বিশেষ সংবাদদাতা:মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব মনে করিয়ে দিতে চান পশ্চিমবাংলার রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। সোমবার এ ভাবেই ফের তিনি তোপ দাগলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, এ কথাও স্পষ্ট বললেন, ‘সংবিধানে রাজ্যপালের দায়িত্ব কী, তা পরিষ্কার লেখা রয়েছে। আমি তা জানি। আর এ কথাও সবাইকে জানিয়ে দিতে চাই, আমি কারও রবার স্ট্যাম্প নই। সেইসঙ্গে তাঁর দায়িত্বও মনে করিয়ে দিতে চাই।’
অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রীর পত্রবোমার পরেও যে তিনি চুপ করবেন না, সে কথা সোমবার তিনি যেন স্পষ্টই বুঝিয়ে দিলেন। দু’দিন আগেই রাজ্যপালের ধারাবাহিক মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী ফের আটপাতার চিঠি পাঠান। চিঠি না বলে সেটিকে পত্রবোমাই বলা যায়। রাজ্যপাল যে সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন, তাঁকে কার্যত সে কথা মুখ্যমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন। বলা বাহুল্য, বিষয়টিকে যে রাজ্যপাল হাল্কা ভাবে নেননি, তা এদিন তাঁর মন্তব্যেই পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি চাঁছাছোলা ভাষায় মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যের সরকারের যে ভাবে সমালোচনা এদিন করেছেন, তা মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে একটা চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
এদিন মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করে রাজ্যপাল বলেছেন, ‘এখন সন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে বাংলা। কারণ, ক্ষমতার অলিন্দে বসে রয়েছে হার্মাদরা। ক্ষমতার অলিন্দে হার্মাদদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করুন।’ বলা বাহুল্য, পশ্চিমবাংলার ইতিহাসে অতীতে অন্য কোনও রাজ্যপালের মুখে এমন ভাষা কখনও শোনা গিয়েছে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান রাজনৈতিক মহল। রাজ্যপালের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী নিজেই আইন ভাঙছেন। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীকে যে বিষয়েই প্রশ্ন করি না কেন, তা বাণিজ্য সম্মেলনই হোক বা গণবণ্টন, কোনও প্রশ্নেরই জবাব তিনি দেন না। এ থেকেই বোঝা যায় অবস্থাটা। এ আমরা কোথায় যাচ্ছি! আসলে মুখ্যমন্ত্রী চান না, মানুষ সব তথ্য জানুক। সেইজন্যই আমার প্রশ্নগুলিকে তিনি উপেক্ষা করে যান।’
এদিন রাজভবন থেকে তিনি সরাসরি বক্তব্য পেশ করেন। সরকার ও পুলিশের ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘এই রাজ্যে পুলিশ পুরোপুরি শাসক দলের অনুগত। আর পুলিশের ওপর যে রাজ্য নির্ভরশীল, তা এখন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। কারণ, পুলিশ নিজের কোনও ভূমিকাই পালন করতে পারছে না। তারা সবসময় রাজ্যের বিরোধী দলগুলির নেতা, কর্মী–সমর্থকদের দরজায় কড়া নাড়ছে। রাজ্যজুড়ে নজরদারি চলছে। বাংলায় যা চলছে, তা নৈরাজ্যই। গণতন্ত্র আর পুলিশ একসঙ্গে চলতে পারে না।’ এদিন তিনি সরাসরি রাজ্য পুলিশের ডিজিরও সমালোচনা করেন। বলেন, ‘রাজ্যের ডিজি কী করে এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারেন, তা বিশ্বাস করা যায় না।’
রাজ্যপালের এমন আক্রমণের পর রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায় বাংলার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে। তবে বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনিক স্তর থেকে কেউ মুখ খোলেননি। তবে মুখ খুলেছেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। তিনিও রীতিমতো কড়া সুরে বলেছেন, ‘রাজ্যপাল সংবিধান ভালো করে পড়েননি। তিনি সংবিধানের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।’ অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী ব্যয় সামলাতে নবান্নের কাছে অতিরিক্ত খরচ চেয়েছিল রাজভবন। জানা গিয়েছে, এ নিয়ে ৫৩.৪ লক্ষ টাকা চেয়ে রাজভবন থেকে রাজ্যপালের সচিব সতীশ তিওয়ারি চিঠি দেন রাজ্য সরকারকে। কিন্তু রাজ্য সরকার জানিয়ে দেয়, ওই অর্থ দেওয়া সম্ভব নয়। রাজ্য সরকারের তরফে স্বরাষ্ট্র সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় পাল্টা চিঠিতে জানান, কোভিড অতিমারীর জেরে এখন রাজকোষে অতিরিক্ত অর্থ নেই। তাই রাজ্য সরকার ব্যয় সঙ্কোচের নীতি অনুসরণ করছে।
কিন্তু বিষয়টির পেছনে নবান্ন ও রাজভবনের বিরোধ রয়েছে কিনা, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে। অনেকে বলছেন, পুজো কমিটিগুলিকে সাহায্য করতে রাজ্য সরকার এই করোনা পরিস্থিতিতেও ২০০ কোটি টাকা খরচ করছে। গত বছর কমিটিগুলিকে যত টাকা দেওয়া হয়েছিল, এ বছর সেই টাকার পরিমাণ দ্বিগুণ করে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের প্রশ্ন, রাজকোষে টান পড়লে সেই টাকা কেন বাতিল করা বা কমানো হল না? যদিও রাজ্য সরকারের জবাবের পর এখনও পর্যন্ত রাজভবনের তরফে বিষয়টি নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করা হয়নি।