নিজস্ব প্রতিবেদকঃ রাজধানীর গুলশান-বনানী লেক ভরাট করে অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি নিয়ে বস্তি ঘর ভাড়া দিয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব বস্তি ঘরে বিভিন্ন এলাকা থেকে অপহৃত ব্যক্তিদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়, মদ, গাঁজা, ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসা ও সেবন করা হচ্ছে। আর মাদকাসক্তদের মাদক সেবনের কারণে মাঝে মধ্যেই অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরণের অঘটন ঘটছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহাখালী জি.পি.জ-২৯ নম্বরের বাসিন্দা আওয়ামী লীগ নেতা নুর আলম নুরী ও মাহবুবুর রহমান টিবি গেট গাউসুল আজম মসজিদের উত্তর পশ্চিম পাশের লেক ভরাট করে প্রায় ৩ শতাধিক ঘর নির্মাণ করে অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ ও পানি নিয়ে ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করছেন। এসব ঘটনার বিভিন্ন মাদক ব্যবসায়ীসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকার কালো তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীদের ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। আর তারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হেরোইন, ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক এনে বিক্রি করছে এ বস্তিতে। আবার অনেক মাদক ব্যবসায়ীরা এই বস্তিতে প্রকাশ্যে মাদক সেবন করছে।
এ ব্যাপারে নুরে আলম নুরীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে, তিনি জানান আমাদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে ঘর তৈরী করে ভাড়া দিয়ে আসছি। আর কিছু পরিত্যক্ত জায়গা টিএন্ডটি (বিটিসিএল) এর। সেখানে আমরা গরু ছাগল পালন করছি।
অনেকেই অভিযোগ করে বলেছেন, বস্তির ঘরগুলোতে অবৈধ বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ। আবার সন্ত্রাসীরা এলাকায় প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল ও নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে এলাকায় প্রকাশ্যে চাঁদা আদায় করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। চাঁদাবাজি, স্থানীয়দের হয়রানী ও ব্লাক-মেইলিং করার অভিযোগে পুলিশ নুরীকে আটক করলেও অজ্ঞাতকারণে তিনি ছাড়া পান বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, গুলশান-বনানী কড়াইল লেক ও জায়গা দখল নেওয়া হয় মাদক ব্যবসাসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য। আর বস্তি ঘরগুলো মাদক, অস্ত্র, বিস্ফোরসহ নানা অবৈধ ব্যবসা নিরাপদে করার জন্যই জায়গাটি বেশ সুবিধার। এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান হলে বিক্রেতারা ছোট ছোট বস্তিঘরে লুকিয়ে পড়ে। বস্তির বাসিন্দারা বলছেন, এখানে ইয়াবা ছাড়াও গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ মাদক এখানে খুব সহজেই মেলে। তবে ইয়াবার ব্যবসা এখন বেশ রমরমা। স্থানীয়রা জানান, আশির দশক থেকেই কড়াইল বস্তি সন্ত্রাসীদের স্বর্গরাজ্য এবং রাজধানীর অন্যতম মাদক স্পট হিসেবে সুপরিচিত।
মহাখালীর একজন ব্যবসায়ী জানান, রাজধানীতে অন্যায়-অপরাধ, দখল-খুন-চাঁদাবাজির সাথে জড়িত মহাখালী কড়াইল বস্তির সন্ত্রাসীরা। এখানে অবস্থান করছে অবৈধ দখলদার, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজরা।
এ বস্তি উচ্ছেদে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই বস্তিটি বহাল তবিয়তে আছে। মাদক ও অবৈধ অস্ত্রের মজুদ এবং সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল এই কড়াইল বস্তি। দখল নিয়েও বহুবার প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। একমাস আগে সংঘর্ষে নিহত হন যুবলীগ নেতা আলামিন। কড়াইল বস্তিতে অভিযান চালিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আগেও প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছেন, এখনো হচ্ছেন।
অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর গা ঘেঁষে দিনে-দিনে বেড়ে ওঠা এই কড়াইল বস্তিতে কেউ জমির মালিক, কেউ বাড়ির মালিক কেউবা ভাড়াটিয়া, কেউ আবার হাওয়ার উপরেই বসবাস করছেন। কিন্ত কেউই প্রকৃত মালিক নন। আসল মালিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল, গণপূর্ত এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। কিন্ত তারপরও এখানকার জমির মালিকের অভাব নেই। সেই জমি আবার বিক্রিও হচ্ছে। কখনও জমি কখনও রেডিমেড বাড়ি কখনও জমি বাড়ি এক সাথে বিক্রি হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে এসব জমি আবার কয়েক হাত বদল হয়। হাত যত বদল হয়, ততই বাড়তে থাকে জমির দাম। অনেকে আবার আবাসন ব্যবসা শুরু করেছে সরকারি জমির উপর। গড়ে ওঠা বিভিন্ন ক্লাব ও রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের প্রতিনিধিদের দিতে হয় এককালীন টাকা।
পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সাথে ওই বস্তির সন্ত্রাসীদের রয়েছে সুসম্পর্ক। ফলে তাদের বিরুদ্ধে নেই কোন জোরালো অভিযান। রাতের বেলায় টহল পুলিশ বস্তি এবং পার্শ্ববর্তী লেকের পাড়ে সন্ত্রাসীদের অবস্থানের খবর পেয়েও কোনো অভিযান চালায় না। ছোট-বড় মিলিয়ে কমপক্ষে ২৫টি গ্রুপের সদস্যরা কড়াইল বস্তি এবং পার্শ্ববর্তী লেক এলাকায় অবস্থান করে। বিভিন্ন স্থানে বসে বৈঠক।
এসব বৈঠকেই ছিনতাই, ডাকাতি, গাড়ি চুরি এবং বাসাবাড়িতে চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা হয়। পরিকল্পনা শেষে তারা বেরিয়ে পড়ে। সন্ত্রাসীরা ভাট-বাটোয়ারা নিয়ে খুনাখুনির ঘটনাও ঘটে। প্রায়ই গুলশান লেকে পাওয়া যায় অজ্ঞাত নামা ব্যক্তির লাশ। এ ব্যাপারে উর্ধ্বতন একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, কড়াইল বস্তি উচ্ছেদে অনেকবার চেষ্টা করা হলেও প্রভাবশালীদের বাধার কারণে উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না।