নির্বাচনী ইশতেহারে মশক নিধনে কার্যকর ঘোষণা না থাকায় ভোটের সময়ই এ নিয়ে সমালোচনার মুখে ছিলেন রেজাউল করিম চৌধুরী। তবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র পদে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই নগরবাসীর চাপে মশক নিধনে ওষুধ ছিটিয়ে ১০০ দিনের অগ্রাধিকার কর্মসূচি শুরু করেছেন তিনি। কিন্তু এবার প্রশ্ন উঠছে সেই ওষুধ নিয়েই। নগরবাসী জানতে চাইছেন, ওষুধ ছিটানো নিয়ে এতো হাঁকডাক, সেই ওষুধইবা কতটুকু কার্যকর?
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে মশক নিধনের ওষুধ সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। একই প্রতিষ্ঠান থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও ওষুধ সংগ্রহ করতো। গত বছর ঢাকায় ছিটানো ওষুধ পরীক্ষা করে ‘অকার্যকর’ বলেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি)। ফলে ঢাকায় ‘অকার্যকর’ ঘোষিত ওষুধ চট্টগ্রামে কতোটা কার্যকর হবে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
অন্যদিকে গত বছর ওষুধ ছিটানোর পরও মশার উৎপাত না কমায় পরীক্ষার জন্য ডিসেম্বরে বিসিএসআইআর (বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ) গবেষণাগারে লার্ভিসাইড (মশার ডিম ধ্বংসকারী ওষুধ) এবং এডালটিসাইড (পূর্ণাঙ্গ মশা ধ্বংসকারী) পাঠায় চসিক কর্তৃপক্ষ। তবে সে সময় সংস্থাটি চসিককে জানায়, মশার ওষুধের গুণগত মান তাদের ল্যাবে পরীক্ষা করা হয় না। এ অবস্থায় নতুন মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পর আবারও মশক নিধনে ওষুধ ছিটানো কর্মসূচি শুরু হলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে খোদ সিটি মেয়রেরও।
মশক নিধনে ছিটানো ওষুধ কতটুকু কার্যকর, জানতে চাইলে চসিক মেয়র এম রেজাউল করিম বলেন, ‘বিষয়টি আপনারা চিন্তা করার আগে আমরা চিন্তা করেছি। ওষুধটি কেন ইফেক্টিভলি কাজ করছে না সেটা জানতে ঢাকায় টিম পাঠাচ্ছি। ঢাকা যে ওষুধটি ইউজ (ব্যবহার) করছে, সেটির সঙ্গে এটির কোনো ডিফারেন্স (পার্থক্য) আছে কি-না সেটা আমরা তদারকি করে ব্যবস্থা নেব।’
অবশ্য চসিকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দাবি করেন, কয়েক দফা পরীক্ষা শেষে সরবরাহকৃত ওষুধ স্টোরে ঢোকানো হয়। তাই ওষুধ অকার্যকর হওয়ার সুযোগ নেই।
তবে মেয়র ও চসিক কর্মকর্তাদের এসব বক্তব্য মন ভরাতে পারছে না নগরবাসীর। ওষুধ অকার্যকর জেনেও তা ছিটানো নিয়ে সিটি করপোরেশনের এতো তোড়জোড় নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তারা।
নগরের প্রাণকেন্দ্র জামাল খান এলাকার বাসিন্দা অনামিকা রায় ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘ওষুধ ছিটানো আর ক্রাশ প্রোগ্রামের নামে বছরে দুই-একবার আইওয়াশ করাই সিটি করপোরেশনের বাৎসরিক কর্মসূচি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘরের পাশের নালাটি আবর্জনায় বন্ধ হয়ে আছে বছরের পর বছর, কখনো পরিষ্কার করতে দেখলাম না। ওই নালাতে মশা না জন্মে কী জন্মাবে? আর যে ওষুধ ছিটানো হয়, তাতে তো মশা মরে না।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মশক নিধনে এডালটিসাইড ও লার্ভিসাইড নামে দুই ধরনের ওষুধ ছিটানো হয়। গত দুই অর্থবছরে এক কোটি তিন লাখ টাকার কীটনাশক ‘এডালটিসাইড’ ও ৯৯ লাখ টাকা খরচ করে মশার লার্ভা ধ্বংসকারী ‘লার্ভিসাইড’ কিনেছে চসিক। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে মশক নিধনে বরাদ্দ ছিল ছয় কোটি টাকা। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ বরাদ্দ ছিল এক কোটি ২৫ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ বরাদ্দ ছিল এক কোটি ১০ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছিরের দায়িত্ব পালনকালে শেষ চার বছরে মশক নিধনে খরচ করা হয়েছে ছয় কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
নাগরিক সমাজের বক্তব্য, প্রতিবছর ঘটা করে মশক নিধন কার্যক্রমের উদ্বোধন ও কোটি কোটি টাকার ওষুধ ছিটানের কথা বলা হলেও এসব কোনো কাজেই আসেনি।
সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সময় চার বছরে মশক নিধনে প্রায় ছয় কোটি টাকা খরচ হয়
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের দাবি, মশক নিধনে প্রতি ওয়ার্ডে দৈনিক চারজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ওষুধ ছিটান। অথচ জনসাধারণ বলছে, ওষুধ ছিটাতে দেখেন না তারা। আবার কেউ কেউ বলছেন, চসিকের দাবি সত্য হলেও মশার উৎপাত কমছে না কেন? তাহলে এতো ঘটা করে কি অকার্যকর ওষুধই ছিটানো হচ্ছে?
গত ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে জয়ী হন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী। ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেন। নির্বাচনের আগে ২৩ জানুয়ারি রেজাউল ৩৭ দফার ইশতেহার ঘোষণা করেছিলেন। এতে প্রধান প্রতিশ্রুতি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন জলাবদ্ধতা নিরসনকে। ঘোষণা করেছিলেন, ১০০ দিনের অগ্রাধিকার কর্মসূচিও। এ সময় নির্বাচনী ইশতেহারে মশক নিধনে কার্যকর ঘোষণা না থাকায় তখনই সমালোচনার মুখোমুখি হন তিনি।
তবে দায়িত্ব গ্রহণের দিন সুধী সমাবেশে রেজাউল প্রথম কাজ হিসেবে মশা নিধনের ঘোষণা দেন। ২০ ফেব্রুয়ারি নিজ এলাকা নগরীর চান্দগাঁও ওয়ার্ডে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ১০০ দিনের কর্মসূচি শুরু করেন।
চসিকের প্রধান নির্বাহী কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক বলেন, ‘মেয়রের নির্বাচনী ইশতেহার এখন চসিকের ইশতেহার। ইশতেহারের ১৫ নং অনুচ্ছেদে নগরকে মশামুক্ত করতে পরিবেশবান্ধব কীটনাশক ছিটানো, পুকুর, ডোবা, খাল-নালা, জলাশয় পরিষ্কারের কথা উল্লেখ আছে। মেয়রের নির্দেশে এখন থেকে এই কর্মসূচিকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করা হবে।’