ধর্ম ডেস্ক: এনায়েতুল্লাহ ফাহাদ
ঈদ একটি উৎসব। একটি ইবাদত। একটি পবিত্র খুশির দিন। সাম্য ও সম্প্রীতির চিহ্ন। মোমিন-হৃদয়ের আনন্দ। যেই উল্লাসে মাতোয়ারা প্রতিটি মোমিন হৃদয়। হৃদয় মাঝে বয়ে যায় ঈদ-বসন্তের হিমেল হাওয়া। শিউরে ওঠে দেহের প্রতিটি লোমকণা। আনন্দে মেতে ওঠে নগর থেকে শহর, পল্লী থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল। ঈদ উৎসবের মাঝে নেই কোনো ভেদাভেদ। আমরা সবাই সমান। ধনী-গরিব,কৃষক-শ্রমিক, কুলি-মজুর সবাই ভাই ভাই। আনন্দ অধিকারে সবাই এক। এ আনন্দ হবে নিজের মনের হিংসা, ঘৃণা, লোভ, অহংকার, অহমিকা, আত্মম্ভরিতা, আত্মশ্লাঘা, রাগ-ক্রোধ, বিদ্বেষসহ যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করার। এ উৎসব হবে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ঐক্য, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির। আমরা মুসলমান। আমাদের বার্ষিক উৎসব ঈদ।
ঈদ আরবি শব্দ। যার শব্দমূল—‘আউদ’। এর অর্থ হলো—বারবার ফিরে আসা। ‘ফিতর’ শব্দের অর্থ ভেঙে দেওয়া, ইফতার করা। খণ্ডিত দুটি শব্দ মিলে ঈদুল ফিতরের অর্থ সেই আনন্দঘন উৎসব, যা বারবার ফিরে আসে। যেহেতু উৎসবটি মুসলমানদের জীবনে বছর ঘুরে ফিরে আসে। সবাই একত্র হয়ে উদযাপন করে। তাই দিনকে বলা হয় ঈদ। ঈদ শব্দ চয়নে এ উৎসবের নাম রাখার তাৎপর্য হলো, রাব্বুল আলামিন এ উৎসবে তাঁর বান্দাদের নেয়ামত ও অনুগ্রহ দ্বারা বারবার ধন্য করেন। দান করেন অশেষ রহমত। অপরদিকে ঈদ শব্দের অন্য একটি অর্থ—খুশি বা আনন্দ উৎসব। আর মুসলমানদের জন্য রয়েছে বছরে দুটি আনন্দের দিন—ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এ দুটি দিবসই অত্যন্ত মর্যাদাশীল, আনন্দ ও খুশির। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর মুসলিম উম্মাহর জন্য খুশির সওগাত নিয়ে আসে ‘ঈদ’।
ঈদুল ফিতর। এটি একাধারে যেমন আনন্দোৎসব, তেমন ইবাদতও। ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদ মানেই হাতে হাত রেখে মুসাফাহা। এই আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য। ত্যাগ-মহিমার শিক্ষা। ভেদাভেদ ভুলে যাওয়ার মনোবল। শ্রেণিবৈষম্যের মূলোৎপাটন। বুকে বুক রেখে কোলাকুলি । হাসিমুখে ঈদের শুভেচ্ছা, তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা। এ আনন্দ যেন আল্লাহর রহমত ও ক্ষমাপ্রাপ্তির। জাহান্নাম থেকে মুক্তির। এ আনন্দ সিয়াম-কিয়ামের শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতার। এ আনন্দে নেই কোনো অশ্লীলতা ও পাপ-পঙ্কিলতা। এ আনন্দে আছে শুধুই সওয়াব আর পুণ্যময়তা।
পর্যায়ক্রমে এ আনন্দ সংক্রমিত হতে থাকে হৃদয় থেকে হৃদয়ে। সদ্যঃপ্রসূত শিশু থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ-বৃদ্ধ-বণিতা পর্যন্ত । ঈদের ছোঁয়ার পরশ লাগে সব মোমিনের দেহে। হতদরিদ্র, এতিম, দুস্থ, নিঃস্ব ও শত শত ছিন্নমূল মানুষের মুখেও হাসি ফোটে কিছু ঈদ সামগ্রী পেয়ে। তাই মুসলমানরা গরিব আত্মীয়-স্বজনের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ান। খবর নেন নিজের পরিবারের পাশাপাশি তাদেরও । কেনাকাটা করেন ঈদের নতুন পোশাক। বছরজুড়ে খোঁজ না নিলেও ঈদের সময় বাদ পড়ে না যোগাযোগ। ছুটে যান শহর ছেড়ে পল্লীগ্রামে। যেখানে আছেন মমতাময়ী মা-বাবা, ভাই-বোনসহ আত্মীয়-স্বজনের আনাগোনা। ভুলে যান সব মান-অভিমান, ঝগড়া বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষের কথা।
একসঙ্গে পায়ে হেঁটে যান ঈদগাহে। বসে যান সারিবদ্ধ জায়নামাজে। সেজদারত হন সৃষ্টিকর্তা মহান রবের তরে। সাম্য ও সম্প্রীতির কী এক অপূর্ব দৃশ্য! এ যেন একই পাখির দুটি ডানা। ঐক্যের অটুট বন্ধন। এভাবেই মুসলিম সম্প্রদায়ের সর্বশ্রেণির মানুষ এ উৎসবে মেতে ওঠে অনাবিল আনন্দে। প্রাণে প্রাণে বয়ে যায় খুশির জোয়ার। উচ্ছ্বাসমুখরতা ও জান্নাতি খুশির আবহ ঘিরে এতসব আয়োজন। এমনকি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ী ও কর্মজীরিরাও ব্যস্ত হয়ে পড়েন ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে। ঈদ উপলক্ষে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করেন তারাও। এভাবেই সার্বজনীন হয়ে ওঠে ঈদ।
বছর ঘুরে আবারও ফিরে এলো ঈদুল ফিতর। এটি মুসলিম জাতির প্রধান উৎসব। যা ধর্মীয় শিক্ষা ও তাৎপর্যে একটি সুস্থ ও কল্যাণমুখী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে। প্রথমত, দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনা ও কোরআন তেলাওয়াত-অধ্যয়ন ও ইবাদত-উপাসনায় রোজাদার স্রষ্টার নৈকট্য অনুভব করেন। এর ফলে রোজাদার অতীতের তুলনায় অনেক পরিবর্তন হন। আত্মশুদ্ধির জন্য এ পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই।
আমরা অনেকেই সমাজ বিনির্মাণের কথা বলি। দিন বদলের কথা বলি। কিন্তু দিন বদলের জন্য সবার আগে যেটি প্রয়োজন, সেটিই যদি ভুলে যাই, তাহলে তো ফলাফল শূন্য। পবিত্র মাহে রমজান এ দিন বদলের শিক্ষাই দিয়েছে। তাই আমরা বলতে পারি, ঈদুল ফিতরের আনন্দ-উৎবের সঙ্গে সিয়াম সাধনার একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মাসব্যাপী আত্মত্যাগ, সংযম, সাধনার পর এ দিনে বান্দার পুরস্কার হিসেবে ক্ষমা মেলে। রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা ঈদের দিন ফেরেশতাদের মধ্যে রোজাদারদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, ‘হে ফেরেশতারা! আমার কর্তব্যপরায়ণ প্রেমিক বান্দার বিনিময় কী হতে পারে?’ ফেরেশতারা বলেন, ‘ইয়া রব! পুণ্যরূপে পুরস্কার দান করাই তো তার প্রতিদান।’ আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব (রোজা) পালন করেছে। অতঃপর দোয়া করতে করতে ঈদগাহে গমন করেছে। সুতরাং আমার মর্যাদা, সম্মান, দয়া ও বড়ত্বের কসম! আমি তাদের দোয়া কবুল করব এবং তাদের মাফ করে দেব।’ (সুনানে বায়হাকি : ৩/৩৪৩)।
ঈদ পবিত্র খুশির। ঈদ আনন্দের। ঈদ ক্ষমার। ঈদ সব ভেদাভেদ ভুলে একে অপরকে বুকে জড়ানোর। ঈদ মোবারক ঈদ। এ জন্যই মানবতার কবি নজরুল গেয়েছেন, ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ/তুই আপনারে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ/ তোর সোনাদানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ/দে জাকাত মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ। কবি কাজী নজরুলের দরদি কণ্ঠে সাম্য ও সম্প্রীতি নিয়ে ধ্বনিত হয়েছে ঈদুল ফিতরের মর্মভাষ্য।
ইসলামি শরিয়তে ঈদের প্রচলন শুরু হয় প্রথম হিজরিতে। আগেকার নবীদের সময় এ উৎসবটি ছিল না। রাসুল (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করে যখন মদিনা পৌঁছালেন, তখন মদিনাবাসী নওরোজ ও মেহেরজান নামে দুটি আনন্দ দিবস উদযাপন করতে দেখলেন। যে দিবসগুলোতে তারা শুধু খেলাধুলা, আমোদ-ফুর্তি করত। আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ দুদিনের কী তাৎপর্য আছে?’ মদিনাবাসী উত্তর দিলেন, ‘আমরা জাহেলি যুগে এ দুদিনে খেলাধুলা করতাম।’ তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহ এ দুদিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দুটো দিন দিয়েছেন। তা হলো, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১১৩৪)।
হাদিসের আলোকে বোঝা যায়, ঈদের প্রকৃত অর্থ শুধু দামি ও রঙিন জামা, হরেক রকম মুখরোচক খাবার আর নানা ধরনের খেলাধুলা এবং আনন্দ-উৎসব নয়; বরং তাদের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে সাম্য স্থাপন করাই ঈদের উদ্দেশ্য। ঈদ হলো মোমিনের শ্রেষ্ঠ উৎসব। ঈদ হলো সাম্য ও সম্প্রীতির নমুনা। ঈদ আসে সুশৃঙ্খল আচার-আচরণের তীর ঘেঁষে। নৈতিক, আত্মিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধির সীমানা পেরিয়ে সামষ্টিক কল্যাণ নিয়ে। ঈদ আসে কৃচ্ছ ও শুদ্ধতার প্রতীক হয়ে। তাকওয়ার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নতুন জীবনে ফেরার অঙ্গীকার নিয়ে। অফুরন্ত কল্যাণের সঙ্গে আলিঙ্গন করে। ঈদ আসে শত্রুতা ও বৈরিতার প্রাচীর ডিঙিয়ে বন্ধুত্ব ও মিত্রতার হাত বাড়িয়ে। মহামিলনের মহোৎসবে মনকে মাতিয়ে তুলতে। পরিশোধিত হৃদয়কে পরিতৃপ্তি করতে। ঈর্ষা, দ্বেষ, অনৈক্য-দূরত্ব ও বিভাজনের প্রাচীর ভাঙতে। অতএব, আমরা এ উৎসবকে কেন্দ্র করে সাম্য ও সম্প্রীতির সুদীর্ঘ আকাশচুম্বী প্রাচীর গড়ি।
লেখক : কবি ও গীতিকার