প্রত্যয় নিউজডেস্ক: জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা সঙ্কটে প্রয়োজন রাজনৈতিক সমাধান যা মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। আর এ প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে সমস্যার মূল কারণগুলোকে চিহ্নিত করে তা নিষ্পত্তি, যথোপযুক্ত পরিবেশ তৈরি এবং দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে’।
তিনি ১৬ সেপ্টেম্বর ‘রোহিঙ্গা সমস্যার সাম্প্রতিক চার বছর: টেকসই সমাধান নিশ্চিতের চ্যালেঞ্জসমূহ’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সাইড ইভেন্টে এসব বলেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৫তম অধিবেশন উপলক্ষে বাংলাদেশ, কানাডা, সৌদি আরব ও তুরস্ক ইভেন্টটির আয়োজন করে।
ভার্চুয়াল এই ইভেন্টটি জাতিসংঘের সদস্য দেশ, জাতিসংঘ সদর দফতর ও এর সংস্থা, সিভিল সোসাইটি ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধির বিপুল উপস্থিতি, তাদের বক্তব্য, পরামর্শ ও সংশ্লিষ্ট নানা উপস্থাপনার কারণে ভিন্ন মাত্রা পায়। আলোচনা পর্বে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন মিয়ানমার বিষয়ক স্বাধীন তদন্ত প্রক্রিয়া (আইআইএমএম)-এর প্রধান নিকোলাস কৌমজিয়ান।
পর্বটির সঞ্চালক ছিলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত কানাডার স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত বব রায়। ইভেন্টটিতে আরও বক্তব্য দেন গাম্বিয়ার বিচার মন্ত্রণালয়ের আইন-উপদেষ্টা হুসেইন থামাসি, সংঘাতকালে যৌন সহিংসতাবিষয়ক জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি মিজ প্রমিলা প্যাটেন, নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের পরিচালক মিজ রুভেন মেনিক দিওলা, ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিজে গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের মধ্যকার মামলার গাম্বিয়া পক্ষের আইন উপদেষ্টা ড. পায়াম আখওয়ান, গ্লোবাল সেন্টার ফর রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্টের নির্বাহি পরিচালক ড. সাইমন অ্যাডামস্, গ্লোবাল জাস্টিজ সেন্টারের প্রেসিডেন্ট মিজ্ আকিলা রাধা কৃষ্ণান, আরাকান রোহিঙ্গা ইউনিয়নের মহা-পরিচালক ড. ওয়াকার উদ্দিন।
এছাড়া জাতিসংঘে নিযুক্ত সৌদি আরব, তুরস্ক, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস ও ইন্দোনেশিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি ও প্রতিনিধিরা সাইড ইভেন্টটিতে বক্তব্য দেন।
ইভেন্টটিতে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসী সিদ্ধান্ত ও সর্বোচ্চ মানবিক উদারতা প্রদর্শনের মাধ্যমে সীমান্ত উন্মুক্ত করে নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও সুরক্ষা দিয়েছেন মর্মে উল্লেখ করেন তিনি। অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে মিয়ানমারের ব্যর্থতার কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সৃষ্ট বর্তমান অচলাবস্থার কথা তুলে ধরেন রাষ্ট্রদূত ফাতিমা।
রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি অবনতির বিষয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে চলমান এ সঙ্কটের বহুমাত্রিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করে এবং তা আমলে নিয়ে এর স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানকল্পে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি।
দায়বদ্ধতা নিরুপনের বিষয়টির উদাহরণ টেনে তিনি আইআইএমএমসহ আন্তর্জাতিক তদন্ত ও জুডিশিয়াল প্রক্রিয়াসমূহকে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা এবং এই নৃশংস অপরাধের ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিকার নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানান।
এছাড়া রোহিঙ্গা সঙ্কটের মূল কারণ খুঁজে বের করতে আসিয়ানসহ আঞ্চলিক অন্যান্য দেশগুলিকে আরও জোরদার ভূমিকা রাখার আহ্বানও জানান রাষ্ট্রদূত ফাতিমা।
২০১১ সাল থেকে মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণসমূহ ও তথ্যাদি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষসহ অন্যান্য অংশীজনদের কাছ থেকে সংগ্রহের জন্য আইআইএমএম-এর প্রধান হিসেবে যে সকল প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছেন তা তুলে ধরেন নিকোলাস কৌমজিয়ান। আইআইএমএম-এর কাজ পূর্ণ করতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানকারী দেশসমূহের কাছে যেসব তথ্য রয়েছে তা আইআইএমএমকে সরবরাহ করার অনুরোধ জানান তিনি।
রোহিঙ্গা ইস্যুটি কানাডা সরকারের ধারাবাহিক অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত একটি বিষয় উল্লেখ করে কানাডার স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত বব রায়। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিজের আওতাধীন বিচারকার্যসহ দায়বদ্ধতা নিরূপণ প্রক্রিয়াগুলোতে তার সরকারের সমর্থন রয়েছে মর্মে জানান তিনি।
এ সমস্যার মানবিক ও রাজনৈতিক সমাধানের জন্য তিনি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সমর্থনের আহ্বান জানান। সঙ্কটের শুরুতেই পূর্ণ মানবিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে আশ্রয় দিয়ে এবং এ পর্যন্ত এই বোঝা বহন করে বাংলাদেশ যে উদারতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে তার ভূয়সী প্রশংসা করেন সৌদি আরব ও তুরস্কের স্থায়ী প্রতিনিধিরা।
রোহিঙ্গা নারীদের প্রতি যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতাসহ ভয়াবহ এই অপরাধের দায়ভার নিরূপণের প্রতি জোর দেন যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত। রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের উপর গুরুত্বারোপ করেন ইউরোপিও ইউনিয়নের অ্যাম্বাসেডর।
অন্যান্য বক্তারা সূদীর্ঘ এই মানবিক সমস্যা দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানে উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা।
বক্তারা বলেন, এর ফলে বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ব্যাপক হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। দায়বদ্ধতা নিরূপণ এবং দায়ীদের বিচার করা গেলে বাস্ত্যুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মধ্যে মনোবল ফিরে আসত এবং তাদের শান্তি ও মর্যাদাপূর্ণ ভবিষ্যতের পথ সূগম হতো মর্মে মন্তব্য করেন আলোচকরা।
রোহিঙ্গাদের উপর সৃষ্ট মানবিক অধিকারের বিরুদ্ধে অপরাধসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে চলমান তদন্ত ও অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়াসমূহে সহযোগিতা প্রদানার্থে সদস্য দেশসমূহের প্রতি আহ্বান জানান তারা। নাগরিকত্ব আইন ও অন্যান্য বিধি-বিধানের পূর্ণ সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ বঞ্চনা থেকে মুক্তি দান এবং এ সঙ্কটের মূল কারণ চিহ্নিত করার উপর জোর দেন স্থানীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা।
বক্তারা রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এর ফলে অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে পারে। বিষয়টি আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিকভাবে মারাত্মক সমস্যা আকারে দেখা দেওয়ার আগেই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার এক্ষেত্রে জরুরিভাবে দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানান বক্তারা।