কলকাতা সংবাদদাতা: ক’দিন আগেই বিজেপি ছেড়ে মুকুল রায় তৃণমূলে যোগ দেন। তৃণমূলের সেই সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সে দিন সাংবাদিকদের সামনে স্বয়ং মমতা বলেছিলেন, ‘ঘরের ছেলে। ঘরেই ফিরল। মুকুলকে অনেক ধমকে চমকে এজেন্সির ভয় দেখিয়ে রেখেছিল। ওর শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তৃণমূলে ফিরে মানসিক শান্তি পেল।’
সেই মমতাই বৃহস্পতিবার ‘বিজেপির মুকুল রায়’ বলে সাংবাদিকদের কাছে উল্লেখ করলেন। পিএসি চেয়ারম্যান কে হতে পারেন, তা নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, সেই প্রসঙ্গেই বলতে গিয়ে তিনি এদিন বলেন, ‘পিএসি–তে যে কোনও বিধায়কই মনোনয়ন জমা দিতে পারেন। মুকুল রায় বিজেপির বিধায়ক। পার্টি মেম্বারও। তাঁকে কার্শিয়াংয়ের বিনয় তামাংরা সমর্থন করেছেন। আমরাও সমর্থন করব। তার পর পিএসি–র চেয়ারম্যান পদের জন্য যদি ভোটাভুটি হয়, হলে হবে। দেখব কার কত শক্তি আছে? আমরাই জিতব।’
মমতার এমন মন্তব্যে রাজনৈতিক মহলে অনেকেই ঘনিষ্ঠ মহলে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তবে প্রকাশ্যে কেউই এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। কারণ, তাদের ধারণা, এদিন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, পিএসি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগের বিধানসভায় যে রাজনৈতিক কৌশল নিয়েছিলেন, এবারও একই পথে চলছেন। আগের বিধানসভায় মানস ভুঁইয়াকে পিএসি–র চেয়ারম্যান করা হয়েছিল কংগ্রেস বিধায়ক হিসেবে। কিন্তু তিনি তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। আবদুল মান্নান বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ জানালেও তা কাজে আসেনি। পরে মানস ভুঁইয়া রাজ্যসভার সাংসদ হয়ে গেলে তাঁর জায়গায় আসেন শঙ্কর সিং। খাতায় কলমে তিনি কংগ্রেস বিধায়ক হলেও ততদিনে তিনি তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। যেহেতু দুই বিধায়ক সেই সময় নিজে থেকে বিধায়ক পদে ইস্তফা দেননি, তাই দুটি ক্ষেত্রেই কংগ্রেসের আপত্তি ধোপে টেকেনি। রাজনৈতিক মহলের মতে, এবারও একই কৌশল নিতে চলেছেন মমতা। অন্তত তাঁর এদিনের বক্তব্য থেকে সে কথাই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।
এখন দেখার বিষয়টি নিয়ে বিজেপি কত দূর এগোতে পারে? যদিও বুধবারই তারা জানিয়েছিল, তারা মুকুল রায়কে পিএসি–র চেয়ারম্যান পদে মেনে নেবে না। তবু যদি কৌশলে তাঁকে চেয়ারম্যান করা হয়, তা হলে তাদের কোনও বিধায়কই পিএসি–তে থাকবেন না। অর্থাৎ, তৃণমূল বিধায়করাই শুধু পিএসি–তে থাকবেন।
উল্লেখ্য, অতীতে পশ্চিমবাংলার বিধানসভায় বরাবরই বিরোধী দলের বিধায়ককে চেয়ারম্যান করা হয়ে থাকে। ফলে সরকারের আয়–ব্যয়ের ওপর পিএসি আতস কাচ রেখে নজর রাখে। সরকারের বিভিন্ন আয় বা খরচে অসঙ্গতি দেখলে প্রশ্ন তোলে সেই পিএসি–ই। অনেক সময় সরকারকে জবাবদিহি করতে হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অনেক ভাবনাচিন্তা করে আগের বিধানসভা থেকেই পিএসি চেয়ারম্যান এমন ব্যক্তিকে করা হচ্ছে, যিনি তৃণমূলে যোগ দিলেও বিরোধী বিধায়ক হিসেবেই থেকেছেন। ফলে সরকারের আয় বা ব্যয় নিয়ে কোনও চেয়ারম্যানই কোনও প্রশ্ন তোলেননি। সরকারকেও বিতর্কে বা অস্বস্তিতে পড়তে হয়নি। এবারও যাতে সেই পথ অনুসরণ করা যায়, সেইজন্য মুকুল রায়কে পিএসি–র চেয়ারম্যান পদে নিয়ে আসতে চাইছে তৃণমূল।
যদিও এদিন মমতা জানিয়েছেন, পিএসি–র চেয়ারম্যান কে হবেন, সে বিষয়টি পুরোটাই স্পিকারের ব্যাপার। কিন্তু স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় কার্যত নিজের দল তৃণমূলের পথই মেনে চলেন বলে বিজেপি নেতাদের অভিমত। কারণ আগের বিধানসভায় পিএসি চেয়ারম্যান পদ নিয়ে কংগ্রেসের আপত্তিকে তিনি গুরুত্ব দেননি। তৃণমূল ছাড়লেও কংগ্রেসের দাবি মেনে মানস ভুঁইয়া বা শঙ্কর সিংয়ের বিধায়ক পদ খারিজ করেননি। এবারও পিএসি–বিতর্কে তিনি ভিন্ন পথ অনুসরণ করবেন না বলেই মনে করছেন বিজেপি বিধায়করা।
তাই বৃহস্পতিবার পিএসি–তে মনোনয়ন দেওয়া বিধায়কদের নিয়ে স্ক্রুটিনি পর্ব শেষ হওয়ার আগেই মুকুল রায়কে নিয়ে চিঠি দেয় বিজেপি। কিন্তু বিজেপির দাবি খারিজ করে মুকুলের মনোনয়নকে বৈধতা দেয় বিধানসভার সচিবালয়। ফলে তৃণমূল শিবির মনে করছে, মুকুল রায়ের পিএসি চেয়ারম্যান হওয়া এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। কারণ, সংসদীয় বা পরিষদীয় রাজনীতিতে স্পিকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
তবে কংগ্রেস নেতা তথা আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ এদিন পরিষ্কার বলেছেন, ‘২০১৬ সালে একই ভাবে মানস ভুঁইয়াকে চেয়ারম্যান করা হয়েছিল। এবারও স্পিকার নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে মুকুল রায়কেই চেয়ারম্যান করবেন। নীতিগত ভাবে এটা ঠিক কাজ নয়।’ আর এই প্রসঙ্গে বিজেপির পরিষদীয় দলের মুখ্য সচেতক মনোজ টিগ্গা বলেছেন, ‘এমন সিদ্ধান্ত স্পিকার নিলে আমরা পরিষদীয় দলে আলোচনা করেই পরবর্তী পদক্ষেপ করব।’