♥ সম্পাদকীয়,
১৮৮৬ সালে আমোরিকার শিকাগো শহরের দৈনিক আটঘন্টার কাজের দাবীতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিল। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলীবর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। সেইদিনের শিকাগোর হে মার্কেটের আত্মত্যাগী শ্রমিকদের স্মরণে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস (মে দিবস নামেও পরিচিত)। ১৮৮৯ সালে ফ্রেডারিক এঙ্গেল্স-এর নেতৃত্বে প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ‘আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন’-এর সম্মেলনে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুসারে সমগ্র দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণী একটি সৈন্যবাহিনী হিসেবে একই পতাকাতলে সমবেত হয়ে ১৮৯০ সাল থেকে মে দিবসকে শ্রমিক শ্রেণীর ‘আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস’ পালন করে আসছে। সে সময় থেকে ‘মে দিবস’ দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণীকে কেবল তাদের ৮ ঘণ্টা কাজের দাবির মধ্যেই নয়, শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণ-পীড়ন থেকে মুক্তির অভিন্ন লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উন্নততর চেতনায় সমৃদ্ধ করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠন সমূহ রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে। বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ১লা মে জাতীয় ছুটির দিন। আরো অনেক দেশে এটি বেসরকারি ভাবে পালিত হয়।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস যথাযথভাবে পালন করা হলেও এখন পর্যন্ত শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার এবং নিরাপদে কাজ করার সুযোগ পায়নি। ফলে প্রতিনিয়ত দেখা যায় শ্রমিক অসন্তোষ। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ও কর্মক্ষেত্রে নানান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ঘটনা এদেশে নতুন কিছু নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের ব্যাপক বিস্তারের কারণে শ্রমিকদের জীবনমানের ওপর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। মালিকগণকে প্রয়োজনে কারখানা খোলা রাখলে অবশ্যই কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করতে হবে এবং
দেশের আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা করবে সে প্রত্যাশায় রইলাম।
শ্রমিক দিবসের পটভূমি
উনিশ শতকের গোড়ার দিককার কথা। শ্রম ও শ্রমিকের শোষণের বিরুদ্ধে পৃথিবীর আদিকাল থেকেই সংঘবদ্ধ বা বিচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম চলে আসছে। সংগ্রামের মাধ্যমেই এক সময় পৃথিবী থেকে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও পরে শ্রমিকদের কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময় দেওয়া ছিল না। ফলে শ্রমিকরা তখনো ছিল শোষিত। কল-কারখানায় চাকরি টিকিয়ে রাখতে হলে সপ্তাহে ৬ দিন গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার অমানুষিক পরিশ্রম করতে হতো তাদের। কিন্তু তার বিনিময়ে মিলত সামান্য কিছু মজুরি। আর নিরাপত্তাহীন পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে রোগ-ব্যাধি, আঘাত আর মৃত্যুই হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের জীবনের নির্মম অনুষঙ্গ। কিন্তু একটা সময় এসে ঘুরে দাঁড়াল তারা। দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি উত্থাপন করল শ্রমিকরা। ১৮৮০ সালে আমেরিকায় প্রথম এ দাবি উত্থাপিত হয়। ১৮৮৪ সালে শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠা করে Federation of Organized Trades and Labor Unions of the United States and Canada।
পরবর্তীতে অবশ্য ১৮৮৬ সালে সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে Federation of Labor রাখা হয়।
এই সংঘের মাধ্যমেই শ্রমিকরা সংগঠিত হয়ে ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু মালিকরা শ্রমিকদের এই দাবি উপেক্ষা করায় ঢালাই শ্রমিক সিলভিসের নেতৃত্বে ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকায় ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। আর এই ধর্মঘটের প্রধান কেন্দ্র ছিল যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহর।
শ্রমিক আন্দোলন শুরু যেভাবে
বর্তমান শ্রমিক সংগ্রাম থেকে ‘মে দিবসে’র সংগ্রাম ছিল অনেকটাই ভিন্ন। ১৭৬০ থেকে ১৮৩২ সাল ছিল ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের মূল পর্যায়। আর এই শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমেই যান্ত্রিক যুগের সূচনা হয়। সে সময় শ্রমিকরা মনে করত, কল-কারখানাই তাদের দুঃখকষ্টের কারণ। তাই ১৭৬০ সালে লেডউড নামক এক সুতাকল শ্রমিকের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের সুতাকল শ্রমিকরা কলভাঙা আন্দোলন শুরু করে। ১৮৩০ সাল পর্যন্ত চলেছিল এই আন্দোলন। কিন্তু এই আন্দোলনে শ্রমিকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করলে ১৭৫৮ সালের পর তারা বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে আন্দোলন শুরু করে এবং নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। কিন্তু ১৮০০ সাল নাগাদ ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করে এবং তা ১৮৪৭ পর্যন্ত নানা ধরনের আইন করে অকেজো করে রাখার চেষ্টা করা হয়।
চূড়ান্ত আন্দোলন
১৮৮৪-৮৫ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প ব্যবসায় মন্দা দেখা দিলে অনেক কলকারখানাই বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। ফলে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পরে বহু শ্রমিক। জীবনে নেমে আসতে থাকে চরম দুঃখ-দুর্দশা। যে কারণে শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে।
১৮৮৪ সালে American Federation of Labor আট ঘণ্টা দৈনিক মজুরি নির্ধারণের প্রস্তাব পাস করে এবং মালিক ও বণিক শ্রেণীকে এই প্রস্তাব কার্যকরের জন্য ১৮৮৬ সালের ১ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। তারা এই সময়ের মধ্যে সংঘের আওতাধীন সব শ্রমিক সংগঠনকে এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে সংগঠিত হওয়ার জন্য বারবার আহ্বান জানায়। প্রথমদিকে অনেকেই একে অবাস্তব অভিলাষ এবং অতি সংস্কারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে। কিন্তু বণিক-মালিক শ্রেণীর কোনো ধরনের সাড়া না পেয়ে শ্রমিকরা ধীরে ধীরে প্রতিবাদী ও প্রস্তাব বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে থাকে। এ সময় ‘অ্যালার্ম’ নামের একটি পত্রিকায় ‘একজন শ্রমিক আট ঘণ্টা কাজ করুক কিংবা ১০ ঘণ্টাই করুক-সে দাস বলেই বিবেচিত’ এ রকম বিষয়বস্তুর একটি কলাম ছাপা হওয়ার পর জ্বলন্ত আগুনে যেন ঘি পড়ে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দলগুলোও একাত্দতা প্রকাশ করে। ১ মে’কে ঘিরে আয়োজিত হতে থাকে বিভিন্ন প্রতিরোধ আর প্রতিবাদ সভা। কিন্তু মালিক-বণিক শ্রেণী অবধারিতভাবে ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। ১৮৭৭ সালে শ্রমিকরা একবার রেলপথ অবরোধ করলে পুলিশ ও ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি তাদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালায়। ঠিক একইভাবে ১ মে দিনটির মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয়ভাবে পুলিশ ও জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা শিকাগো সরকারকে অস্ত্র ও জনবল সংগ্রহে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে। পাশাপাশি ধর্মঘট আহ্বানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য শিকাগোর বাণিজ্যিক ক্লাব ‘ইলিনয়’ প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ভারি মেশিনগান কেনার অর্থ প্রদান করে। এতসব বাধার মুখে অবশেষে ১৮৮৬ সালের ১ মে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় তিন লাখ শ্রমিক তাদের কাজ ফেলে এদিন রাস্তায় নেমে আসে। শিকাগোতে আগে থেকেই শ্রমিক ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল। প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক কাজ ফেলে শহরের কেন্দ্রস্থলে সমবেত হয় সেখানে। জ্বালাময়ী বক্তৃতা, মিছিল, মিটিং, ধর্মঘট, বিপ্লবী আন্দোলনের হুমকি_সব কিছু মিলে ১ মে উত্তাল হয়ে ওঠে। পার্সন্স, জোয়ান মোস্ট, আগস্ট স্পিজ, লুই লিংসহ অনেকেই শ্রমিকদের মাঝে এই আন্দোলনের পথিকৃৎ হয়ে ওঠেন। আন্দোলনে বিপুল সাড়া দিয়ে ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে শ্রমিকদের সংখ্যা। পরবর্তীতে ৪ মে আন্দোলন চলাকালে সন্ধ্যায় হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর ‘হে’ মার্কেট বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকরা মিছিলের উদ্দেশে জড়ো হয়। মিছিল শুরুর আগে শ্রমিক নেতা আগস্ট স্পিজ জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশে কিছু কথা বলছিলেন। এ সময় হঠাৎ করেই দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। এই হামলায় এক পুলিশসহ ছয় জন নিহত এবং ১১ জন আহত হয়। বোমা বিস্ফোরণের পরপরই পুলিশবাহিনীও শ্রমিকদের ওপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে, যা সঙ্গে সঙ্গেই রায়টের রূপ নেয়। এই রায়টে প্রাণ হারান ১১ শ্রমিক। এদিকে পুলিশ হত্যা মামলায় শ্রমিকনেতা আগস্ট স্পিজসহ আট জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এই মামলার প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে স্পিজসহ ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। আরেক শ্রমিকনেতা লুই লিং ফাঁসির একদিন আগেই কারাভ্যন্তরে আত্দহত্যা করেন আর অভিযুক্ত আরেকজনের ফাঁসি মওকুফ করে পনের বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে ১৮৯৩ সালের ২৬ জুন ইলিনয়ের গভর্নর অভিযুক্ত আট জনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা করেন এবং রায়টের হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। তবে অজ্ঞাত সেই বোমা বিস্ফোরণকারীর পরিচয় আর কখনোই প্রকাশ পায়নি। এভাবেই শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের ‘দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার দাবি’ যুক্তরাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং পয়লা মে বা মে দিবস শ্রমিকদের দাবি আদায়ের দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।