দৈনিক প্রত্যয় ডেস্কঃ জাকাত এটি আরবি শব্দ। জাকাতের অর্থ পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি ও আধিক্য। ধনীদের সম্পদে আল্লাহর অংশকে জাকাত বলে। বিত্তশালীদের সম্পদ জাকাতের মাধমে পরিশুদ্ধ হয়। জাকাত দারিদ্র্য মোচন ও অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে।
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয়টি হচ্ছে জাকাত। ঈমানের পর নামাজ ও তার পরই জাকাতের স্থান। পবিত্র কোরআনের ৩২ জায়গায় জাকাতের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে ২৮ জায়গায় নামাজ ও জাকাতের কথা একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে একবার বললেই ফরয হয়ে যায়। বারবার বলার অর্থ গুরুত্ব বুঝানো।
সব ধরনের সম্পদের উপর জাকাত ফরজ হয় না। শুধু সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, পালিত পশু (নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী) এবং ব্যবসার পণ্যে জাকাত ফরজ হয়।
সোনা-রুপার অলংকার সব সময় কিংবা একেবারেই ব্যবহার না করা হোক, সর্বাবস্থায় তার জাকাত দিতে হবে। (আবু দাউদ শরিফ : ১/২৫৫; নাসায়ি, হাদিস : ২২৫৮)
অলংকার ছাড়া সোনা-রুপার অন্য সামগ্রীর ওপরও জাকাত ফরজ। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক : ৭০৬১)
আবশ্যিক প্রয়োজন থেকে উদ্বৃত্ত টাকা-পয়সা নিসাব পরিমাণ হলে এবং এক বছর স্থায়ী হলে বছর শেষে তার জাকাত আদায় করা ফরজ। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৯১)
ব্যাংক ব্যালান্স, ফিক্সড ডিপোজিট, বন্ড, শেয়ার সার্টিফিকেট ইত্যাদিও নগদ টাকা-পয়সার মতোই। এসবের ওপরও জাকাত ফরজ। হজের উদ্দেশ্যে কিংবা ঘরবাড়ি নির্মাণ, ছেলে-মেয়ের বিয়েশাদি ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করা হয়, তাতেও জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৩২৫)
দোকানপাটে যা কিছু বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে রাখা থাকে, তা বাণিজ্যিক পণ্য। এর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত আদায় করা ফরজ। (সুনানে আবু দাউদ : ১/২১৮)
ব্যবসার নিয়তে কোনো কিছু ক্রয় করলে তা স্থাবর সম্পত্তি হোক, যেমন—জমিজমা, ফ্ল্যাট কিংবা অস্থাবর সম্পত্তি যেমন—মুদিসামগ্রী, কাপড়-চোপড়, অলংকার, নির্মাণসামগ্রী, গাড়ি, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, হার্ডওয়্যার সামগ্রী, বই-পুস্তক ইত্যাদি, তা বাণিজ্যিক পণ্য বলে গণ্য হবে এবং মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭১০৩)
যদি সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা কিংবা বাণিজ্যিক পণ্যের মধ্যে কোনোটি পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু এসবের একাধিক সামগ্রী এ পরিমাণ রয়েছে, যা একত্র করলে সাড়ে ৫২ তোলা রুপার সমমূল্য বা তার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে সব সম্পদ হিসাব করে জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৮১)
দোকানের ডেকোরেশন, আলমারি, তাক ইত্যাদি মূল্যের ওপর জাকাত ফরজ নয়, বরং সেল বা বিক্রি করার জন্য যেসব পণ্য বিদ্যমান, তার মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে তাতে জাকাত ফরজ হবে। জাকাত হিসাব করার পদ্ধতি হলো—বছরের একটা সময় দিন-তারিখ নির্ধারণ করে দোকানে বিদ্যমান পণ্যের মূল্যের হিসাব করে দেখা গেল, পাঁচ লাখ টাকার পণ্য আছে। অতঃপর ওই বছর অতিবাহিত হওয়ার পর আবার আনুমানিক পণ্যের মূল্য ধরে দেখা গেল, শুরুতে যেই পরিমাণ সম্পদ ছিল, তা নিসাব পরিমাণ। আবার এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর যে পণ্য আছে, তা-ও নিসাব পরিমাণ, তাহলে সমুদয় সম্পদের আড়াই শতাংশ জাকাত দিতে হবে। (তাতারখানিয়া : ৩/১৬৯, হিন্দিয়া : ১/১৮০, দুররুল মুখতার : ৩/১৮২)
কোনো ব্যক্তি সঞ্চয়ের জন্য যদি ব্যাংকে টাকা জমা রাখে, তাহলে ঋণমুক্ত অবস্থায় যেদিন তার জমাকৃত টাকা নিসাব পরিমাণ হবে, সেদিন থেকে এক বছর পূর্ণ হলে ওই টাকার ওপর জাকাত দিতে হবে। (ফাতাওয়া আলমগিরি : ১/২৭০; মাহমুদিয়া : ৩/৫৭)
বর্তমানে গাড়ি বা দোকান ভাড়া নেওয়ার সময় মোটা অঙ্কের টাকা অ্যাডভান্স রাখতে হয়, অ্যাডভান্সের এই টাকা গাড়ি বা দোকানের মালিকের হয়ে যায় না। বরং যিনি ভাড়া নিচ্ছেন, তার মালিকানায় এ টাকা রয়ে যায়। তাই নিসাবের পরিমাণ হলে ওই টাকাসহ জাকাত দিতে হবে। পক্ষান্তরে, দোকান বা বাড়ি ভাড়া গ্রহণকারী ব্যক্তির জন্য ওই টাকার জাকাত আদায় করা জরুরি। (আদদুররুল মুখতার : ৩/১৮৪; ফাতাওয়া দারুল উলুম : ৬/৭৭, আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/২৬১)
যাকাত না দেওয়া কাফিরদের বৈশিষ্ট্য ও জাহান্নামের শাস্তির অন্যতম কারণ। আল্লাহ বলেন:
“ধ্বংস মুশরিকদের জন্য, যারা যাকাত প্রদান করে না, আর যারা আখেরাতে অবিশ্বাস করে।” সূরা ফুসসিলাত (৪১): আয়াত ৬-৭।
কুরআনে বলা হয়েছে, জাহান্নামীগণকে প্রশ্ন করা হবে: কিজন্য তোমরা জাহান্নামে শাস্তি ভোগ করছ? তারা তাদের কুফুরীর উল্লেখের সাথে সাথে নামায ও যাকাত ত্যাগের কথা বলবে। তারা বলবে:
“আমরা সালাত পালনকারীগণের মধ্যে ছিলাম না। আর আমরা দরিদ্রগণকে খাওয়াতাম না।” সূরা আল- মুদ্দাসসির (৭৪): আয়াত: ৪২-৪৩।
“আল্লাহ সুদের বৃদ্ধিকে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করেন আর ‘সাদাকাহ’ বা যাকাতকে বৃদ্ধি করেন।” সূরা বাকারা: ২৭৬ আয়াত।
“এবং তোমরা মানুষের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য যে বৃদ্ধি (সুদ) প্রদান কর তা আল্লাহর নিকট বৃদ্ধি পায় না। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তোমরা যে যাকাত প্রদান কর সেই যাকাতই হল বহুগুণ বৃদ্ধিকারী।” সূরা রূম: ৩৯ আয়াত।
শেষকথা, বৈধ-অবৈধভাবে মাল বৃদ্ধি করলে এবং সঞ্চয় করলেই সম্পদশালী হওয়া যায় না। আপনি জাকাত ফাঁকি দিচ্ছেন আপনার জন্য না আপনার সন্তানদের জন্য? আপনি যে সম্পদ রেখে যাচ্ছেন তার মালিক আপনার ছেলের ছেলে তার ছেলেকে আপনি চিনবেন না। ধরুন, আমার যে সম্পক আছে সেটা আমি আমার দাদার দাদার সম্পদ থেকে পেয়েছি। আমি আমার দাদার দাদার নামটিও জানিনা (আপনি জানেন কি?)। সে যদি জাকাত ফাঁকি দিয়ে থাকে তার জন্য সে অনন্তকাল শাস্তি ভোগ করছে। আমাদের এখনই সময় বাড়ীর পাশে করোনা ভাইরাসের জন্য অনেকেই পরিবার নিয়ে বিপদে আছে। আমরা তাদের পাশে দাঁড়ায় জাকাতের টাকা তাদের মধ্যে বন্ঠন করে দিয়ে নিজের সম্পদ পরিশুদ্ধ করি ও বেহেস্তের পথ সুগম করি।
লেখকঃ মোঃ আব্বাস আলী (সহকারী অধ্যাপক)
ব্যবস্থাপনা বিভাগ
জি, টি ডিগ্রী কলেজ, তালসার।
কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহ।
ডিপিআর/ জাহিরুল মিলন