মহব্বত আরবী শব্দ। শব্দটির বাংলা অর্থ ভালোবাসা। মুসলমানদের কাছে বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) ভালোবাসার সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে অধিষ্ঠিত। বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.) কে ভালোবাসা ইমানের দাবী। স্ত্রী, সন্তান, মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনের চেয়েও একজন মুসলমান বিশ্বনবী (সা.)-কে বেশি ভালোবাসেন। এমন ভালোবাসা না থাকলে কেউ মুসলিম হতে পারে না। উল্লেখ্য যে, বিশ্বনবী হলেন হযরত মোহাম্মদ (সা.)। তিনি ‘মোহাম্মাদ’ এজন্য যে, তিনি আল্লাহর কাছে প্রশংসিত, ফেরেশতাদের মাঝে প্রশংসিত, পৃথিবীবাসীর নিকটে প্রশংসিত, যারা তার প্রতি ঈমান এনেছে তাদের কাছে প্রশংসিত, এমনকি যারা ঈমান আনেনি তাদের কাছেও তিনি তার গুণ ও মাহাত্ম্যের, চরিত্র ও মহানুভবতার কারণে প্রশংসিত। সৃষ্টির মধ্যে যার প্রশংসা সবচেয়ে বেশি করা হয়েছে আর জগৎ-সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে আজ পর্যন্ত যার প্রশংসা অব্যাহত রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে তিনি হলেন নবী রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ময়দানে হাশরে যে স্থানে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি শাফায়াত করবেন সে স্থানের নাম ‘মাকামে মাহমূদ’। সেদিন ‘লিওয়ায়ে হামদ’- প্রশংসার ঝা-া তার মুবারক হস্তেই উড্ডীন থাকবে।
বিশ্বনবী (সা.) কে ভালোবাসার মর্মার্থ হলো, তিনি মহান প্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন থেকে যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ করা আর যা নিষেধ করেছেন তা বর্জন করা। মহান আল্লাহপাক বলেন, রাসুল (সাঃ) তোমাদের নিকট যা নিয়ে এসেছেন, তা গ্রহণ কর আর যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক। (সুরা হাশর : আয়াত :০৭)
পবিত্র কোরআন ও হাদীস শরীফে বিশ্বনবী (সাঃ) এর প্রতি ভালোবাসা প্রসঙ্গঃ
এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আপনি বলে দিন, তোমাদের কাছে যদি আল্লাহ, তার রাসুল এবং আল্লাহর পথে সংগ্রাম করার চেয়ে বেশি প্রিয় হয়ে ওঠে তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের পরিবার-পরিজন, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দায় পড়ার আশঙ্কা কর এবং তোমাদের বাড়ি-ঘর, যা তোমরা পছন্দ কর, তাহলে অপেক্ষা কর আল্লাহর (আজাবের) নির্দেশ আসা পর্যন্ত। আল্লাহপাপাচারী সম্প্রদায়কে সঠিক পথের দিশা দেন না।’ (সুরা তওবা, আয়াত : ২৪)
আল্লাহপাক আরো বলেন, ‘হে নবী! বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো তবে আমাকে অনুসরণ কর। আল্লাহতোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আল ইমরান : আয়াত : ৩১)
আল্লাহপাক বলেন, হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ্ ও তার রাসূলের ডাকে সাড়া দাও, যখন তোমাদের সে কাজের প্রতি আহবান করা হয়, যা তোমাদের মাঝে জীবনের সঞ্চার করে। (সুরা আনফাল: আয়াত : ২৪)
আল্লাহপাক আরো বলেন, নবীর সঙ্গে ঈমানদারের প্রাণেরও অধিক সম্পর্ক। তিনি তাদের সত্তা থেকেও তাদের কাছে অগ্রগণ্য। (সূরা আহযাব : আয়াত : ৬)
উল্লেখিত আয়াতে কারীমাগুলোর মর্মবাণী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে এভাবে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার পিতা ও সন্তানের চেয়ে, সকল মানুষের চেয়ে, এমনকি তার প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয় না হই। -(সহীহ বুখারী, মুসলিম)
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসুল! কিয়ামত কখন হবে? জবাবে আল্লাহর রাসুল পাল্টা প্রশ্ন করলেন, কিয়ামতের জন্য তুমি কী প্রস্তুতি নিয়েছ? লোকটি বলল, এর জন্য আমি তেমন কোনো প্রস্তুতি নিতে পারিনি; তবে আমি আল্লাহ ও তার রাসুলকে ভালোবাসি। রাসুল (সা.) বলেন, তুমি যাকে ভালোবাসো কিয়ামত দিবসে তুমি তার সঙ্গেই থাকবে।’ (সহীহ বুখারি)
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘ তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ ইমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয় হবো না। এবং আমার পরিবার তার পরিবারের চেয়ে বেশি প্রিয় হবে না।’ (কানজুল উম্মাল)
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তিনটি গুণ যার মধ্যে আছে, সে ইমানের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। এক. আল্লাহ ও তার রাসুল তার কাছে অন্য সব কিছু থেকে অধিক প্রিয় হওয়া। দুই. কাউকে একমাত্র আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা। তিন. কুফরিতে প্রত্যাবর্তনকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতো অপছন্দ করা।’ ( সহীহ বুখারি)
হযরত ওমর (রাঃ) একবার বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ ! আপনি আমার নিকট আমার জীবন ব্যতীত অন্য সমস্ত বস্তু হতে অধিক প্রিয়। হুযুর (সাঃ) বললেন, কোন ব্যাক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত আমার মহব্বত তার নিকট তার জীবনের চাইতেও বেশী না হইবে । হযরত উমর (রাঃ) বলিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এখন আপনি আমার নিকট আমার জীবনের চাইতেও বেশী প্রিয় । (বুখারী)
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, মানুষের হাশর হবে তার সাথে যার সাথে তার মহব্বত রয়েছে । (মুসনাদে আহমাদ)
বিশ্বনবী (সাঃ) এর ভালোবাসা পেতে করণীয়ঃ
১. মহান আল্লাহর বিধানসমুহকে রাসুল (সাঃ) কর্তৃক নির্দেশিত বিধান মোতাবেক পালন করা।
২. জীবনের সকল ক্ষেত্রে ‘সুন্নাতে রাসুলের’ যথাযথ অনুসরণ করা।
৩. রাসুল (সাঃ) কে যে ব্যক্তি ভালোবাসে তাকে ভালোবাসা, আর যে তাঁকে অপছন্দ করে তাকেও অপছন্দ করা।
৪. সকল আদর্শের চাইতে তাঁর আদর্শকেই সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করা এবং সে মোতাবেক জীবন পরিচালনা করা।
৫. ফরয বিধানের সাথে সাথে সুন্নাতকে সমানভাবে গুরুত্ব দেয়া।
৬. তাঁর আদর্শ মোতাবেক নিজেকে ও পরিবারকে পরিচালনা করা।
৭. তাঁর সমুজ্জ্বল আদর্শ অনুযায়ী সমাজ, রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পরিচালনা করা।
৮. সকল ধরণের কুসংস্কার, রুসম, বেদআতকে পরিহার করা।
৯. তাঁর শান, মান মর্যাদার ব্যাপারে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা প্রদর্শন করা।
১০. তাঁর আদর্শকে প্রচার ও প্রসারে বাস্তবিক অর্থে নিজেকে নিবেদিত করা।
পরিশেষে যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা পোষণ না করলে ঈমানদার বলে কেউ বিবেচিত হবে না। অতএব ঈমানের অনিবার্য দাবী হল- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াা সাল্লামকে ভালোবাসা। আল্লাহপাক, আমাদেরকে বিশ্বনবী (সাঃ) কে যথাযথভাবে অনুসরণ তথা তাঁর সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখকঃ প্রভাষক, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা।