বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:
ফের দল বদলালেন মুকুল রায়। কৃষ্ণনগরের এই বিজেপি বিধায়ক ফিরে গেলেন পুরনো দল তৃণমূলে। পুরস্কার স্বরূপ তিনি রাজ্যসভায় তৃণমূলের সাংসদ হতে পারেন। রাজ্যসভায় তৃণমূলের তরফে দুটি সাংসদ পদ খালি রয়েছে। একটিতে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যশোবন্ত সিনহাকে সাংসদ করতে পারে তৃণমূল। আর অপরটি দেওয়া হতে পারে মুকুল রায়কে। অন্যদিকে, মুকুল রায়ের পথ অনুসরণ করে এর পর তৃণমূলে ফিরতে পারেন সব্যসাচী দত্ত এবং রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়।
শুক্রবার দুপুরে ছেলে শুভ্রাংশু রায়কে নিয়ে বাইপাসের তৃণমূল ভবনে যান মুকুল। সেখানে আসেন তৃণমূল দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তার পর তাঁরা সবাই বৈঠকে বসেন। পরে সাংবাদিক বৈঠকে মুকুল রায় এবং শুভ্রাংশু রায়ের তৃণমূলে ফেরার কথা ঘোষণা করেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলে তাঁদের স্বাগত জানান পার্থ চট্টোপাধ্যায়। দু’জনকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলে যোগ দিয়ে মুকুল বলেন, ‘বিজেপি করতে পারলাম না। করব না। তাই পুরনো দলে ফিরে এলাম। বাংলা আবার আগের মতোই চলবে। ভারতকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’ মমতা বলেন, ‘ঘরের ছেলে। ঘরেই ফিরল। মুকুলকে অনেক ধমকে চমকে এজেন্সির ভয় দেখিয়ে রেখেছিল। ওর শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তৃণমূলে ফিরে মানসিক শান্তি পেল। নির্বাচনের সময় আমাদের দলের বিরুদ্ধে মুকুল একটাও কথা বলেনি।’
মুকুল রায় যে দল বদল করতে পারেন, তার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল কিছুদিন আগেই। তাঁর স্ত্রী করোনা সংক্রমিত হয়ে বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে তাঁকে দেখতে যান অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই ঘটনায় তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মুকুল–পুত্র শুভ্রাংশু রায় ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেন, ‘দলের কেউ আমাদের খোঁজ নেননি।’ অন্যদিকে, তার পরের দিনই মুকুল রায়ের স্ত্রীকে দেখতে হাসপাতালে যান বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। যদিও সেই বিষয়টিকে মুকুল রায়ের পরিবার কোনও গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সেদিনই মুকুল রায়কে ফোন করে তাঁর স্ত্রীর খবর নেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দু’জনের কথা হয়েছিল। তার পরেও মুকুল রায় তৃণমূলে চলে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতারা যথেষ্ট ক্ষুব্ধ বলে সূত্রের খবর। তবে মুকুল রায় বিজেপিতে অস্বস্তিতে থাকার খবর পেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফে ভোটের আগেই একটি বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। বলা হয়েছিল, ‘তুমি যদি সেখানে ভালো না থাকো, তা হলে ফিরে এসো। তোমার জন্য তৃণমূলের দরজা খোলা থাকবে।’
মুকুলকে আটকাতে শেষ চেষ্টা অবশ্য করেছেন বিজেপি নেতারা। শুক্রবার সকাল থেকে বেশ কয়েকবার তাঁকে ফোন করেছেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়। কিন্তু মুকুল রায় ফোন ধরেননি। এ ছাড়া রাজ্য বিজেপির এক শীর্ষ নেতা ফোন করেন মুকুল রায়ের আপ্তসহায়ককে। তিনি ফোন ধরলেও মুকুল রায় ওই নেতার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। এদিকে, মুকুল রায়ের পথ ধরে তৃণমূলে ফিরতে পারেন আরেক বিজেপি নেতা সব্যসাচী দত্তও। উল্লেখ্য, মুকুল রায়ের হাত ধরেই তিনি তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়েছিলেন। বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থীও হন। রাজনীতিতে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সুজিত বসু ছিলেন তৃণমূল প্রার্থী। সেই সুজিত বসুর কাছে তিনি হেরে যান। তৃণমূলে গেলে তাঁকে সুজিত বসুর সঙ্গেই থাকতে হবে। এদিকে, আগামী সপ্তাহে নাকি রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ও তৃণমূলে ফিরতে পারেন।
এদিকে, এ ব্যাপারে একে একে অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন। বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁ বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে মিরজাফরকে দেখেছিল বাংলার মানুষ। এখন আবার সেই মিরজাফরকেই আমরা দেখছি। মুকুল রায় বেইমান। তিনি কোনও চাণক্য নন। হলে নিজের ছেলেকে বীজপুর থেকে বিধানসভা নির্বাচনে জেতাতে পারতেন।’ অর্জুন সিং বলেছেন, ‘মুকুল রায় গদ্দার। চিরকাল গদ্দারি করেই রাজনীতি করেছেন। বিজেপির কেউই তাঁকে বিশ্বাস করতেন না। তিনি মমতার সঙ্গেও গদ্দারি করেছেন। তিনি কোনও দিনই জননেতা ছিলেন না। তিনি নিজের জন্য বিজেপিতে এসেছিলেন। নিজের জন্যই তৃণমূলে গিয়েছেন। তাঁর জন্য বিজেপির কোনও ক্ষতি হবে না। কৃষ্ণনগরে বিধানসভার নির্বাচনে তিনি জিতেছেন বিজেপির জন্যই।’ শীলভদ্র দত্ত বলেছেন, ‘এগুলো তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে বারবার এ ভাবে শিবির বদলালে মানুষ ভালো ভাবে নেয় না। রাজনীতি নিয়ে তাঁদের ধারণাটাই খারাপ হয়ে যায়।’
যেমন, তৃণমূল থেকে বিজেপিতে আসা বৈশালী ডালমিয়া এদিন রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে উদ্দেশ্য করে মন্তব্য করেন, ‘দলের আগাছাগুলিকে দ্রুত বিদায় করুন। না হলে দলেরই সমস্যা বাড়বে।’ এ ছাড়া, দলের আরেক নেতা অনুপম হাজরা মন্তব্য করেছেন, ‘ভোটের আগে যাঁরা দল বদলে বিজেপিতে এসেছেন, তাঁদেরই অস্বাভাবিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দলের পুরনো নেতাদের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেইজন্যই দলের এই ভাঙন।’ মুখ খুলেছেন অপর বিজেপি নেতা তথাগত রায়ও। তিনি বলেছেন, ‘মানুষই মল–মূত্র ত্যাগ করে। সেইজন্য মানুষ দুর্বল হয়ে যায় না।’ সরাসরি মুকুল রায়কে নিয়ে কিছু না বললেও পরে বিক্ষুব্ধদের সম্পর্কে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ‘যাঁরা দলে থাকতে পারছেন না, তাঁদেরই সমস্যা হচ্ছে।’ মুকুল রায় সম্পর্কে তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘দলের অনেক কাজ আছে। অনেক কর্মী আক্রান্ত। করোনার প্রভাবও রয়েছে। বিশেষ কারও সম্পর্কে ভাবার কোনও কারণ নেই। দলের কোনও ক্ষতিও হবে না।’
স্বভাবতই রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে, মুকুল রায়ের এই দল বদলে বিজেপির কতটা ক্ষতি হল? তৃণমূলেরই বা লাভ কতটা হল? মুকুল রায়ই বা ফের দল বদল করে কতটুকু লাভবান হবেন? এর উত্তরে নানা মত পাওয়া যাচ্ছে। এক পক্ষ মনে করছে, এর ফলে বিজেপি অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেল। কারণ, মুকুল রায় নিঃসন্দেহে হেভিওয়েট নেতা। তাঁকে তৃণমূলের চাণক্য বলা হত। সুতরাং তাঁকে পেয়ে তৃণমূল অনেকটাই লাভবান হবে। কিন্তু মুকুল রায় নিজে কতটা লাভবান হবেন, সে বিষয়ে এই পক্ষের কাছ থেকে কোনও নিশ্চিত ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।
অন্যদিকে, আরেক পক্ষ মনে করছে, এর ফলে বিজেপির তেমন কোনও ক্ষতি হবে না। কারণ, মুকুল রায় হেভিওয়েট নেতা হলেও সেই অর্থে তিনি জননেতা নন। নির্দিষ্ট একটি আসনও নিজের জনপ্রিয়তার জোরে কোনও দলকে জিতিয়ে আনার ক্ষমতা তাঁর নেই। কৃষ্ণনগর কেন্দ্রে তিনি জিতেছেন, নিজের ক্ষমতায় নয়, জিতেছেন বিজেপির জন্যই। কারণ, ওই কেন্দ্রে বরাবরই বিজেপির প্রভাব রয়েছে। ওই কেন্দ্রে এর আগেও অনেকবারই বিজেপি জিতেছে। তা ছাড়া, মুকুল রায় বিজেপিতে যাওয়ার পর বেশ কয়েকজন তৃণমূল নেতা দল বদল করে গেরুয়া শিবিরে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁরা তেমন প্রভাবশালী নেতা নন। যে ভাবে তিনি প্রভাবশালী তৃণমূল নেতাদের দল ভাঙিয়ে বিজেপিতে নিয়ে আসবেন বলে তখন ভাবা হয়েছিল, তার কিছুই হয়নি।
অন্যদিকে, তাঁকে নিয়ে এই মুহূর্তে তৃণমূলের লাভ তেমন নেই। কেন না, বিধানসভা নির্বাচনে জিতে এখন তৃণমূল যথেষ্ট শক্তিশালী দল। দলের এক নম্বর নেত্রী নিঃসন্দেহে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং, দুই নম্বর নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই অভিষেকই মুকুল রায়ের দল বদলের অন্যতম কারণ বলে তখন মনে করা হত। কারণ, অভিষেকের জন্য তৃণমূলে মুকুল–পুত্র শুভ্রাংশু রায় তেমন জায়গা করে নিতে পারছিলেন না বলে অভিযোগ। মুকুল চেয়েছিলেন, তিনি যেহেতু তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাতা, তাই শুভ্রাংশু তৃণমূলের দ্বিতীয় নেতা হিসেবে উঠে আসুন। কিন্তু অভিষেক দ্বিতীয় নেতা হিসেবে উঠে আসায় মুকুলের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল। আর, তৃণমূল এখন যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে মুকুল রায়কে আগের মতো খুব বেশি জায়গা দেওয়া হবে বলে মনে হয় না। যতই তাঁকে পুরনো মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হবে বলে জানান না কেন, মমতাও তাঁর ওপর আগের মতো আর আস্থা রাখতে পারবেন বলে মনে হয় না। এই প্রশ্নও রয়েছে তৃণমূলের অন্দরেই।
এখন প্রশ্ন হল, মুকুল রায় তৃণমূলে গিয়ে নিজে কতটা লাভবান হবেন? মনে হয় না তাঁর খুব বেশি লাভ হবে। হয়তো নিজে রাজ্যসভার সাংসদ হবেন এবং ভবিষ্যতে তাঁর ছেলের বিধায়ক পদ নিশ্চিত করার বাইরে তিনি সম্ভবত আর বেশি কিছু তৃণমূল থেকে পাবেন না। তিনিই যে তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাতা এবং সেই হিসেবে তাঁর কথার ওপর আর কেউ তেমন মন্তব্য করার অধিকার পাবেন না, সেই রীতি আর ফিরে আসবে না। বরং বিজেপিতে থেকে গেলে এবং নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহর আস্থা অর্জন করতে পারলে এবার হয়তো তিনি বেশ গুরুত্ব পেতেন। কারণ, দিলীপ ঘোষের ভূমিকায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও অসন্তুষ্ট বলে দিল্লি সূত্রে জানা গিয়েছে।
বিশেষ করে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে যে ৯২টি আসনে বিজেপি সামান্য ব্যবধানে হেরেছে, সেখানে দিলীপ ঘোষের অনুগামীদের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে রিপোর্ট গিয়েছে। সুতরাং দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধে যদি কেন্দ্রীয় বিজেপি পদক্ষেপ করে, তা হলে মুকুল রায়ের লাভবান হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। কেন না, দিলীপ ঘোষ লবির জন্যই রাজ্যে তিনি কোণঠাসা ছিলেন বলে বিজেপির অন্দরে অনেকবারই গুঞ্জন উঠেছিল। আরও একটি তথ্যও সামনে এসেছে। যেমন শুভেন্দু অধিকারীকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় বিজেপির তরফে, ততটাই আড়ালে থেকে গিয়েছেন মুকুল রায়।
কিন্তু এর বিরুদ্ধেও পাল্টা যুক্তি রয়েছে বিজেপি নেতাদের। অনেকেই বলছেন, মুকুল রায় কোনও জননেতা নন। তিনি মাটিতে নেমে রাজনীতি করেন না। কিন্তু শুভেন্দু জননেতা। তাই দু’জনের তুলনা চলে না।