সুমন,মোংলা(বাগেরহাট)সংবাদদাতা: ‘অতল দিঘির মতো শুয়ে আছো একা…’ নিজের কবিতার পংক্তির মতোই মাত্র ৪২ বছর বয়সে চিরঘুমে শুয়ে পড়লেন কবি ও অধ্যাপক ড. হিমেল বরকত। কবি-গবেষক ড. হিমেল বরকত’র “প্রান্তস্বর ব্রাত্য ভাবনা”, “পথ কবিতার বিলুপ্ত ভূবন”, “বাংলাদেশে আদিবাসী কাব্য সংগ্রহ”, “চন্দ্রবতীর রামায়ণ” প্রভূতি বইয়ে ক্ষমতাহীন প্রান্তের মানুষের জীবন-জীবিকা উঠে এসেছে। সুন্দরবন ও প্রকৃতি প্রেমী কবি হিমেল বরকত’র মৃত্যুতে লোক সংস্কৃতির বিশেষ করে সুন্দরবন অঞ্চলের লোক সংস্কৃতির অপূরণীয় ক্ষতি। যতদিন বাংলা সাহিত্য থাকবে ততদিন হিমেল থাকবে।
মঙ্গলবার (২২ নভেম্বর) সকাল ১১টায় মোংলা প্রেস ক্লাবে সর্বদলীয় সম্প্রীতি উদ্যোগ (পিএফজি) ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট মোংলার আয়োজনে কবি-গবেষক, অধ্যাপক ড. হিমেল বরকত’র দ্বিতীয় মৃত্য বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণানুষ্ঠানে বক্তারা একথা বলেন।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহবায়ক মো. নূর আলম শেখ’র সভাপতিত্ব অনুষ্ঠিত স্মরণানুষ্ঠানে প্রধান অতিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মোংলা উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহীম হোসেন।
স্মরণনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, মোংলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি মনিরুল হায়দার ইকবাল, রুদ্র স্মৃতি সংসদের সভাপতি সাংবাদিক সুমেল সারাফাত, দি হাঙ্গার প্রোজেক্ট বাংলাদেশের প্রশিক্ষণ বিভাগের প্রধান তুহিন আফসারি, কবি হিমেল’র শৈশবের বন্ধু জানে আলম বাবু, পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান মানিক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) নেতা সাংবাদিক হাছিব সরদার প্রমূখ।
কবি হিমেল বরকতের বড় ভাই প্রয়াত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। হিমেল বরকত ১৯৯৪ সালে মোংলার সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৯৬ সালে ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং পরবর্তী সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স-মাস্টার্স ও ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা সিটি কলেজে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে ২০০৫ সালে হিমেল বরকতের কর্মজীবন শুরু হয়। ২০০৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং ২০১৮ সালের ৫ জুন অধ্যাপক হন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এখানেই তিনি কর্মরত ছিলেন।
হিমেল বরকতের প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো, চোখে চৌদিকে (২০০১), দশ মাতৃক দৃশ্যাবলি (২০১৪), গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রান্তস্বর ব্রাত্যভাবনা (২০১৭), সাহিত্য সমালোচক বুদ্ধদেব বসু গবেষণা গ্রন্থ (২০১৩), ছড়ায় ছড়ায় প্রকৃতির বিস্ময়, ছোট গল্প আয়না এবং পেনসিল ও রাবারের গল্প ইত্যাদি।
হিমেল বরকত সম্পাদিত গ্রন্থগুলো হলো রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ রচনাবলী (২০০৫), কবি ত্রিদিব দস্তিদারের কবিতা সমগ্র (২০০৫), চন্দ্রাবতীর রামায়ণ ও প্রাসঙ্গিক পাঠ (২০১২), রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০১২), বাংলাদেশের আদিবাসী কাব্যসংগ্রহ (২০১৩), রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ স্মারকগ্রন্থ (২০১৫) ও রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর প্রেমের কবিতা নিয়ে অনুকাব্য। এ ছাড়া অপ্রকাশিত রয়েছে হিমেলের বেশ কিছু কবিতার বই ও গান।
কবি ও অধ্যাপক হিমেল বরকত ১৯৭৭ সালের ২৭ জুলাই বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ডা. শেখ ওয়ালিউল্লাহ পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক। মা সিরিয়া বেগম ছিলেন একজন গৃহিণী। দশ ভাই-বোনের মধ্যে ড. হিমেল বরকত সবার ছোট। সবার বড় ছিলেন প্রয়াত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। হিমেল বরকত ২০০৬ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারই সহপাঠী খাদিজা পারভীন পপির সঙ্গে। তাদের একমাত্র সন্তানের নাম অতন্দ্রিলা।
ভাই রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো কবি ও শিক্ষক হিমেল বরকতও খুব অল্প বয়সেই আকাশ হয়ে গেলেন। গত ২১ নভেম্বর বেলা ১১টার দিকে অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নেয়ার সময় হার্ট অ্যাটাক হয় হিমেল বরকতের। পরে তাকে ভর্তি করা হয় রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে। সেখানে আরো দুইবার হার্ট অ্যাটাক হয় তার। পরদিন ২২ নভেম্বর ভোর ৪টায় সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান তিনি।