘প্রয়াত প্রখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। সাহিত্য জগতেও তিনি সমান প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি এবং তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই।’ তাঁর প্রয়াণকে বাংলার নক্ষত্রপতনই বলা যায়। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন বুদ্ধদেব। ১৯৪৪ সালে পুরুলিয়ার আরায় জন্ম। হয়তো তাই বারবার পুরুলিয়া ফিরে এসেছে তাঁর সৃষ্টিতে। বাবা ছিলেন রেলের চিকিৎসক। বদলির চাকরি। তাই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছেলেবেলা কেটেছে। অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল। কিন্তু কিন্তু অর্থনীতির তত্ত্ব আর বাস্তব জীবনের দূরত্বই তাঁকে অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য করে।
সিনেমার প্রতি প্রেম তাঁকে নিয়ে আসে ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনার জগতে এবং পরিচালনায়। কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে তৈরি করেন একটি তথ্যচিত্র। আর তার মাধ্যমেই আত্মপ্রকাশ ঘটে সিনেমা জগতে। ১০ মিনিটের ‘দ্য কনটেন্ট অব লভ’ তথ্যচিত্রটিই তাঁকে অন্যরকম সিনেমা পরিচালনার দিকে নিয়ে যায়। ১৯৭৮ সালে প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি ‘দূরত্ব’ পরিচালনা করে জাতীয় পুরস্কারের শিরোপা পান। তাঁর পরিচালিত সিনেমাগুলি হল সময়ের কাছে, দূরত্ব, নিম অন্নপূর্ণা, গৃহযুদ্ধ, আন্ধি গলি, ফেরা, বাঘ বাহাদুর, তাহাদের কথা, চরাচর, লাল দরজা, উত্তরা, মন্দ মেয়ের উপাখ্যান, স্বপ্নের দিন, আমি, ইয়াসিন আর আমার মধুবালা, কালপুরুষ, জানালা, মুক্তি, পত্রলেখা, আনোয়ার কা আজব কিসসা, টোপি, উড়োজাহাজ। ২০০৭ সালে এথেন্স ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের গোল্ডেন অ্যাথেনা অ্যাওয়ার্ড পান। তাঁর পাঁচটি সিনেমা ভারতের জাতীয় পুরস্কার পায়। ছবিগুলি হল বাঘ বাহাদুর, চরাচর, লাল দরজা, মন্দ মেয়ের উপাখ্যান, কালপুরুষ। উত্তরা এবং স্বপ্নের দিন সিনেমার জন্য দু’বার শ্রেষ্ঠ পরিচালক হয়েছিলেন। তাঁর পরিচালিত দূরত্ব, ফেরা এবং তাহাদের কথা সিনেমা তিনটি সেরা সিনেমার স্বীকৃতি পেয়েছিল সারা ভারতে।
কাজের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অদম্য। থামতে জানতেন না। তাই অবসর নেওয়ায় বিশ্বাসী ছিলেন না। এমনকী, মার্চ মাসেও তিনি নতুন একটি সিনেমা তৈরি করার জন্য চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। এক মহিলা গোয়েন্দার গল্পের সুতো বুনছিলেন তিনি। সেই সিনেমা আর তাঁর তৈরি করা হল না। সিনেমা পরিচালনার পাশাপাশি অসাধারণ সব কবিতাও লিখতেন তিনি। তাঁর লেখা বহু কবিতা উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে সাহিত্য মহলে। কফিন কিংবা সুটকেস, হিমযোগ, ছাতা কাহিনি, গভীর আড়ালে, রোবটের গান, শ্রেষ্ঠ কবিতা ইত্যাদি তাঁর লেখা অনেক বই পাঠকের মননে তাঁর অনন্য স্থান তৈরি করে দিয়েছে। তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরই বাংলা সাহিত্য, সিনেমা ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত বহু ব্যক্তিই শোক প্রকাশ করেছেন। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘আমার গল্প ‘দূরত্ব’ দিয়েই তাঁর চলচ্চিত্র অভিযান শুরু হয়। তবে আমি তাঁকে কবি হিসেবেই চিনতাম। আমি খুবই স্নেহ করতাম। কয়েক বছর আগে দেখা হয়েছিল। তখনই জানলাম, তাঁর শরীর ভালো নয়।’ পরিচালক তরুণ মজুমদার বলেছেন, ‘বুদ্ধদেবের মৃত্যু খুবই বড় ক্ষতি। আমি হতবাক।’
পরিচালক গৌতম ঘোষ বলেছেন, ‘সিনেমা জগতের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। আমরা একসঙ্গে কাজ শুরু করেছিলাম। আমাকে জোর করে অভিনয় করিয়েছিলেন। অনেক স্মৃতি রয়েছে। দেশে–বিদেশে একসঙ্গে গিয়েছি। কত কফিশপে আড্ডা দিয়েছি, স্বপ্ন দেখেছি। সিনেমাও দেখেছি। সবটাই সুখের স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।’ পরিচালক তথা অভিনেত্রী অপর্ণা সেন বলেছেন, ‘আমার প্রিয় পরিচালক ছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। কত অসাধারণ সব সিনেমা তৈরি করেছেন। সিনেমা জগৎ তাঁকে চিরকাল মনে রাখবে।’ পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘আমার সিনেমা স্মৃতির দুটি অনবদ্য অংশই হল গৃহযুদ্ধ এবং বাঘ বাহাদুর। এমনকী, তাঁর শেষ সিনেমা ‘উড়োজাহাজ’ও সিনেমা জগতে তাঁর স্থান বুঝিয়ে দিয়েছিল। তাঁর প্রতিটি সিনেমাই ছিল যেন এক ধরনের কবিতা। বিদায় এমন স্মৃতি নির্মাতা।’ পরিচালক অরিন্দম শীল বলেছেন, ‘আপনি দেশের এই অংশ মানে বাংলা থেকে সিনেমা তৈরি করেছেন। এর জন্য আমি গর্বিত। আমরাও গর্বিত। আপনার আত্মার শান্তি কামনা করি।’
তরুণ পরিচালক অনীক দত্ত বলেছেন, ‘আমার সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয় আমারই শেষ ছবির সময়। অনেক দিন আগে দেখা হয়েছিল। শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। কলেজ জীবনে যাঁদের কাজ আমাকে অনুপ্রাণিত করত, তাঁদের মধ্যে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ছিলেন অন্যতম। অনেক বড় মাপের মানুষ ছিলেন তিনি।’ অভিনেতা প্রসেনজিৎ বলেছেন, ‘আরও একজন মাস্টার চলে গেলেন। ভাবতে পারছি না। বাংলার সিনেমার ক্ষেত্রে খুবই দুঃসময় চলছে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার সারা জীবনের সঙ্গী। একদম অন্য ভাবে ভাবতেন তিনি। তাঁর ছবি দেখেই বড় হয়ে উঠেছি। কতবার খ্যাতনামা সব আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর সঙ্গে সিনেমা দেখেছি! সেই সময়েই খেয়াল করেছি, বিদেশের মাটিতে বাংলা সিনেমার কথা উঠলেই বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের নামও উচ্চারণ হয়। একেবারে শিক্ষক গোছের মানুষ ছিলেন তিনি। অনেক কিছু শিখেছি তাঁর কাছ থেকে। কবিও ছিলেন। তবে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হল তাঁর মতো খুব কম ভাল মানুষ দেখেছি আমি।’
অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা বলেছেন, ‘তাঁর সিনেমায় আমার অভিনয় করার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু আমারই দুর্ভাগ্য, সেই সুযোগ আমি গ্রহণ করতে পারিনি। প্রথম যে–বার তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, আমার জনপ্রিয়তা দেখে বেজায় বিরক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, তোমার এত জনপ্রিয়তা আমি জানতাম না। আমার শ্যুটিং করতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে। যখন ‘উত্তরা’ সিনেমা তৈরি করছেন, তখনও আমার ডাক এসেছিল। কিন্তু সেই সময় আমার এত অন্য ছবির চাপ ছিল, কোনও ভাবেই তাঁর সেই ছবিতে কাজ করার সময় বের করতে পারিনি। এই আফসোস আমার সারা জীবন থাকবে।’ অভিনেতা জিৎ বলেছেন, ‘বাংলা শুধু নয়, ভারতীয় সিনেমা জগতেরও বিশাল ক্ষতি হয়ে গেল। স্যর, আপনার কাজকে খুবই মিস করব।’ অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘তাঁর মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি।’
এ ছাড়াও তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র, গায়ক রূপঙ্কর বাগচী, অভিনেত্রী জয়া আহসান, অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য, পরিচালক রাজ চক্রবর্তী, অভিনেতা সোহম চক্রবর্তী, প্রমুখ।