নিজস্ব প্রতিবেদক: চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ৩৮০ কোটি টাকা আমানত কমেছে। আগের প্রান্তিকের তুলনায় ঋণ বিতরণও কমেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না কয়েকটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে গত বছর পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডকে অবসায়নের পর খাতটি চরম আস্থা সংকটে পড়েছে। এর প্রভাব পুরো আর্থিক খাতেই পড়েছে। এর মধ্যে করোনার আঘাত যেন খাতটির ওপর ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। সব মিলিয়ে আমানত কমার বড় কারণ করোনাভাইরাস ও কয়েক বছর ধরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর গ্রাহকের অনাস্থা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, মার্চ শেষে দেশের ৩৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংগৃহীত আমানত ছিল ৪৩ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। জুনে আমানত কমে ৪৩ হাজার ২৬৪ কোটি টাকায় নেমে আসে। তবে একই সময়ে (এপ্রিল-জুন) ব্যাংকিং খাতের আমানত বেড়েছে ৪৪ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। জুন শেষে ৫৯টি ব্যাংকের সংগৃহীত আমানতের পরিমাণ (স্থিতি) ছিল ১১ লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকা।
পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বন্ধ হওয়ার পর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর অনাস্থা দেখাতে শুরু করে বড় আমানতকারীরা। বিশেষ করে ব্যাংকগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা আমানত তুলে নিতে তৎপর হয়। এটাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কমে যাওয়ার বড় কারণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
আলোচ্য সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণও কমেছে। তবে আমানতের তুলনায় ঋণ কমার হার অনেক কম। এপ্রিল-জুন সময়ে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ৬১ কোটি টাকা কমে ৬৯ হাজার ৫১১ কোটি টাকায় নেমে আসে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এপ্রিল-জুন সময়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা তাদের ৩২ কোটি টাকার আমানত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের আমানতকারীরা তুলে নেন ৩৪৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মূলত ঢাকা বিভাগের গ্রাহকরা আমানত তুলে নেয়ায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কমেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এপ্রিল-জুন সময়ে নারী গ্রাহকদের প্রাতিষ্ঠানিক আমানত কমেছে ৮১ শতাংশ, যেখানে পুরুষ গ্রাহকদের প্রাতিষ্ঠানিক আমানত কমেছে ৩৩ শতাংশ।
দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ১৯৯৩ সালের আইনে পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মূল কার্যক্রম ঋণ ও লিজ সুবিধা দেয়া। তবে বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান মেয়াদি আমানত সংগ্রহ করছে। ব্যাংকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চড়া সুদে আমানত নিলেও বেশ কিছুকাল ধরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। এরকম একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডকে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে অবসায়নের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পিপলস লিজিংয়ে গ্রাহকদের ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকার আমানত জমা ছিল, যা এখনও ফেরত পাননি আমানতকারীরা। আমানত ফেরত পাওয়ার দাবিতে সোমবার রাজধানীর মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে বিক্ষোভও করেন তারা। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জুন শেষে নন-ব্যাংক আর্থিক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বেশিরভাগই রিয়েল এস্টেট খাতের।
বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান ও আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোমিনুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে পুরো অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর্থিক খাতটা তারই অংশ।
আমানত কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার আতঙ্ককে দায়ী করে তিনি বলেন, সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকেই মানুষ নিজের কাছে টাকা রাখতে আমানত উঠিয়ে নিচ্ছিল। শুধু ব্যক্তি আমানত নয়, কর্মীদের বেতন দেয়ার জন্য অনেক প্রাতিষ্ঠানিক আমানতও তুলে নিয়েছে গ্রাহক। এতে একটু চাপ তৈরি হয়েছিল। তবে নতুন করে আর্থিক কার্যক্রমে গতি আসতে শুরু করেছে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় আঘাত কতটা ক্ষতি করবে তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ ৮ হাজার কোটি টাকা হবে।