কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি: কুড়িগ্রামে ধরলা নদীর পানি সামান্য কমলেও বাড়ছে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি। জেলায় নতুন করে আরও লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় দফা পানি বৃদ্ধির ফলে ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন বানভাসিরা। পরিবার-পরিজন ও গরু-ছাগল নিয়ে রাস্তায় বা বাঁধে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন কাটছে তাদের। একটি পলিথিনের ছাউনিতে গাদাগাদি করে অবস্থান করতে হচ্ছে পরিবারের সবাইকে।
এতে চরম সমস্যায় ভুগছেন নারী ও কিশোরীরা। পর্যাপ্ত লেট্রিন সুবিধা না থাকায় অপরিচিত লোকজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হচ্ছে লেট্রিন। অনেক দূর থেকে পানি আনতে হচ্ছে। বিশেষ প্রয়োজনে রাতে নারীরা বাইরে বের হতে পারছেন না। কোনোভাবে দিন কাটলেও রাত আসতেই আশঙ্কা আর আতঙ্কে দেখা দেয় এসব পরিবারে। গরু-ছাগল যাতে চুরি না যায় এ জন্য পাহারা বসানো হলেও কর্মহীন যুবক ও কিশোরদের নিয়ে একটা সংশয়ে রাত কাটে। কিশোরী মেয়েদের কারণে দূর-দূরান্ত থেকে অপরিচিত লোকের আনাগোনা বেড়েছে। তাদের আত্মীয় বাড়িতে পাঠিয়েও নিশ্চিন্তে নেই বাবা-মা।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কুড়িগ্রাম-ভুরুঙ্গামারী মহাসড়কে আশ্রয় নেয়া এক মা বলেন, আমার মেয়ে একটি সরকারি স্কুলে ১০ম শ্রেণিতে পড়ে। এই সড়কে এক রাত ছিল। ছেলেদের উৎপাতে শহরে ওর খালার বাড়িতে পাঠিয়েছি। মেয়েটা ওখানে কেমন আছে জানতেও পারছি না।বন্যার সময় দুটো মোরগ আর তিনটা মুরগি নিয়ে এসেছিলাম। একটা খেয়েছি। পরদিন সকালে দেখি বাকিগুলো নেই। কে বা কারা দড়ি খুলে নিয়ে গেছে। পাশের ছাউনি থেকে গত রাতে কে বা কারা দুটো শাড়ি চুরি করে নিয়ে গেছে।
আরেক কিশোরীর মা বলেন, উপযুক্ত মেয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখাই দুষ্কর। ঘুমন্ত কিশোরী মেয়েকে রেখে ত্রাণ আনতে গিয়েছিলাম। এ সময় প্রতিবেশী এক বয়স্ক পুরুষ তার গায়ে হাত দিয়েছে। এমন নানান সমস্যা আর আশঙ্কায় রয়েছি। এ বিষয়ে কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। বানভাসিদের নিরাপত্তায় পুলিশের নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।
এদিকে টানা দ্বিতীয় দফা বন্যায় ধরলা নদীর পানি কমলেও বাড়তে শুরু করেছে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি। বুধবার (১৫ জুলাই) সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০৩ সেন্টিমিটার ও নুনখাওয়া পয়েন্টে ৯৬ সেন্টিমিটার এবং ধরলা নদীর পানি ৮৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যায় রৌমারী ও চর রাজিবপুর উপজেলার অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। একই অবস্থা বিরাজ করছে চিলমারী উপজেলায়। এই তিন উপজেলায় নতুন করে আরও লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। চিলমারীর বড়চর, নটারকান্দি, ঢুষমারা, বজরা দিয়ারখাতা, বাতাসু কাজল ডাঙ্গা, হাতিয়া বকসি, নাইয়ার চর, দুইশো বিঘা, গয়নার পটল, বড় বাগ, খেদাইমারী, খেরুয়ার চর, শাখাহাতী, মনতোলা, তেলী পাড়া, মাঝস্থল, গুড়াতি পাড়া, বাসন্তি গ্রাম, মাঝি পাড়া, হাটি থানা, কালিকুরা, সড়কটারী, দক্ষিণ খামার এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘরে হাঁটু পরিমাণ পানি হওয়ায় এসব এলাকার লোকজন আশ্রয়কেন্দ্র, বাঁধের রাস্তা, স্কুল, মাদরাসাসহ বিভিন্ন উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। তারা গবাদিপশু নিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল-ইমরান জানান, বুধবার সন্ধ্যার দিকে রৌমারী শহর রক্ষা বাঁধের প্রায় ৩০০ মিটার ভেঙে ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রাজারভিটা ফাজিল মাদরাসায় আশ্রয় নেয়া নজির হোসেন (৭৫) জানান, প্রথম দফা বন্যায় ঘরে পানি ওঠায় পরিবার-পরিজন নিয়ে এই মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। বন্যার পানি কমে যাওয়ায় বাড়িতে যাওয়ার সাতদিনের মাথায় আবারও দ্বিতীয় দফা বন্যার পানি ঘরে ওঠায় মাদরাসায় আসতে হলো।
মাদরাসায় আশ্রয় নেয়া করিমন (৫৫) বলেন, ঘরে কোমর পরিমাণ পানি হওয়ায় অসুস্থ স্বামী-সন্তানদের নিয়ে মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েছি। এখানে খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছি। উত্তর রমনা বাঁধে আশ্রয় নেয়া আহাম্মদ আলী (৫৫) বলেন, ঘরে এক বুক পানি। তাই বাঁধের রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছি।
কুড়িগ্রাম ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে জেলা পর্যায়ে ৪০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ এসেছে। এর মধ্যে ১৭০ মেট্রিক টন চাল উপজেলাগুলোতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও বরাদ্দ পাওয়া ১৩ লাখ টাকার মধ্যে ৪ লাখ টাকা, ৪ হাজার শুকনো প্যাকেটের মধ্যে দুই হাজার শুকনো প্যাকেট, দুই লাখ টাকার শিশু খাদ্য ও দুই লাখ টাকার গো-খাদ্য উপজেলাগুলোতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।