প্রত্যয় ডেস্ক রিপোর্ট:অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটি গুরুত্বপূর্ন শাখা হলো অটোমোবাইল সেফটি টেকনোলোজি। ১৮৮৬ সালে মোটরগাড়ি আবিষ্কারের পর ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়, সেই সাথে যেই বিষয়গুলো নিয়ে মানুষ ভাবতে শুরু করে, তার মধ্যে অন্যতম হল নিরাপত্তা, বিশেষ করে সড়ক দূর্ঘটনার ক্ষেত্রে। মোটরগাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে দুর্ঘটনাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, যার ফলে মৃত্যুর হার বেড়ে যায়, কারও কারও মৃত্যু না হলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। বিশ্বের উন্নত দেশের মত বাংলাদেশেও সড়ক দূর্ঘটনা একটি মৌলিক সমস্যা। প্রশস্ত রাস্তা, প্রশিক্ষিত চালক, ধীর গতিতে গাড়ী চালানোর পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে পারে, তা হল প্রযুক্তি। নিরাপত্তা প্রযুক্তি বা সেফটি টেকনোলজি Advanced driver assistance systems বা ADAS এর অন্তর্ভূক্ত একটি বিষয় যার পরিধি অত্যন্ত বিস্তর। ভেহিকেল সেফটি টেকনোলোজির উদ্ভাবন ও এর উন্নয়নের কাজ শুরু হয় উনবিংশ শতাব্দীতেই যখন গাড়ি আবিষ্কৃত হয়।
অটোমোবাইল সেফটির প্রয়োজনীয়তা
বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বের মোট গাড়ির ৮০% গাড়িতেই সেফটি স্ট্যান্ডার্ড মানা হয়না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত দেশেও প্রতি ৮ মিনিটে একজন পথচারী সড়ক দূর্ঘটনার শিকার হন। সাম্প্রতিককালে রাস্তার উন্নয়ন সাধন এবং গাড়ির নকশায় পরিবর্তন আনার ফলে সড়ক দূর্ঘটনায় হতাহত ও মৃত্যুর হার তুলনামুলক কমা সত্ত্বেও এখনো “সড়ক দূর্ঘটনা” হতাহতের ফলে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ।
২০০৪ সালে সড়ক দূর্ঘটনায় সারা বিশ্বে প্রায় ১২ লক্ষ মানুষ নিহত হন, যার মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই ছিলেন পথচারী। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হাইওয়ে ট্রাফিক সেফটি এডমিনিস্ট্রেশন বা NHTSA র তথ্যানুযায়ী, ২০০১ সালে সারা বিশ্বে প্রায় ১ কোটিরও বেশি সড়ক দূর্ঘটনা সংঘটিত হয়, যার মধ্যে ৯৫%ই ছিলো ছোট গাড়ী অথবা ছোট ট্রাকের সংঘর্ষ। ইউরোপিয়ান ট্রাফিক সেফটি কাউন্সিল জানায়, ইউরোপে বছরে প্রায় ৪২০০০ মানুষ নিহত হয় শুধু মাত্র সড়ক দূর্ঘটনায়, যার প্রায় ৯০% দূর্ঘটনাই ঘটে গাড়ির চালকের গাফিলতির কারনে।
NHTSA গবেষনা করে সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছে যে, সারা বিশ্বে সংঘটিত সড়ক দূর্ঘটনার মধ্যে প্রায় ৮০-৯০% দূর্ঘটনাই প্রতিহত করা যেত চালককে মাত্র এক সেকেন্ড আগে সাবধান করে দেওয়া যেত।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, গাড়ী উদ্ভাবন হওয়ার পর থেকেই সেফটি টেকনোলোজির উন্নয়নেও প্রকৌশলীরা কাজ করে যাচ্ছেন। মোটরগাড়ি আবিষ্কারের পূর্বে ঘোড়াচালিত গাড়ী ব্যবহৃত হতো, তা আমরা সকলেই জানি। সেই সময়ে ঘোড়া কে নিয়ন্ত্রন করতো মানুষ। উল্লেখ্য, প্রাণী হিসেবে ঘোড়ার কিছু হলেও বুদ্ধি খাটানোর ক্ষমতা ছিলো এবং এখনো আছে। তখনকার দিনে দেখা যেতো, মানুষ কোনো কারনে বা তন্দ্রাচ্ছন্ন হওয়ার ফলে ঘোড়াকে সঠিকভাবে যদি নিয়ন্ত্রন না করতে পারতো, সেক্ষেত্রে কখনো কখনো ঘোড়া নিজের নিয়ন্ত্রন নিজের উপর নিয়ে নিতো এবং নিজে বুঝে বুঝে এগিয়ে যেতো। বুদ্ধি খাটিয়ে তারা অন্য ঘর বা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়তোনা।
পরবর্তী সময়ে, মোটরগাড়ি আবিষ্কার হওয়ার পর অনেকেই ঘোড়ার গাড়ী ছেড়ে মোটরগাড়ি ব্যবহার করতে শুরু করে। যেহেতু মোটরগাড়ির বুদ্ধি ছিলোনা, সেকারনে মোটরগাড়ির সবকিছু পুরোপুরি নির্ভর করতো মানুষ কিভাবে তাকে পরিচালনা করছে তার উপর। একারনেই মোটরগাড়ির উদ্ভাবক এবং গবেষকেরা উপলব্ধি করেন, মোটরগাড়ির নিয়ন্ত্রন না করতে পারলে যেকোনো দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।
Occupant safety বা যাত্রীর সেফটি
Occupant Safety বা যাত্রির সেফটি একটি গাড়ির সেফটি সিস্টেমের মধ্যে গুরুত্বপূর্ন একটি অংশ। মোটরগাড়ি উদ্ভাবনের পর শুরুর দিকে সেফটি সিস্টেম বলতে ছিলো একেবারে ব্যাসিক লেভেলের কিছু সিস্টেম, যেমন – সাধারন ব্রেক, কলাপ্সিবল স্টিয়ারিং হুইল, এনার্জি এবসর্বিং স্টিয়ারিং কলাম ইত্যাদি। পরবর্তীতে সিটবেল্ট উদ্ভাবিত হয় যা যাত্রী বা চালককে আসনে সঠিকভাবে বসিয়ে রাখতে সক্ষম হয় যা নড়াচড়া বা manuever থেকে যাত্রীকে রক্ষা করে। বর্তমানে, Occupant Safety নিশ্চিত করতে যেসকল প্রযুক্তি জনপ্রিয়তা পেয়েছে, সেগুলো হলো বিভিন্ন ধরনের এয়ারব্যাগ, সিটবেল্ট, Crash optimized body structure, সিট বেল্ট প্রিটেনশনার ইত্যাদি।
যেসকল ডিজাইনাররা এবং প্রকৌশলীরা গাড়ী ডিজাইন ও নির্মান করেন, তারা বিভিন্ন দূর্ঘটনা সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত যাচাই করে উপলব্ধি করেছেন যে, যদি এমন কোনো সিস্টেম তৈরি করা যায় যা চালককে দূর্ঘটনার পূর্বে বুঝে উঠার সুযোগ করে দিবে, তাহলে বেশিরভাগ সড়ক দূর্ঘটনাই প্রতিহত করা সম্ভব হতো। গত ২০ বছরে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে এয়ারব্যাগ, সিটবেল্ট, ব্রেক ইত্যাদি নির্মান করা হচ্ছে যা জীবন বাঁচাতে এবং হতাহতের সংখ্যা কমাতে সক্ষম হচ্ছে। এছাড়া, হেডলাইট, টায়ার, উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারেরও উন্নয়ন সাধনে কাজ করা হচ্ছে যা একজন চালককে সড়ক দূর্ঘটনা থেকে গাড়িকে বাঁচাতে সহযোগিতা করবে। এচাহড়া, এন্টি লক ব্রেকিং সিস্টেম, স্টেবিলিটি কন্ট্রোল সিস্টেম, ইত্যাদি উদ্ভাবিত হয়েছে যা গাড়িকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রন করে দূর্ঘটনা এড়াতে চালককে সহযোগিতা করছে।
একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীরা বলেন যদি গাড়ির চারপাশে ইলেক্ট্রনিক শিল্ড দ্বারা বেস্টনী দেওয়া যেত, তাহলে সড়ক দূর্ঘটনাকে জাদুঘরে পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভব এবং আশা রাখা যায় ভবিষ্যতে এটি সম্ভব হবে। কেন সম্ভব হবে? কেননা বর্তমানে X by wire system, brake by wire system এর উদ্ভাবন হয়েছে যা গাড়িতে ইলেক্ট্রনিক শিল্ড ব্যবহার করার আভাস দিচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন অটোমোবাইল কোম্পানি এধরনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়নে কাজ করছেন।
Pedestrian Safety বা পথচারীর সেফটি
বর্তমানে বেশিরভাগ সেফটি সিস্টেমগুলো যাত্রীর সেফটি নিশ্চিতকরনে কাজ করে। এখন, বিভিন্ন কোম্পানি যাত্রীর সেফটির পাশাপাশি একটি দূর্ঘটনা ঘটার পর আশেপাশের পথচারীর সেফটি নিশ্চিতকরনে কাজ করতে সক্ষম হবে এমন সেফটি সিস্টেম নির্মানে কাজ করছে। NHTSA এর তথ্যানুযায়ী সড়ক দূর্ঘটনায় হতাহত পথচারীর ১৮% হতাহতের ঘটনা ঘটে মধ্যরাত থেকে ভোর ৬ টার মধ্যে এবং ৪৫% ঘটে থাকে সন্ধ্যা ৬ টা থেকে মধ্যরাতের মধ্যে। প্রকৌশলীরা কাজ করছেন এমন এক প্রযুক্তি নিয়ে যা গাড়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে পথচারীর অস্তিত্ব বুঝতে পেরে চালককে সতর্ক করে দেবে।
উপরের তথ্যানুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে মোট পথচারী হতাহতের সংখ্যার প্রায় ৬৪% হতাহতের ঘটনা ঘটে থাকে সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ভোর ৬ টার মধ্যে। একারনে গাড়ী নির্মান প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে অনেক গাড়িতেই যোগ করছে Night vision system যা স্বল্প আলোতেও পথচারী রাস্তায় থাকলে তা সহজেই চালক দেখতে পাবেন। এছাড়া বেশিরভাগ সড়ক দূর্ঘটনা ঘটে মহাসড়কে। সেকারনে Night vision এবং pedestrian detection system মহাসড়কে পথচারী হতাহতের সংখ্যা অনেকটা কমিয়ে আনতে পারবে বলে আশা করা যায়। অবশ্য এতসব প্রযুক্তির পরেও কিছু কিছু সময় থাকে যখন পথচারী এবং গাড়ির সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়না। একারনে বাইরে স্থাপন করা যায় এমন এয়ারব্যাগ তৈরীর চেষ্টা করছেন প্রকৌশলীরা যা deploy হলে পথচারীর হতাহতের সংখ্যা কমানো সম্ভব হবে।
লেখক পরিচিতি –
মেহরাব মাসাঈদ হাবিব পেশায় প্রকৌশলী। লেখাপড়া করেছেন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি – বাংলাদেশ এ তড়িৎ কৌশল বিভাগে। তিনি বাংলা অটোমোবাইল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়া, অটোমোবাইল সেফটি রিলেটেড একটি উদ্যেগের সাথে জড়িত আছেন যা শীঘ্রই বাণিজ্যিকভাবে কাজ শুরু করবে। তার রচিত বই “অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং আদি অন্ত” গত একবছর ধরে রকমারির প্রযুক্তি সংক্রান্ত বই তালিকায় ১ নাম্বার বেস্টসেলারের স্থান ধরে রেখেছে। বইটি প্রায় ৫টি মহাদেশের বাংলাভাষী মানুষের কাছে এর মধ্যেই পৌছে গিয়েছে।