নিজস্ব প্রতিবেদক: গভীর রাত, সবাই ঘুমিয়ে। মনে হয়, কেবল আমিই জেগে। অসহনীয় না হলেও অস্বস্তিকর এক যন্ত্রণা মাঝে মাঝে ভর করে আমার শরীরে। বিছানায় শুধু এপাশ-ওপাশ। কারণ একটাই– শরীরে এখনও প্রায় একশ’র মতো গ্রেনেডের স্প্লিন্টার গেঁথে আছে। হাঁটুর নিচেই আছে ১৫-২০টা, নাভির নিচে আরও কয়েকটা। বাকিটা অন্যখানে।
এসব স্প্লিন্টার মাঝে মাঝে জানান দিলে ঘুম আসে না, জেগে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। বিশেষ করে শীতকালে এ রকমের অস্বস্তিতে পড়তে হয় বেশি। এ সময় মাঝে মাঝে হাঁটুতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তখন খাট থেকে নেমে হাঁটাহাঁটি করি, সঙ্গে হালকা ব্যায়াম। এভাবে রক্ত চলাচল শুরু হবার পর আবার বিছানায় আশ্রয় নিই। তারপর ঘুম।
এখন প্রশ্ন হল, আমার শরীরে গ্রেনেডের এতগুলো স্প্লিন্টার ঢুকল কীভাবে? পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আজ একুশে আগস্ট। ২০০৪ সালের ভয়াবহ সেই একুশে আগস্ট। তখনকার প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বঙ্গবন্ধু এভিনিঊয়ের জনসভা কভার করতে গিয়ে আমার শরীরেও কখন যেন ঢুকে পড়ে এসব স্প্লিন্টার। (ক্ষমতায় তখন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকার। )
আমি চ্যানেল আইয়ের রিপোর্টার হিসেবেই গিয়েছিলাম ঐ জনসভায়।.তখন শেষ বিকেল। নেত্রীর বক্তব্যও প্রায় শেষ হবার পথে। আমি তখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের ট্রাক-মঞ্চের একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে, হাতে মাইক্রোফোন, নেত্রীর বক্তব্য রেকর্ড করছি। হঠাৎ ঢিল পড়ার মতো শব্দ হল, ট্রাকের পেছনের ঢাকনায়। এরপর বিকট এক আওয়াজ! চারদিকে মানুষের হুড়োহুড়ি!
আমিও পড়ে গেলাম মাটিতে। তবে পদদলিত হবার ভয়ে ঢুকে গেলাম ট্রাক-মঞ্চের নিচে, যার ওপর দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। ট্রাকের চাকা ধরে শুয়ে রইলাম। মোবাইল ফোন তখন কোমরে ঝুলানো, চামড়ার খাপে। ফোনটা বের করে রিং দিলাম চ্যানেল আইয়ের তখনকার হেড অফ নিউজ আলমগীর ভাইকে (এখন প্রয়াত)। বললাম,“ভাই, আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা হামলা হয়েছে, আগে স্ক্রল দেন।”
ফোনের ওপাশ থেকে উনি চিৎকার করে বললেন, “কী হয়েছে?”
আমি চিৎকার করে আবারও বলি, “শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা মারা হচ্ছে।” (আশপাশে অনেক চিৎকার-চেঁচামেচি থাকায় আমিও উচ্চস্বরে কথা বলছিলাম।)
তারপর আলমগীর ভাই জানতে চাইলেন, “তোমার কী অবস্থা?”
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, আমার শরীর থেকে বইছে রক্তধারা। গলগল করে রক্ত ঝরে ভিজে যাচ্ছে আমার আকাশি রঙের জিন্স প্যান্ট আর ঘিয়ে রঙা টি-শার্ট। প্রচণ্ড ভয় পেলাম। কোনো রকমে আলমগীর ভাইকে বললাম, “আমার অবস্থা ভালো না’!
তারপর ফোনটা কেটে দিলাম।
সেই সময় আমার মনে হল, বাঁচতে হলে ট্রাকের নিচ থেকে বের হতেই হবে, যে করেই হোক। তখনও চলছে বোমা নিক্ষেপ। তার মধ্যে কোনো রকমে বের হয়ে আমি রমনা ভবনের ভেতরে যাবার চেষ্টা করলাম। তখন রমনা ভবনের গলির খুব কাছাকাছি। হঠাৎ একটা টিয়ার সেল এসে পড়ল আমার সামনে।
টিয়ার সেল আগেও খেয়েছি, ছাত্রলীগ করার কারণে। তাই জানি, টিয়ার সেলের প্রথম ধোঁয়া কতটা ভয়াবহ! ভয়ঙ্কর সেই ধোঁয়া থেকে বাঁচতে হাত দিয়ে মুখ ঢাকলাম, হঠাৎ বমি বমি ভাব। প্রাণপণ চেষ্টায় তা ঠেকালাম। কেননা, প্রচণ্ড রক্তক্ষরণের সময় বমি হলে হয়তো আর বাঁচব না!
টিয়ার সেল থেকে রক্ষা পেতে আবারও ফিরে এলাম সেই ট্রাকের নিচেই। চিত হয়ে শুয়ে আছি। হঠাৎ দেখি, দু’পায়ের তলায় আস্ত একটা গ্রেনেড! যখন তখন ফেটে যেতে পারে এটি। (পরে তা অবিস্ফোরিত অবস্থায় পাওয়া যায়।)
বুঝলাম, বোমা নয়, গ্রেনেড হামলা হয়েছে। ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়তো শুরু করলাম। দুঃস্বপ্নের মতো কেবল চোখে ভেসে উঠল, “গাজীপুরে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে আমাদের গ্রামের বাড়ির বাইরে আমাকে খাটিয়ায় রাখা হয়েছে। সাদা কাফনে ঢেকে। মা অবিরাম বিলাপ করছেন। ছোট দু’ বোনের কান্না থামানোই যাচ্ছে না। পাড়া-প্রতিবেশিরাও হাজির আমাকে শেষ বিদায় জানাতে!”
এ রকম এক অবস্থায় মনের সব ভয় উড়ে গেল। প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় ট্রাকের নিচ থেকে আবার বের হলাম। তবে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলাম না এবার। পড়ে গেলাম মাটিতে। হাঁটুর নিচে স্প্লিন্টার ঢুকে যাওয়ায়। তারপর দু’হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গেলাম।
কীভাবে যে পথটুকু পাড়ি দিলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, মরি বা বাঁচি যা-ই হোক, রাস্তায় শুয়ে থাকি। এভাবে পথ চলতে চলতে বীভৎস কত কিছু যে দেখতে হল! চারদিকে মানুষের রক্ত! কারও হাত পড়ে আছে, কারও শরীরের মাংস খসে গেছে। আহতদের আহাজারি চারপাশে। শয়ে শয়ে জুতো পড়ে আছে। স্যান্ডেলের ছড়াছড়ি। বীভৎস সেই দৃশ্য মনে পড়লে এখনও আঁতকে উঠি!
এরই মধ্যে আমার এই বেঁচে থাকার লড়াইটা চোখে পড়েছে অক্ষত অনেক মানুষের। প্রথমে জনসভায় আসা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা আমাকে ধরলেন। তারপর তখনকার এনটিভির রিপোর্টার বায়েজিদ মিলকি ভাই ও ক্যামেরা পারসন তারেক আমাকে কোনো রকমে পীর ইয়ামেনী মার্কেটের সামনের রাস্তায় নিয়ে এলেন। সেখানে লোহা-লক্কড়বাহী এক ভ্যানে তুলে আমাকে নিয়ে আসা হল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
সেখানে পড়ে আছি আমি। মেঝেতে। মনে হল এখানে মৃত্যু অনিবার্য। ডাক্তার-নার্সেরদেখা নেই। শরীর থেকে রক্তের বন্যা বইছে। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছি।
মেঝেতে পড়ে থেকেই দেখছি, কত চেনা মুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহযোদ্ধারা রক্ত দেবার জন্য ছুটোছুটি করছেন। তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ত কত পরিচিত সাংবাদিক। শত চেষ্টা করেও কাউকে ডাকার মতো শক্তি পেলাম না।
একসময় এভাবে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখলাম, হামলায় নিহত একজনের মরদেহবাহী স্ট্রেচার নিয়ে যাওয়া হল আমার ওপর দিয়ে।
এক পর্যায়ে কানে এল, “খোকন কই খোকন কই” বলে চিৎকার। অনেক কষ্টে চোখ বড় করে দেখি, সন্তোষ মণ্ডল, আমার সহকর্মী- চ্যানেল আইয়ের তখনকার জনপ্রিয় ক্রাইম রিপোর্টার। এভাবে ডাকতে ডাকতে সন্তোষদা আমার ওপর দিয়ে চলে গেলেন। তাকে ডাকার শক্তিটুকুও পেলাম না, সাধ্যমতো চেষ্টা করেও।
হন্যে হয়ে আমাকেই খুঁজতে খুঁজতে সন্তোষদা আবার আমার দিকে ফিরে আসছেন। আমার ওপর দিয়ে আবার যখন উনি চলে যাবেন, অনেক কষ্টে এক আঙুল দিয়ে তাঁর ফুলপ্যান্টের নিচের অংশ ধরে ফেললাম। রক্তাক্ত অবস্থায়ও আমাকে উনি চিনে ফেললেন।
তারপর ঢাকা মেডিকেল থেকে আমাকে আনা হল হলিফ্যামিলি হাসপাতালে। সেখানেই প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আমার প্রাণ বাাঁচানো হল।
পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য চ্যানেল আই আমাকে ব্যাংককে পাঠাল। এভাবেই বেঁচে গেলাম।
দুঃসহ সেই স্মৃতির কথা এখনো যখন একটা মনে ভাবি আঁতকে উঠি। একটা সময়তো সামান্য খট করে শব্দ শুনলেও আঁতকে উঠতাম। তবে এখন কোনও কোনও রাতে খুব অস্বস্তি বোধ করি দুটো পায়ে। কোনও ব্যথা নয়, একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি। সারারাত আর ঘুম হয় না।
দেড় দশক পরও মহান আল্লাহর রহমতে বেঁচেই আছি। অভিশপ্ত গ্রেনেডের স্প্লিন্টার শরীরে ধারণের যন্ত্রণা নিয়েও!
লেখক-
আশরাফুল আলম খোকন
প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব