বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:০৮ অপরাহ্ন
ওয়েব ডেস্ক: দেশের ওষুধ শিল্প দ্রুত সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে নতুন প্রবৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করেছে। তবে বাড়তি প্রতিযোগিতা, নীতিগত অনিশ্চয়তা, সুদের চাপ, মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা খুবই কম—এসব ওষুধ শিল্পের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। গবেষণা-উন্নয়ন, উৎপাদন সম্প্রসারণ, মূলধন সংগ্রহ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পুঁজিবাজার হতে পারে অন্যতম বড় সহায়ক শক্তি। এ জন্য নীতিগত স্থিতিশীলতা, কর-প্রণোদনা ও স্বচ্ছ বাজার কাঠামো নিশ্চিত করা জরুরি। পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানি না এলে শক্তিশালী বাজার কাঠামো গড়া সম্ভব নয়।
মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির (বিএপিআই) বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।
রাজধানীর গুলশানে বিএপিআই কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করেন। বিএপিআইয়ের পক্ষে বৈঠকে নেতৃত্ব দেন সংগঠনের সভাপতি আব্দুল মুক্তাদির।
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রেখে ২০২৫ সালের মধ্যে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করবে। বর্তমানে দেশে ২৫৭টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ও কার্যকরী ওষুধ কোম্পানি রয়েছে, যাদের উৎপাদিত ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশে৷ জাতীয় অর্থনীতিতে এই শিল্পের অবদানও উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ আসে ফার্মাসিউটিক্যাল খাত থেকে। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক এই খাতটি এখনও কিছু অন্তর্নিহিত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন৷ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশের পুঁজিবাজার হতে পারে অন্যতম প্রধান সহায়ক শক্তি। পুঁজিবাজারের মাধ্যমে শিল্পখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, মূলধন সংগ্রহ, গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নে অর্থায়ন এবং নতুন উৎপাদন সুবিধা স্থাপন করা সম্ভব হবে।
বিএপিআই সভাপতি ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুল মুক্তাদির বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে শেয়ারবাজারকে আরও গতিশীল ও আস্থাশীল করতে বিনিয়োগযোগ্য অর্থের সরবরাহ, নীতিগত স্থিতিশীলতা এবং কর কাঠামোর সামঞ্জস্য নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
তিনি বলেন, বর্তমানে বেসরকারি খাতের ঋণগ্রহণের হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে এবং টানা তৃতীয় মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও নিম্নমুখী। অথচ, দেশের অর্থনীতির গতি মূলত বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল, যা জাতীয় রাজস্ব ও প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি।
আব্দুল মুক্তাদির আরও বলেন, শেয়ারবাজারে দীর্ঘমেয়াদি আস্থা ফিরিয়ে আনতে নীতি, আইন ও বিধিমালায় ঘন ঘন পরিবর্তন বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত নয়। সরকারের উচিত বিনিয়োগ সম্পর্কিত নীতিমালাগুলো স্থিতিশীল রাখা এবং কোন বিষয়ে পরিবর্তন আনা হবে না, তা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা। নীতিগত ধারাবাহিকতা বজায় থাকলেই বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, বর্তমানে পাবলিক ও প্রাইভেট কোম্পানির প্রায় সমান করহার থাকায় তালিকাভুক্তির প্রণোদনা কমে গেছে। পাবলিক কোম্পানিগুলোর জন্য কর সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে আরও বেশি প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে আসে। একটি কার্যকর ও প্রাণবন্ত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ মানে হলো সম্পদের তারল্য বৃদ্ধি। বিনিয়োগকারীরা যেকোনো সময় তাদের শেয়ার বিক্রি করে অর্থে রূপান্তর করতে পারেন, যা ব্যাংক আমানতের চেয়ে আরও নমনীয়।
ডিএসই চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, দেশের পুঁজিবাজারকে আরও কার্যকর, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গ্রোথ-ওরিয়েন্টেড করার লক্ষ্যে ডিএসই একটি রূপান্তর যাত্রার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই পুঁজিবাজার যেন দেশের অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি মূলধন সরবরাহের অন্যতম উৎসে পরিণত হয়।
তিনি বলেন, ডিএসইতে ৩৪টি ফার্মাসিউটিক্যালস ও কেমিক্যাল কোম্পানি তালিকাভুক্ত, যার মধ্যে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস বাজারমূল্যের দিক থেকে শীর্ষে। দেশের ওষুধ শিল্প প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের বাজারে পরিণত হয়েছে এবং স্থানীয়ভাবে ৯৮ শতাংশ ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। ডিএসই চায়, এই শিল্প আরও শক্তিশালী হোক এবং নতুন প্রতিষ্ঠান লিস্টিংয়ের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করুক, যাতে ব্যাংক নির্ভরতা কমে এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হয়।
মমিনুল ইসলাম বলেন, মূল বোর্ড ছাড়াও এসএমই এবং অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি) প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিভিন্ন আকারের প্রতিষ্ঠান দ্রুত ও সহজে লিস্টিং করতে পারবে। বিশেষ করে এটিবি ক্ষুদ্র ও উদীয়মান উদ্যোক্তাদের জন্য উপযোগী।
ডেল্টা ফার্মা লিমিটেডের এমডি ও বিএপিআই সেক্রেটারি জেনারেল ড. মো. জাকির হোসেন বলেন, দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। তবে অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো রেগুলেটরি কমপ্লায়েন্স ও পাবলিক লিস্টিংয়ের পূর্ণ সুবিধা নিতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো রেগুলেটরি কমপ্লায়েন্স, যা দেশের আইনগত স্বীকৃতি এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা দেয়। পাবলিক লিমিটেড হওয়ায় কর সুবিধার পাশাপাশি নন-ফাইনান্সিয়াল সুবিধা, যেমন— বিভিন্ন সরকারি সম্মাননা, ব্র্যান্ড অ্যাওয়ার্ড, সিআইপি ও ভিআইপি সুবিধা এবং ব্যবসায়িক ও সামাজিক মর্যাদা প্রদান করে। এই ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশের পাবলিক পারসেপশন পরিবর্তনে সহায়তা করবে এবং বিভিন্ন শিল্পখাত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে উৎসাহিত হবে।
ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। তবুও অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়। যদি এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো মেইন বোর্ড, এসএমই বোর্ড বা এটিবিতে আসে, তবে তাদের প্রবৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও টেকসই উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে।
তিনি আরও বলেন, ডিএসই ও বিএসইসি এখন যৌথভাবে বাজারকে আরও স্বচ্ছ ও বিনিয়োগবান্ধব করতে কাজ করছে। নিম্নমানের আইপিও অনুমোদন না দেওয়া সুশাসনের প্রতিফলন। আধুনিক অবকাঠামো ও দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে ডিএসই এখন একটি সার্ভিস-অরিয়েন্টেড প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেটার মার্কেট ফর বেটার বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছে।
ইমন বলেন, ভালো উদ্যোক্তারা যদি বাজারে না আসে, তবে দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো সুযোগ নেবে। এখন সময় এসেছে সৎ ও সক্ষম উদ্যোক্তাদের এগিয়ে এসে ইতিবাচক পরিবর্তনের অংশীদার হওয়ার।
ডিএসইর আরেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, বিশ্বের বড় সব ওষুধ কোম্পানি নিজ নিজ দেশের স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত। তালিকাভুক্তি স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আস্থার প্রতীক। বাংলাদেশেও এখন সেই সুযোগ তৈরি হয়েছে। ডিএসইতে তালিকাভুক্ত হলে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো জনগণের আস্থা অর্জনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ভ্যালু ও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারবে।
ডিএসইর পরিচালক রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, কোনো কোম্পানি তার অর্জিত মুনাফাকে কতটা সঠিকভাবে কাজে লাগাচ্ছে, সেটিই প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ টেকসইয়ের বিষয়টি নির্ধারণ করে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে আপনারা যে ভূমিকা রাখছেন, পুঁজিবাজারে সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর বড় কোম্পানি স্টক মার্কেটে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য সর্বদা চেষ্টা করে। সবকিছু রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে যত বেশি মানুষ স্টক মার্কেটে যুক্ত হবেন এবং যত বেশি বড় কোম্পানি তালিকাভুক্ত হবে পরিবর্তন তত দ্রুত হবে।
রেনাটা পিএলসির এমডি ও সিইও সৈয়দ এস কায়সার কবির বলেন, লিস্টিংয়ের মূল সুবিধা হলো আন্তর্জাতিক বাজারে কোম্পানির স্বীকৃতি বৃদ্ধি। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে একটি কমফোর্ট জোন হিসেবে দেখে, যা তাদেরকে নির্ভরযোগ্যতা ও স্বচ্ছতা বোঝার সুযোগ দেয়।
তিনি আরও বলেন, লিস্টেড কোম্পানির তথ্য যেমন মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন এবং অন্যান্য ফাইন্যানশিয়াল ডেটা সহজলভ্য হওয়ায় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের কোম্পানির স্থিতি এবং সম্ভাবনা দ্রুত বুঝতে পারে। এই স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ স্টক মার্কেটকে আরও শক্তিশালী করে।
বাংলাদেশ ল্যাম্পস পিএলসির এমডি ও সিইও সিমিন রহমান বলেন, উচ্চ সুদের হার ও মুদ্রার অবমূল্যায়নে ব্যবসায়ীরা কঠিন চাপে আছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন রাইট ইস্যু বা বড় উদ্যোগ নেওয়া উপযুক্ত নয়; তবে ভবিষ্যতে অবস্থা অনুকূল হলে তা পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ অ্যাগ্রোকেমিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বামা) সভাপতি কে এস এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ফার্মাসিউটিক্যালের বাইরেও দেশের বেশ কয়েকটি নন-লিস্টেড সেক্টরে বিনিয়োগের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে । আমাদের অ্যাগ্রোকেমিক্যাল সেক্টর সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে এসেছে। আগে নানা ধরনের ট্যারিফ ও নীতিগত সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা সম্ভব ছিল না। বর্তমানে সেই বাধাগুলো ধীরে ধীরে দূর হচ্ছে, ফলে এ খাতে বিনিয়োগের নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে।
নন-লিস্টেড কোম্পানিগুলোর সম্ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, যদি পুঁজিবাজারের মার্কেটিং বিভাগ অ্যাগ্রোকেমিক্যাল শিল্পের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে, তবে নন-লিস্টেড অনেক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যৌথভাবে কাজ করতে আগ্রহ দেখাবে।
ডিএসইর ভারপ্রাপ্ত এমডি মোহাম্মদ আসাদুর রহমান বলেন, এসএমই বোর্ড স্বল্প মূলধনী (৫ কোটি টাকা পেইড-আপ ক্যাপিটাল) প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য, যা মূল বাজারে প্রবেশের প্রস্তুতিমূলক ধাপ হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে, এটিবি অপেক্ষাকৃত সহজ ও নমনীয়, যেখানে নির্দিষ্ট মূলধনের বাধ্যবাধকতা নেই এবং মাত্র ১০ হাজার টাকায় লিস্টিং করা যায় এবং ইলেক্ট্রনিক্যালি শেয়ার হস্তান্তর করা যায়।