১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। কারণ এ সময় থেকেই মুক্তিযুদ্ধ এক ভিন্ন মাত্রা পেতে শুরু করে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত পেরিয়ে শুরু হয় শীতের মৌসুম। গ্রামবাংলায় নামে শীত। তবে সেই শীত স্পর্শ করতে পারেনি মুক্তিকামী বীর বাঙালিকে। কারণ হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করতে তাদের শরীরের রক্ত টগবগ করে ওঠে।
জানা যায়, ১৯৭১ সালের রক্তঝরা এ দিনে চারিদিকে বীর বাঙালির বিজয় আর পাকহানাদার বাহিনীর পরাজয়ের খবর ছড়িয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন স্থানে পরাজিত হতে থাকে হানাদাররা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হানাদারমুক্ত হতে থাকে। সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সেই বিজয়ের খবর যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের আরও দুর্বার ও অপ্রতিরোধ্য করে তোলে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের এদিন থেকেই শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক যুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সঙ্গে রয়েছে ভারতীয় মিত্রবাহিনী। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী চারিদিক দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে থাকে।
এসময়ে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের জন্য সময়টুকু ছিল অস্থিরতা আর উদ্বেগের। এদিনে জাতিসংঘে বিরাজ করে চরম উত্তেজনা। পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সিনিয়র জর্জ বুশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের উদ্দেশ্য ছিল, মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারতের মধ্যকার যুদ্ধ হিসেবে সবার সামনে উপস্থাপন করা।
যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দাবি করে যে, ‘এ মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তান নিজ নিজ সীমান্তের ভেতর সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে।’ জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করার জন্য, মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারতের মধ্যকার যুদ্ধ হিসেবে জাতিসংঘে উপস্থাপন করার জন্য পাকিস্তান বিমানবাহিনী ৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতের বেশকয়েক জায়গায় বিমান হামলা চালায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে একই তারিখে রাতে ভারত পাকিস্তানের ওপর হামলা চালায়।
তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে বাতিল হয়। পোল্যান্ডও এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকে। প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র হেরে যাওয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
এরপর মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ তীব্র আক্রমণের মুখে বাংলাদেশের প্রতিটি জায়গা থেকে পালানোর পথ খুঁজতে থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এমন উৎকণ্ঠাময় অবস্থায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ লিখিত এক চিঠিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আহ্বান জানান।
এ সময়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি জামাতে ইসলামির আমির আবুল আলা মওদুদী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে জানান যে, ‘প্রতিটি দেশপ্রেমিক মুসলমান প্রেসিডেন্টের সাথে রয়েছে।’
এদিনেই হানাদারমুক্ত হয় লক্ষীপুর। ১৯৭১ সালের এদিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়ে জেলায় অবস্থানকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। এদিনেই ৩ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা শমশেরনগর বিমানবন্দর ও আখাউড়া রেল স্টেশন দখল করেন। ৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দখল করেন মেহেরপুর।
এ ছাড়া ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে কামালপুর নিজেদের আয়ত্তে নেন। চুয়াডাঙ্গার জীবননগর মুক্ত হয় এদিনে। ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর উপজেলায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এদিন মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর তুমুল প্রতিরোধের মুখে হানাদার বাহিনী জীবননগর ছেড়ে ঝিনাইদহ অভিমুখে পালিয়ে যায়।