বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলাবদ্ধতা নিরসনে ২৩টি খালের মুখসহ পুরো এলাকায় ৪০টি স্লুইচ গেট নির্মাণের পরিকল্পনাকে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মত দিয়েছেন নদী গবেষক ও আলোচকেরা।
তারা বলেছেন, চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন ব্যবস্থায় কর্ণফুলী নদীতে পড়া ২৩টি, হালদায় তিনটি এবং বঙ্গোপসাগরে পড়া ১৪টি খালের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ৬৯টি পাম্প হাউস নির্মাণ ও চাক্তাই, রাজাখালী ও মহেশ খালে স্লুইস গেট নির্মাণ একটি আত্মঘাতী পরিকল্পনা। নদীতে জোয়ারের সময় স্লুইস গেট বন্ধ থাকবে তখন নগরীতে ১০০ মিলি লিটারের অধিক বৃষ্টিপাত হলে অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে। স্লুইস গেট নির্মাণ করে খালকে চিরতরে হত্যা করা হবে।
বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) সকালে এক আলোচনা সভায় বিশেষজ্ঞ ও আলোচকেরা এ কথা বলেন। সকালে নগরের লালখান বাজার এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে ‘বৃহত্তর চট্টগ্রামের নদী, খাল ও জলাশয় রক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক এ আলোচনা সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলা।
সেমিনারে লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক আলীউর রহমান।
সেমিনারে সুপ্রভাত বাংলাদেশের চিফ রিপোর্টার ভূইয়া নজরুল প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ৪০টি স্লুইচ গেট নির্মাণ করা হচ্ছে। আজ পত্রিকায় দেখলাম, ভবদহে কৃষকরা স্লুইচ গেট ভেঙে ফেলার কথা বলছেন। চট্টগ্রামেও যদি স্লুইচ গেটগুলো পলি পড়ে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কি খালগুলো বাঁচবে?’
তিনি আরও বলেন, ‘১৯৯৫ সালের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ১ একরের নিচে কোনো জলাশয় ভরাটে অনুমতি নেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম উন্নয়ণ কর্তৃপক্ষ সেটি কমিয়ে দশমিক পাঁচ একরে নিয়ে এসেছে। এর ফলে নগরের প্রায় সবগুলো জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে। বড় জলাশয়গুলোর প্রথমে চারপাশ ভরাটের পর ছোট হয়ে এলে তা একেবারে ভড়াট করার জন্য সিডিএর কাছে আবেদন করা হচ্ছে, তারা অনুমতিও দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কয়েকবছর পর চট্টগ্রামে আর কোনো জলাশয় খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
সাংবাদিক ভূইয়া নজরুলের কথাকে সমর্থন করেন চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান। তিনি বলেন, ‘জলাবন্ধতা দূর করতে গত ১৪ বছরে শুধু চাক্তাই খালে ৩২৪ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। যা প্রতিবছর গড়ে ২৩ কোটি টাকা। কিন্তু চাক্তাই খাল আগের মতোই রয়ে গেছে। ১৯৬৯ সালে ফ্লাড ডিটেইল প্ল্যান অনুযায়ী নগরীর ৭১টি খাল আর এস সিট অনুযায়ী উদ্ধার না করা হলে চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ-জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন ব্যবস্থায় কর্ণফুলী নদীতে পড়া খালের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ৬৯টি পাম্প হাউস নির্মাণ ও চাক্তাই, রাজাখালী ও মহেশ খালে স্লুইস গেট নির্মাণ একটি আত্মঘাতী পরিকল্পনা। নদীতে জোয়ারের সময় স্লুইস গেট বন্ধ থাকবে তখন নগরীতে ১০০ মিলি লিটারের অধিক বৃষ্টিপাত হলে অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাছে। স্লুইস গেট নির্মাণ করে খালকে চিরতরে হত্যা করা হবে।’
ব্লাস্ট প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট জিন্নাত আমিন বলেন, ‘সবার আগে মানুষকে সচেতন করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে আজ আমরা পরিবেশ নষ্ট করলে এর ফলে আগামীতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মই কষ্ট পাবে। সমস্যা সমাধানে সরকার উদ্যোগ নেবে, না হলে বেলা’র মতো সংগঠন আইন রিফর্মের জন্য আইনি লড়াই করবে। কিন্তু মানুষ সচেতন না হলে কিছুই হবে না। মানুষকে সচেতন করা গেলে, তাদের মাঝে জাগরণ আনা গেলেই অনেক সমস্যা এমনিতেই সমাধান হয়ে যাবে।’
হালদা থেকে পানি উত্তোলন নিয়ে প্রশ্ন তুলে ক্যাব’র ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘হালদা নিয়ে বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে হালদা রক্ষা কমিটি থাকার পরেও কিভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের জন্য এখান থেকে পানি নিয়ে যাবে?’
তিনি আর বলেন, ‘মোহরা পানি শোধনাগার ফেজ-২ স্থাপন করে দৈনিক ১৪ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করা হলে হালদা জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে।’
হালদা রক্ষা আন্দোলনের নেতা মো. কামাল সওদাগর বলেন, ‘হালদার উজানে রাবার ড্যাম উচ্ছেদ না করা হলে এ নদী বাঁচবে না। এর মধ্যে যদি মোহরা পানি শোধনাগার ফেজ-২ স্থাপন করে হালদা নদী থেকে পানি উত্তোলন করা হয় তাহলে হালদাকে বাঁচানো যাবে না। বাঁচবে না হালদার মা মাছ ও ডলফিন।’
সেমিনারে লিখিত প্রবন্ধে সাংবাদিক আলীউর রহমান উল্লেখ করেন, বৃহত্তর চট্টগ্রামের অধিকাংশ নদী ও খালে পাহাড় বেয়ে নেমে আসা পানি প্রবাহিত হয়। এ কারণে নদী ও খালগুলোতে পলি জমার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বনাঞ্চল ধ্বংস করা ও জুম চাষ এর অন্যতম কারণ। চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনা এলাকায় কর্ণফুলী দুষণের ফলে রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা এলাকায় তিনটি চর জেগে উঠেছে। ইতোমধ্যেই কর্ণফুলীর ভাঙনে ভূমির খিল নামে একটি গ্রাম বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বৃহত্তর চট্টগ্রামের নদীগুলোর করুণ রুপ তুলে ধরে বলা হয়, ‘অপিরিকল্পিত বালু উত্তোলন, পাহাড় কাটা, জুম চাষ ইত্যাদি কারণে বৃহত্তম চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও তার উপনদীসমূহ রাইনখিয়াং, কাসালং, হালদা, ইছামতী এবং পাহাড়ি নদী বাকখালী, সা,ঙ্গু মাতামুহুরী, নাফ, ফেনী নদী ভরাট হয়ে শুস্ক মৌসুমে নাব্যতা সংকট এবং বর্ষাকালে বন্যায় নদী ভাঙন এবং উভয় তীরের এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।’
সেমিনারে মহানগর পর্যায়ে নদী কমিশন, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, বন্দর কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদফতর, জেলা প্রশাসক চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও, ইউনিয়ন পরিষদের সমন্বয়ে নদী খাল ও জলাশয় রক্ষায় এক হয়ে কাজ করতে হবে। পুকুর দিঘি জলাশয় ও নদীর সীমানা নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় গাইড ওয়াল নির্মাণ করে তা সংরক্ষণ করা সহ ১০ দফা সুপারিশ প্রদান করা হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শাহ আলমের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন, পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক জমির উদ্দিন।
বক্তব্য দেন- বেলার হেড অব প্রোগ্রাম অ্যাডভোকেট খোরশেদ আলম, প্রোগ্রাম অ্যান্ড ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর এ এম এম মামুন, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্চয় বিশ্বাস, ব্লাস্টের অ্যাডভোকেট জিন্নাত আমিন, টিআইবি প্রতিনিধি তৌহিদ আলম, কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশন সভাপতি এস এম পেয়ার আলী প্রমুখ ।