কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: হাফিজ আল আসাদ ও সৌরভ। দুই বন্ধু মিলে কিছু কিছু সঞ্চয় করে এক বছর আগে কুষ্টিয়া শহরের এন এস রোডের একটি মার্কেটে দুইটি দোকান ভাড়া নিয়ে কফি হাউস ও স্ন্যাকস’র ব্যবসা শুরু করেন। শুরুতেই তাদের দোকানের সিকিউরিটি মানি, এক মাসের অগ্রিম ঘর ভাড়া এবং দোকান সাজাতে বেশ কিছু অর্থ ব্যয় হয়ে যায়। এরপর সবকিছু গুছিয়ে শুরু করেন তাদের ক্ষুদ্র ব্যবসা। সেই ছোট কফি হাউস ও স্ন্যাকসের দোকান থেকে তাদের স্বপ্ন বাড়তে থাকে। এক বছরে কর্মসংস্থান করেছেন বেশ কিছু মানুষের। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে গড়ে তুলেছিলেন ‘ফ্রেন্ডস ফাস্ট ফুড কর্নার’।
এই আয় থেকেই বাড়ছিল তাদের এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। নিজেরা কাজ করার পাশাপাশি আরও দুই ব্যক্তিকে কাজের জায়গাও করে দিয়েছিলেন তাদের ছোট প্রতিষ্ঠানে। এই স্বল্প সময়ে অনেক চড়াই-উৎরাই পার করলেও তাদের ব্যবসা গোটানোর চিন্তা করতে হয়নি। কিন্তু করোনা তাদের ব্যবসায় আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেয়নি। টানা সাধারণ ছুটি ও লকডাউনে বকেয়া হয়েছে চার মাসের দোকান ভাড়া। অন্যদিকে জমেছে বিদ্যুৎ বিল।
হাফিজ আল আসাদ বলেন, হঠাৎ করে সবকিছু এমন পরিবর্তন হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি। উদ্যোক্তা হয়েও টানা সময় ধরে বেকার জীবনযাপন করছি। এবার আর ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় দেখছি না। বিনিয়োগ হারাতে বসেছি এখন। করোনা আমার এবং ব্যবসার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে চরম সংকটে পড়েছেন হাফিজ আল আসাদের মতো কুষ্টিয়ার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। যারা ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন। টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ও পরবর্তী সময়ে স্থানীয় প্রশাসনের লকডাউন সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রাখা এবং ছুটি শেষে সীমিত আকারে খুললেও খুব একটা লাভবান হচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।
ক্রেতা নেই, তাই লেনদেনও কম। উপরন্তু পারিবারিক খরচ মেটাতে জমানো অর্থ খরচ করে চলেছেন এতদিন। দেনায় এখন অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় খুঁজছেন। এভাবে চলতে থাকলে প্রায় অর্ধলক্ষ গবেষণা সংস্থার। এদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষ পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের সুযোগ দিতে হবে। না হলে দারিদ্রতা বাড়বে। আর যারা আবারও ব্যবসা করতে চান কিন্তু পুঁজি নেই, তাদের জন্যও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
সূত্রে জানা গেছে, কুষ্টিয়ার মোট ব্যবসায়ীর ৯০ ভাগ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। পরিসংখ্যান অফিসের সর্বশেষ তথ্যনুযায়ী কুষ্টিয়ায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫ হাজার ৯৫৯টি। সবাই কমবেশি বিভিন্নভাবে ঋণগ্রস্ত। সেই সঙ্গে গত দুই বছরে যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত দোকান ভাড়া। করোনা প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর জেলা প্রশাসন ও কুষ্টিয়া পৌরসভা শহরের দোকান কর্মচারীদের তালিকা সংগ্রহ করলেও তা কোনো কাজে আসেনি। এখন পর্যন্ত কোনো সহযোগিতা বা সরকারি প্রণোদনা পাইনি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।
উদ্যোক্তা আল মামুন সাগর বলেন, সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ আমাদের মতো ব্যবসায়ীরা। চার মাস প্রতিষ্ঠান খুলতে না পারায় লোকসানের বোঝা ঘাঁড়ে চেপেছে। জমানো টাকা দিয়ে ১৫ জন কর্মচারীর বেতন পরিশোধ করেছি। কর্মচারীরাও যার যার মতো অবস্থান করছে। এখন প্রতিষ্ঠান খুললেও লোকসান গুনতে হবে। করোনা কারণে মানুষজনের আনা গোনা কম। আগের পরিস্থতিতে ফিরতে না পারলে এই লোকসান থেকে উত্তরণের পথ নেই।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ধস নেমেছে গার্মেন্ট ব্যবসায়। বছরের চারটি উৎসবে (দুই ঈদ, পূজা ও পহেলা বৈশাখ) তাদের ব্যবসায় বিকিকিনির পরিমাণ বেশি হয়। কিন্তু করোনার জন্য দীর্ঘসময় মার্কেট বন্ধ থাকায় লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। তাছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য কোনো প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণও তারা পাননি। ব্যাংক লোন নেওয়ার পথও বন্ধ। এখন সে পরিস্থিতিও নেই। সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে আমাদের ব্যবসা গুটাতে হতো না।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুষ্টিয়ার সহ-সভাপতি মিজানুর রহমান লাকী বলেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তদের প্রণোদনা না দিলে অনেকে বিনিয়োগ হারিয়ে আর্থিক সংকটে পড়বে। এর প্রভাব পড়বে শ্রমিকদের ওপর। এতে প্রায় অর্ধলক্ষ শ্রমিক কর্ম হারিয়ে বেকার হবে। এই বৈশ্বিক মহামারি থেকে আমরা কবে মুক্তি পাবো তাও অনিশ্চিত। এই মুহূর্তে সরকারের তদারকির মাধ্যমে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের বাঁচিয়ে রাখতে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা।
কুষ্টিয়া চেম্বার অব কর্মাসের সহ-সভাপতি ব্যবসায়ী নেতা এম এম কাদেরী শাকিল বলেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য সামনে আরও খারাপ সময় আসছে। এরা সব থেকে বেশি অবহেলিত। কম পুঁজি দিয়ে দিনে ইনকাম দিনে শেষ। এমন ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছেন। গত চার মাসে তাদের কেউই ব্যবসা করতে পারেনি। উল্টো পুঁজি ভেঙে খেতে হচ্ছে। আবার অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যারা আছেন তাদের একেকজনের পুঁজি ৫০ হাজার টাকার বেশি নয়।
এই টাকাটা পেলে তারা অন্তত দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে উদ্ধার পেত। এর আগে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের মাধ্যমে শহরের ১৩ হাজার দোকান কর্মচারীর তালিকা নিয়েছিল জেলা প্রশাসন ও পৌর কর্তৃপক্ষ। সেটাও আলোর মুখ দেখেনি। জেলা প্রশাসন মাত্র এক হাজার দোকান কর্মচারীকে সহায়তা দেওয়ার কথা বলেছিল। পরবর্তীতে সেটা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বিতরণ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দেখেন সব সেক্টরে যার যার জায়গা থেকে প্রণোদনা, সহায়তা সব পেয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বঞ্ছিত হয়েছে। করোনাকালে সাধারণ ছুটি, লকডাউন সব ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের দোকানপাট বন্ধ করতে হয়েছে। তাছাড়া সবাই ঋণগ্রস্ত। ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছে। আজ তারা বিনিয়োগ হারাতে বসেছে। এই মুহূর্তে তাদেরকে বাঁচাতে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।