উপমন্যু রায়:
সভ্যতার সঙ্কট। হ্যাঁ, এটা সভ্যতারই সঙ্কট। পাঁচ হাজার বছর ধরে যে সভ্যতা অনেক কষ্টে আমরা গড়ে তুলেছি তিলতিল করে, সেই সভ্যতা আজ অভূতপূর্ব সঙ্কটের মুখোমুখি।
আর, সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, সভ্যতার এই সঙ্কটের জন্য দায়ী আমরাই। কেন না, প্রাকৃতিক কোনও বিপর্যয়ে আজ আমাদের সাধের এই পৃথিবী বেসামাল হয়ে যায়নি। কোনও গ্রহাণুর অতর্কিত আছড়ে পড়ার ঘটনাও এখন ঘটেনি। যে ধরনের ঘটনা সাড়ে ৬ কোটি বছর আগে পৃথিবী থেকে অবসান ঘটিয়ে দিয়েছিল ডায়নোসর সাম্রাজ্যের। আজ কিন্তু আমাদের সভ্যতাকে ভয়ঙ্কর বিপদের সামনে ফেলে দিয়েছি আমরাই।
আর সেই কারণেই দুনিয়া জুড়ে লকডাউন হয়ে গিয়েছে। আমার বা আপনার পাড়া, শহর, রাজ্য, বা দেশ নয়, গোটা পৃথিবী জুড়ে চলছে বন্ধ। অভাবিতপূর্ব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সারা বিশ্বে। সমস্ত কিছুই বন্ধ এখন। আচমকাই যেন পৃথিবীটা থেমে গিয়েছে। আমরা সকলেই এখন গৃহবন্দি। এই বন্দিদশা বাঁচার জন্য। তাই এক ধরনের স্বেচ্ছানির্বাসনে আমরা।রাস্তায় এখন যত না গাড়ি চলে, অ্যাম্বুল্যান্স চলে যেন তার অনেক বেশি। সাইরেন বাজিয়ে যখন তারা ছুটে যায়, বুকের ভেতরে কিছু যেন একটা গিয়ে ধাক্কা মারে। তবে এই ধাক্কা তো শুধু আমার বা আমাদের নয়, এই যন্ত্রণা গোটা বিশ্বেরই। স্মরণাতীত কালে পৃথিবীকে এমন ভাবে অসহায় এবং স্তব্ধ হয়ে যেতে দেখা যায়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও প্রতিটি দেশ এ ভাবে থেমে যায়নি। যারা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িয়েছিল, তারা ছাড়া অন্য দেশগুলির মানুষ সব কিছু বন্ধ করে দিয়ে ঘরে বসে থাকেনি। মহামারীও অনেকবার এসেছে। কিন্তু এ ভাবে কি দুনিয়াটা একসঙ্গে কখনও থেমে গিয়েছে?তবে লকডাউন এই প্রথম কোথাও যে হল, এমন নয়। এক জায়গায় পড়লাম, প্রাচীন ভারতে এমন কৌশল সকলেরই জানা ছিল। চরক সংহিতায় লেখা রয়েছে, জীবাণু আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসার পাশাপাশি ২১ দিন একা ঘরবন্দি করে রাখতে হবে। সকলে কাছাকাছি থাকলে সেই জীবাণু একজন থেকে অন্যজনে সংক্রমিত হয়। তাই একা গৃহবন্দি থাকতে বলা। ২১ দিনের মধ্যে জীবাণুর প্রভাব কমে যায়।
কিন্তু এবারের ঘটনা পুরোপুরি আলাদা। জীবাণু ছড়িয়েছে সারা পৃথিবীতেই। তাই সর্বত্র লকডাউন। অনেকে বলতেই পারেন, যেহেতু প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি, তাই সংক্রমণ বা মৃত্যুহারেও তো এখনও সে–ভাবে লাগাম পরানো যায়নি। তাই লকডাউনে লাভ হল কী? কিন্তু, কথা হল, দুনিয়া জুড়ে যদি লকডাউন না–ই হত, তা হলে সংক্রমণ বা মৃত্যুর হার হত আমাদের কল্পনাতীত।
তবু আমরা যে বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থায় নেই, সে কথা কিন্তু সত্য। প্রতিটি দিনই একটু একটু করে যেন সেই করাল ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিদিনই শুনিয়ে চলেছে তার হতাশার কথা। বলছে, এই লড়াই নাকি দীর্ঘদিন চালিয়ে যেতে হবে। যদি ব্যবসা–বাণিজ্য এবং কাজকর্ম দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে, তা হলে তো অন্য বিপদগুলি গ্রাস করবে আমাদের! কী হবে তা হলে?
মাঝে মাঝে অনুভব করি, চারদিকে যেন অন্ধকারের হাঁ–মুখ ক্রমশ বড় হচ্ছে।
মনে হচ্ছে, সেই অন্ধকার এগিয়ে আসছে আমাদের সভ্যতাকে গিলে খেতে। ৭০০ কোটির কিছু বেশি মানুষের এই সভ্যতা যেন অনায়াসে ডুবে যেতে তৈরি হচ্ছে সেই হাঁ–মুখে। পাঁচ হাজার বছরের এই সভ্যতা কি তা হলে এ ভাবে অসহায় আত্মসমর্পণ করবে? এত অন্ধকারের মাঝেও কি কোনও আশার আলো নেই?
সে দিন আমেরিকার বাসিন্দা একজনের লেখা একটি নিবন্ধ পড়ছিলাম। পড়ে মনে হল, আশা বোধ হয় পুরোপুরি ফুরিয়ে যায়নি। তিনি লিখেছেন, লকডাউনের মাঝে সময়মতো দোকানে গিয়ে প্রয়োজনের চেয়েও ঢের বেশি জিনিস কিনে নিয়ে আসছেন তাঁরা। মানে তিনি এবং এলাকার অন্য বাসিন্দারাও। এ কথা শুনে ভেবে বসবেন না, আমাদের মতো তাঁরা ভয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস কিনে মজুত করছেন বাড়িতে!
মোটেও তা নয়। সেইসব জিনিস বাড়ি নিয়ে এসে তাঁরা ফোন করে প্রতিবেশী অন্যদের খোঁজ নিচ্ছেন। তার পর তাঁদের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন সেইসব অতিরিক্ত জিনিস। ঠিক তেমনই প্রতিবেশীরাও অতিরিক্ত জিনিসপত্র কিনে এনে পাঠিয়ে দিচ্ছেন তাঁর এবং তাঁর মতো অন্যদের বাড়িতে। কেমন যেন একটা পাড়া কালচার গড়ে উঠছে পৃথিবীর শক্তিশালী দেশটিতে। যেন উত্তর কলকাতার মতো।আজ তো উত্তর কলকাতা সেই সংস্কৃতিকেই ধীরে ধীরে বিদায় দিয়ে দিচ্ছে। আমি উত্তর কলকাতার ছেলে। ছেলেবেলায়ও দেখতাম, কারও বাড়িতে অসুখ–বিসুখ হলে বা মৃত্যুর মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটলে পাশে দাঁড়ানোর জন্য লোকের অভাব হত না। পাড়া থেকে বহু মানুষই ছুটে আসতেন। রাত জাগতেন। আর আজ উত্তর কলকাতার বাড়িগুলি ভেঙে যতই গড়ে উঠছে দেশলাই বাক্সের মতো ফ্ল্যাটবাড়ি, ততই যেন হারিয়ে যাচ্ছে সেই সংস্কৃতি। আর ক্রমশ একা হয়ে যাচ্ছি আমরা।
আজ এই দুঃসময়ে যখন করোনা নামে অদৃশ্য এক দানব আমাদের ক্রমশ ঘিরে ফেলছে, তখন মনে হয়, মানুষেরই এখন বড় প্রয়োজন মানুষকে। ধর্ম বা রাজনীতি, বা অন্য সব কিছু নিয়ে বিশ্বাস যার যা–ই হোক, আমাদের বোধে না হয় জেগে উঠুক অন্য এক ভাষা। তা হল, আমরা মানুষ। আমরা একা নই। আমরা সকলে মিলেই বাঁচব।
সেই বেঁচে থাকার জন্য না হয় আমরা পরস্পরের দিকে বাড়িয়ে দেব সেই বিশ্বাসেরই হাত। যা হবে অনেক বেশি বন্ধুত্বের। ভালবাসার।
সেটা হোক নতুন এক পৃথিবী।