প্রত্যয় নিউজডেস্ক: ভ্যাকসিন, কোভিড-নাইনটিনকে হারানোর অন্যতম বড় শক্তি। তবে একমাত্র নয়। এই ভ্যাকসিন নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতি এখন তুঙ্গে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যেমন চাঙা, তেমনি আন্তর্জাতিক পরিসরেও সেয়ানে সেয়ানে লড়াই কয়েকটি দেশের। কোনো সন্দেহ নেই, পরবর্তী বিশ্ব বদলে যাবে ভ্যাকসিনের মোড়কে। বিশ্বে আগামী কয়েক বছরের অর্থনীতিও ভ্যাকসিন নির্ভর হয়ে পড়ার সম্ভাবনা বা শঙ্কা প্রবল। বিলিয়ন বিলয়ন ডলারের ব্যবসা আসন্ন, তাই দূরদর্শী দেশগুলো আগেভাগেই সচেতন। তাদের এই সচেতনতা আর প্রতিযোগিতা ভাবাচ্ছে ছোটদের। তুলনামূলক দুর্বল দেশগুলো ভ্যাকসিন পেতে বন্ধু হাতের ওপর নির্ভর করছে।
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের কোটি কোটি ডোজ বুকিং দিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানিসহ অন্য মোড়ল দেশগুলো। নিজেরা উৎপাদন করছে ঠিকই, কিন্তু একে অন্যেরটা পেতেও তারা ঐক্যবদ্ধ। তাই তো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বারেবারে, কয়েকদিন পরপরই প্রশ্ন তুলছে, ভ্যাকসিন চলে এলে তা সব দেশ পাবে তো? সংস্থাটির ধারণা, ২০২১ সালের মধ্যে ২০০ কোটি ডোজ প্রস্তুত হবে। কিন্তু সেটা বড়লোকদের ঘরেই যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ খোদ ডব্লিউএইচও’র। প্রতিযোগিতার বাজার তাই দাম বাড়বে, এমন শঙ্কাও জোরালো।
উৎপাদন নিয়েই থেমে নেই প্রতিযোগিতা। চীন ও রাশিয়া ভ্যাকসিন উৎপাদনে এখন একে অন্যের সঙ্গে অপ্রকাশিতভাবে পাল্লা দিচ্ছে। গত এক মাস ধরে চীন তাদের জনসাধারণকে করোনা ভ্যাকসিন দিচ্ছে বলে দাবি করেছে বেইজিং। দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন জানায়, ২২শে জুলাই থেকে চীন তাদের জনগণকে ভ্যাকসিনের ডোজ দেয়া শুরু করে। দেশটিতে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে মোট চারটি ভ্যাকসিন। কিন্তু দেয়া হচ্ছে আসলে কোনটা তা পরিষ্কার করা হয়নি। তবে এটা জানা গেছে, ভ্যাকসিনের কোনো খারাপ প্রভাব মেলেনি। তার মানে অগ্রগতি অনেক দূর।
এদিকে রাশিয়া তাদের ‘স্পুৎনিক-ফাইভ’ ভ্যাকসিনটি প্রাথমিকভাবে দেয়া শুরু করেছে, পাচ্ছেন চিকিৎসকরা। এরপর পাবেন শিক্ষকরা। তাদের দ্বিতীয় ভ্যাকসিনও তৈরি। কয়েকটি ধাপের ট্রায়াল শেষে যা সেপ্টেম্বরে অনেকাংশে চূড়ান্ত হবে। খোদ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এ কথা বলেছেন।
যুক্তরাজ্য তাদের অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন নিয়ে এগিয়ে চলেছে। দেশে দেশে হিউম্যান ট্রায়াল সফল হচ্ছে। এর মধ্যেই এবার আলোচনায় ক্যামব্রিজ ভ্যাকসিন। বিশ্ববিদ্যালয়টি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে বিপুল অর্থ সহায়তা পাওয়ার পরপরই নিজস্ব করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। ফলে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে শুরু হচ্ছে তাদের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল। যুক্তরাষ্ট্রও পুরোদমে গবেষণা অব্যাহত রেখেছে। একাধিক ট্রায়ালে সাফল্যের দাবি করেছে তারাও।
ভারতও শীঘ্রই করোনা ভ্যাকসিন পেতে চলেছে। যুক্তরাজ্য এ কাজে সহায়তা করছে। রাশিয়ার ভ্যাকসিন উৎপাদনও হবে ভারতে। সব মিলিয়ে জানুয়ারিতে গণটিকার ব্যবস্থা করা যাবে, এমন আশা কর্তৃপক্ষের।
সবাই যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন বাংলাদেশের অবস্থা কি? ভ্যাকসিন পেতে বাংলাদেশ মূলত বন্ধু হাতের সন্ধানে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, তারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন, ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। যে দেশ দেবে আগে, তারটাই নেয়ার পরিকল্পনা পরিষ্কার করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে প্রশ্ন হলো, সবার পণ্য কি ভালো? জীবন-মরণ প্রশ্নে মানের সঙ্গে আপস কেন? বলছি না, আপস হয়ে গেছে, কিন্তু এই বিষয়টায় নজর নেই এ কথা তো স্পষ্ট। এই নজরহীনতার সংস্কৃতিতে যদি নিম্নমানের কোনো ভ্যাকসিন বাংলাদেশ গ্রহণ করে তাহলে এর খেসারত কি জনগণকে দিতে হবে না! কিংবা অর্থনৈতিক ক্ষতিও তো হতে পারে (ভ্যাকসিন কেনার জন্য বাজেটে আলাদা তেমন কোনো বরাদ্দ রাখা নেই।
তবে, করোনা সংক্রান্ত জরুরি প্রয়োজনে খরচ করার জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যা থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা খরচ হতে পারে)। তাছাড়া করোনার মধ্যে সামান্য মাস্ক নিয়েই যে দুর্নীতি হলো, হাসপাতালগুলো যে অনিয়ম করলো, সাহেদ-সাবরিনা কাণ্ড থেকে শুরু করে যেসব ঘটনা ঘটেছে- তা ভয় ঢুকিয়েছে মনে। সাম্প্রতিক সময়ে আবজাল হোসেন, অফিস সহকারীর মতো সাধারণ পদে থেকেও তার দুর্নীতি প্রমাণ করে, ইচ্ছে করলেই অসৎ হওয়া কতটা সহজ। স্বাস্থ্যখাত যেন অবৈধকাজের প্রাণকেন্দ্র। কয়েক কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের একাধিক মামলায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের এই কর্মচারী এখন কারাগারে। তার মতো কত আবজাল হোসেনের বিচরণ এই খাতে তা বলাই বাহুল্য। তাই ভ্যাকসিন নিয়েও যে কাণ্ড হবে না, তা নিয়ে আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই। তাই জনগণের কাছে ভ্যাকসিন সংক্রান্ত আগামীর করণীয় পরিষ্কার করার সময় এসেছে।
আরও একটি কথা আছে, একাধিক দেশের ভ্যাকসিন এলে, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সাধারণ জনতার মধ্যে এর বণ্টন পদ্ধতি কি হবে? নাকি সমাজতন্ত্রের মতো, সবার জন্য সমান অগ্রাধিকার মিলবে? আমাদের দেশে কোনো কিছুই সমান অধিকারে নেই। অর্থবানরা বেশি সুবিধা পান, ক্ষমতাসীনরা নিজেরটা আগে নিশ্চিত করেন- তারপর কিছু বাচলে পায় আপামর জনতা। কিন্তু ভ্যাকসিন নিয়ে যেন এমনটা না হয়।
সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনসের (জিএভিআই) সদস্য হওয়ার আগ্রহ প্রকাশের মাধ্যমে সরকার বহুল কাঙ্খিত ভ্যাকসিন পাওয়ার পথে খানিকটা অগ্রসর হয়েছে। করোনার ভ্যাকসিন বিনামূল্যে দেয়া হবে, নাকি উৎপাদন খরচের কিছুটা নেয়া হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সেপ্টেম্বরে বোর্ড মিটিংয়ে বসবে সংস্থাটি। সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে ‘সবার জন্য টিকা’ নিশ্চিত করতে। এছাড়া চার হাজার ডলারের কম জিডিপির দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ তার প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনের ২০ শতাংশ পেতে পারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ও জিএভিআইয়ের কাছ থেকে। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে এখনও বাংলাদেশ খুব একটা গুছিয়ে উঠতে পারেনি। এ জন্য একটি নীতিমালার প্রয়োজন খুব। জাতীয় ভ্যাকসিন নীতিমালার দাবি জানাচ্ছি।
বিশ্বে ২০৩টিরও বেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বর্তমানে আটটি প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দৌড়ে এগিয়ে। শেষ পর্যায়ের ট্রায়ালে থাকা এই আট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছয়টি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত। এই ছয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের পররাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন। দুই মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে খোলা যেতে পারে ‘ভ্যাকসিন ডেস্ক’। কারণ এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও জোরালো না হলে আমরা পিছিয়েই থাকবো।
অনেক আগে থেকেই ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলি, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি দেশে চীনের ভ্যাকসিন ট্রায়াল চললেও বাংলাদেশ এই সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি করেছে। চীন বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা অনেক আগে বলেছে। চীনের কোম্পানি সিনোভ্যাকের তৈরি ভ্যাকসিন নিয়ে তাই আরও গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত।
মূলত ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হার্শ বর্ধন শ্রিংলার সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের পর, অনেকটা দিল্লির সুরে কথা বলছে ঢাকা। চীন, রাশিয়ার ভ্যাকসিনের থেকেও ভারতের আশা মনে হয় খুব বেশি করা হচ্ছে। আমরা আসলে কোন পথে যাবো তা নির্ধারণ করা জরুরি। সঠিক দাম, সঠিক সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিতে হবে এই ইস্যুতে। কারণ ভ্যাকসিন ইস্যুটি এখন আন্তর্জাতিক বিষয়, এটাকে আন্তর্জাতিকভাবে বিবেচনা করতে হবে। যদিও এ নিয়ে মূল সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর ওপর।
সরকারের ঊর্ধ্বতনরা বলছেন, ভ্যাকসিন একমাত্র প্রতিষেধক নয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অস্ত্র এটাই। তাই এটাকে গুরুত্ব কম দেয়ার জো নেই। লাতিন দেশগুলো তুলনামূলক কম ধনী, তাদের অভাব রয়েছে অথচ তারা কিন্তু বিশ্ব ভ্যাকসিন কূটনীতিতে অনেকটা এগিয়ে আছে। নিয়মিত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পাশাপাশি তাদের দেশ যাতে ভ্যাকসিন দ্রুত পায়, তা নিশ্চিত করতে চুক্তি করে রেখেছে। আর আমরা কিসের আশায় যেন, সময় অতিবাহিত হতে দিচ্ছি!
লেখক: টেলিভিশন সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
s.iftekhar.msj@gmail.com