“লকডাউনে জীবনের প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের বিভিন্ন কৌশলে দিনযাপন”
নিলয় রহমান, বিশেষ প্রতিনিধি, কালিগঞ্জ, গাজীপুর: সারা দেশে চলছে একযোগে লকডাউন। থামতে গিয়েও থামতে পারছেনা অনেকেই, জীবন সংগ্রামে আজ সবাই মরিয়া। রোজা চলছে, রোজা শেষে হলে ঈদ আসন্ন, সব টাকা বিনিয়োগ হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। দোকান পরিপূর্ণ পন্যদ্রব্যে। শুধু তাই না কোনো কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান পরিপূর্ণ কর্মচারীতে। মাস গেলে তাদেরকে দিতে হবে বেতন, বোনাস, দোকান মালিকের দোকান ভাড়া। তার উপর আত্মীয় স্বজনদের চাহিদা পূরন, নিজের পরিবারের চাহিদা পূরন, বৃদ্ধ বাবা মায়ের চিকিৎসা, কাজের মানুষের হক আদায়, যাকাত, ফিতরা, রংবাজদের বকশিস ইত্যাদি ইত্যাদি।
এছাড়া প্রশাসনের কড়া নজরদারি, বিশেষ কিছু দোকান ব্যতীত অন্য কোন দোকানপাট খোলা যাবে না, তার পরেও সব ব্যবসায়ীদের মরন কামড়। তাই অনেক ব্যবসায়ীরা কৌশলে চালাচ্ছেন ব্যবসা।বিশেষ করে শহরের দোকানদারগণ এক সাটার খোলা রেখে বাকি সব সাটার বন্ধ করে ব্যবসা চালানোর চেস্টায়রত। চোর পুলিশ খেলা চলে সারাদিনব্যাপী, দোকান কর্মচারীদের সব খেয়াল রাখতে হয় কখন মোবাইল কোর্ট চলে আসে! একজন বাইরে পাহাড়া দেয়, মোবাইল কোর্ট আসা মাত্রই সাংকেতিক সিগন্যাল আসে এক কর্মচারী থেকে আরেক কর্মচারী, এভাবে মালিক পর্যন্ত। নিমিষেই সাটার ক্লোজ। অন্যদিকে বিক্রি বাড়াতে কাষ্টমারদেরকেও খেয়াল রাখতে হয় এবং কাস্টমার আসা মাত্রই কৌশলে দোকানে ঢুকানো হয়। সব কাস্টমারদের সাধ ও সাধ্য এক না হওয়ায় এবং নিজেদের প্রয়োজনে প্রায়ই বিভিন্ন অজুহাতে ঘর থেকে তারাও বের হয়ে আসে এসব দোকানের পন্য কিনতে। সবার উদ্দেশ্য এক, প্রয়োজন মেটানো। সন্তানের জন্য, মা-বাবার জন্য, দেশের মানুষের চাহিদা যোগানোর জন্য, ভবিষ্যতের জন্য, জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য।
সবাই জানে করোনার ছোবল কতটা ভয়ংকর! তার চেয়ে ভয়ংকর ক্ষুধা! তাই ক্ষুধার তাড়নায়, খাবার যোগাঢ় করতে দিনমজুরগণ বাধ্য হয়ে কাজের খোজে বের হয়ে পড়ছে৷ যার যার মত করে অর্থ উপার্জনের চেস্টা করে চলছে। চাকরীজীবিগণ নিজের চাকরী বাঁচাতে ও পরিবারের চাহিদা মেটাতে তাই ঝুকি নিয়েই এবং বাধ্য হয়েই অর্থ উপার্জরনেরর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। মালিকগণও কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে ও নিজের লোকসান কমাতে এসব চোর পলিশ খেলার মতো করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। না খেয়ে কি বাঁচা যাবে? না বাঁচা যায়! অর্থ উপার্জন করতেই হবে। তাই সবারই প্রচেস্টা প্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে জীবনের চাকাকে সচল রাখা, প্রয়োজনীয় খাবার সামগ্রী কেনা। তাইতো এতো বিধি নিষেধ সত্বেও, জীবনের ঝুকি নিয়ে তারা বাড়ির বাইরে চলে আসছে।
আজকাল আর ১ম লকডাউনের মতো ত্রান বিতরণ বা দান দক্ষিনাও হচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ফেইস বুকিং এ ত্রাণ বিতরণের প্রতিযোগিতা। এতে নিম্ন আয়ের মানুষজন অসহায় হয়ে পড়েছে। তাই অনেক মানুষ বাধ্য হয়ে সরকারি বিধিনিষেধ কৌশলে উপেক্ষা করে চলেছে। দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে সবাই। এর পর যদি তৃতীয় ঢেউ আসে, তখন কি হবে এই গরীব দেশের, এই নিম্ন আয়ের মানুষদের!
সবার আয় কমে যাচ্ছে সবাই তাদের আয় ধরে রাখতে চাচ্ছে। মানুষ বের হতে পারছে না, রিক্সাওয়ালা পাচ্ছে না যাত্রী, গার্মেন্টস মালিক পাচ্ছে না বায়ার/ক্রেতা, খাবার ব্যবসায়ী পাচ্ছে না ভোক্তা, দিনমজুর পাচ্ছেনা কাজ! এভাবে চলতে থাকলে কি হবে কাল? এই দেশের গরীব মানুষেরা কিভাবে দিন পার করবে, কেউ কি ভাবছেন! কিন্তু এই ভাবনা ই কি সব? থাক লকডাউন, হোক চিকিংসা, জমানো টাকা শেষ হয়ে গেলে পরে কি হবে? আয় কিভাবে হবে? ব্যয় কমেছে কিন্তু মিনিমাম ব্যয় তো কমানো যাবে না। তার উপর করোনায় প্রতিদিনই মরছে শত শত মানুষ, আক্রান্ত হচ্ছে কয়েক হাজার। এর সমাধানের পথ কি শুধুই লকডাউন, বিধিনিষেধ টহল, জরিমানা, শুধুই ঘরে থাকা। সাবান দিয়ে হাত ধৌত করতে করতে হাতের ভাগ্য বদলে যাচ্ছে কিন্তু তিন বেলা খাবার, ভবিষ্যত সবই অনিশ্চয়তার মুখে।
কত স্কুল বিক্রি হয়ে গেছে এক বছরে, কতো রেষ্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে গত এক বছরে, কতো শিক্ষক অটো চালাচ্ছে, কতো নামি দামি শেফ চায়ের দোকানি হয়ে গেছে, কতো গার্মেন্টস কর্মী যৌন কর্মী তে পরিনত হচ্ছে ক্ষুদার তাড়নায়, কতো স্কুল পড়োয়া নাবালিকা বাল্য বিয়ের শিকার হচ্ছে, কতো ফকির ভিক্কাবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে পাগল হয়ে রাস্তা ঘাটে আবোল তাবোল বকছে, কতো ফুটবলার এই দেশে দিন মজুরের কাজ করছে! সবই এই করোনা পরিস্থিতির জন্য। এগুলোকে ওভারকাম করে স্বাভাবিক জীবনে আমরা কবে ফিরব জানিনা। মাসের শেষে অনেকেই অটো বেতন পাচ্ছেন। একবার ভাবুন। বাকিরা কেমন আছেন। আমাদের চিন্তা শক্তিতেও করোনা নামক ভাইরাস ইফেক্ট করে ফেলেছে। সামাজিক দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছে, জনসমাগম বেশি হয়ে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে মৃত্যুর হারও, সাথে দ্রারিদ্রতাও। আমাদের কাউকেই কি কিছু বলার নেই! কারও কিছু করণীয় নেই? শুধু সরকারের দিকে চেয়ে থাকলে হবে? আমাদের সমাজের সামর্থ্যবান ও বিত্তবান ব্যক্তি, বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সংস্থা সহ সবাইকে সরকারের পাশাপাশি এগিয়ে আসা উচিত, নইলে এই সংকট কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবেনা। সাধারণ মানুষকে ঘরে রাখতে হলে, জনসমাগম এড়াতে হলে তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর মানুষজন বাইরে আসা টেকাতে না পারলে এই করোনা ভাইরাস মহামরীর রূপ ধারণ করবে।
এই দ্বিতীয় ঢেউ ভালভাবে সামলাতে না পারলে কখন যে তৃতীয় ঢেউ এসে সজোরে আমাদের বুকে আঘাত হানবে বলা যায়না, তাই শক্ত হাতে দ্বিতীয় ঢেউকে মোকাবেলা করার এখনই সময়।