শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:২৮ পূর্বাহ্ন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ভারতের মধ্যপ্রদেশে সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে একের পর এক শিশুমৃত্যুর ঘটনা স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের হতবাক করে তোলে। এক থেকে ছয় বছর বয়সী অন্তত ১১টি শিশু সাধারণ কাশির সিরাপ সেবনের কয়েক দিনের মধ্যেই মারা যায়।
ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে প্রথমে খাবার পানি ও মশাসহ নানা কারণ খতিয়ে দেখা হয়। পরে পরীক্ষায় জানা যায়, আক্রান্ত শিশুদের কিডনি বিকল হয়েছিল।
চেন্নাইয়ের একটি সরকারি পরীক্ষাগার নিশ্চিত করে, সংশ্লিষ্ট কাশির সিরাপে ছিল ৪৮.৬% ডাইথাইলিন গ্লাইকোল, একটি বিষাক্ত শিল্প দ্রাবক, যা ওষুধে থাকা মোটেই উচিত নয়।
এদিকে শুধু মধ্যপ্রদেশ নয়, পার্শ্ববর্তী রাজ্য রাজস্থানেও একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। স্থানীয়ভাবে তৈরি ডেক্সট্রোমেথোরফান সিরাপ খাওয়ার পর আরও দুই শিশু মারা যায়। কাশি প্রশমনের জন্য ব্যবহৃত ওই সিরাপ কিন্তু ছোট বাচ্চাদের জন্য একেবারেই নিরাপদ নয়। শিশু মৃত্যুর ঘটনা মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং বিষয়টি নিয়ে সরকারি তদন্ত শুরু হয়।
এদিকে বছরের পর বছর ধরে ভারতে তৈরি কাশির সিরাপগুলোতে ডাইথিলিন গ্লাইকোলের উপস্থিতি বহু শিশুর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। অভিযোগ ওঠে, ২০২৩ সালে গাম্বিয়ায় ৭০ জন ও উজবেকিস্তানে ১৮ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছিল ভারতীয় সিরাপের বিষাক্ত উপাদানের কারণে। ২০১৯ সালের শেষ থেকে ২০২০ সালের শুরু পর্যন্ত কাশ্মীরের জম্মু অঞ্চলেও অন্তত ১২ শিশুর মৃত্যু হয় একই কারণে।
অতীতে, কোডিনযুক্ত কাশির সিরাপগুলোর অপব্যবহারও হয়েছে। এর প্রতি আসক্তি তৈরি হওয়ারও সম্ভাবনা দেখা যায়। ছোট বাচ্চাদের জন্য এই জাতীয় কাশির সিরাপ দেওয়া উচিৎ নয়। কিন্তু প্রতিবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও দূষিত কাশির এই সিরাপগুলো বাজারে আবার হাজির হয়, যা প্রমাণ করে যে ওষুধের বাজারের পরিস্থিতি আসলে কী।
মার্কেট রিসার্চ ফিউচার নামক সংস্থার তথ্য অনুসারে, ভারতীয় কাশির সিরাপের বাজার ২০২৪ সালে ২৬২.৫ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০৩৫ সালের মধ্যে ৭৪৩ মিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। অর্থাৎ ৯.৯% চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এর কিছুই ঘটবে না যদি ভারত এবং ভারতীয়রা কাশির সিরাপের প্রতি নিজেদের আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে পারে।
দশকের পর দশক ধরে চিকিৎসকরা রোগীদের এই ওষুধ লিখে গিয়েছেন এবং তারা তা সেবনও করেছেন। তবে এর মধ্যে বেশিরভাগই উপকার করার বদলে শরীরের গুরুতর ক্ষতি করতে পারে।
গলা ব্যথা এবং ক্রমাগত হতে থাকা কাশির দ্রুত নিরাময়ের জন্য বাজারজাত এই মিষ্টি সিরাপগুলো আসলে অ্যান্টিহিস্টামাইনস, ডিকনজেস্ট্যান্টস, এক্সপেক্টোরেন্টসের ককটেলের সঙ্গে চিনি ও রঙের মিশ্রণ।
মুম্বাইয়ের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রাজারাম ডি. খারে বলেন, শহরাঞ্চলে শিশুদের দীর্ঘস্থায়ী কাশির প্রধান কারণ সংক্রমণ নয়, বরং দূষণ ও অ্যালার্জি। এই শিশুদের প্রায়শই ঠান্ডা লাগে বা নাক দিয়ে পানি পড়ে এবং কাশি হয় যা রাতে বা ভোরের দিকে বাড়ে। তবুও অধিকাংশ চিকিৎসক কাশির সিরাপ লিখে দিচ্ছেন- যা অস্থায়ী স্বস্তি দেয় কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ।
ডা. খারে জানিয়েছেন, বড় শহরগুলোতে ধুলো এবং ধোঁয়াশা এই জাতীয় পুনরাবৃত্তির সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলে। কখনও কখনও হালকা ব্রঙ্কোস্পাজমও (শ্বাস নিতে সমস্যা) দেখা যায়। এই ধরনের কাশির ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হলো ব্রঙ্কোডিলেটর। এই ওষুধ যা শ্বাসনালীর পথ খুলে দেয়। ইনহেলার বা নেবুলাইজারের মাধ্যমে এই ওষুধ শরীরে যায়। যদিও অনেক ডাক্তারই এখনও কাশির সিরাপের উপরই নির্ভর করেন যা সাময়িক আরাম দেয়।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাচ্চাদের মধ্যে যে কাশি দেখা যায় তা ভাইরাল, সেল্ফ- লিমিটিং (নিজেই ঠিক হয়ে যায়) এবং এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। ফিজিশয়ানদের মতে কোনো কাশির সিরাপই এই সময়সীমা কমিয়ে ফেলতে পারে না। খুব বেশি হলে ক্ষণিকের আরাম দেয়। এর সবচেয়ে খারাপ ফল হতে পারে এর প্রতি আসক্তি, এটি বিষাক্ত হতে পারে এবং ওভারডোজের ঝুঁকিও থাকে।
গ্রামাঞ্চলে এই সমস্যা আরও গভীর। গ্রামীণ ভারতে, ৭৫% প্রাথমিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিদর্শন পরিচালনা করেন অনানুষ্ঠানিক সরবরাহকারীরা। প্রায়শই দেখা যায় সেল্ফ-টট (নিজে নিজে শেখা) আরএমপি (রেজিস্টার্ড মেডিক্যাল প্র্যাক্টিশনার) চিকিৎসা করছেন বা আনুষ্ঠানিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ কেউ রোগী দেখছেন।
যেখানে স্থানীয় জনস্বাস্থ্য ক্লিনিক অনেক দূরে, কর্মী সংখ্যা কম বা ক্লিনিক বন্ধ, সেখানে কার্যত এরাই সর্বেসর্বা এবং তাদের কাছে সবচেয়ে বিশ্বস্ত সরঞ্জাম হলো এই কাশির সিরাপগুলো।
উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুর শহরে পোস্টিং ছিল শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কাফিল খানের। সেই সময়কার অভিজ্ঞতা স্মরণ করে তিনি বলেন, যত্রতত্র সিরাপ দিয়ে দেওয়া হতো-এমনকি যাদের ডিগ্রি নেই তারাও দিত।
অনেক দরিদ্র রোগী পরামর্শের জন্য স্থানীয় ওষুধের দোকানদারের কাছে যান। তারা ধরে নেন, কাউন্টারের অন্যপ্রান্তে থাকা ব্যক্তি একজন ফার্মাসিস্ট। গ্রামীণ ভারতে দশের মধ্যে দশ ক্ষেত্রেই দেখা যাবে এই ধারণা ভুল, বলেছেন সাবেক ভারতীয় ড্রাগ এক্সিকিউটিভ দীনেশ ঠাকুর। বর্তমানে তিনি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
সূত্র- বিবিসি বাংলা