বুধবার (১৪ এপ্রিল) থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার ‘কঠোর বিধিনিষেধের’ নির্দেশনা দিয়েছে। আর তাতে করে লাখ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। মঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) রাজধানী ঢাকা পরিণত হয়েছে জ্যামের শহরে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এমনিতেই ছড়িয়েছে সারাদেশে। কিন্তু বিপুল পরিমাণ মানুষ সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের শহর ঢাকা ছাড়ার কারণে তুলনামূলক কম সংক্রমণ রয়েছে এমন জায়গাতে এখন সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অর্ধেক জেলায় করোনার সংক্রমণের হার ছিল ১০ শতাংশের ওপরে, বাকি অর্ধেকে ছিল তার নিচে। কিন্তু বিপুল পরিমাণ মানুষের চলাচলের কারণে এখন দেশের সব জেলায় সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের ওপরে যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে গেলো।
দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিম্নগামী হলেও মার্চের শুরু থেকে তার ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়। আর স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত মার্চ মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৬৫ হাজার ৭৯ জন। অথচ চলতি মাসের প্রথম ১৩ দিনে (১৩ এপ্রিল পর্যন্ত) শনাক্ত হয়েছেন ৮৬ হাজার ৬৫৪২ জন। দেশে এখন পর্যন্ত সরকারি হিসেবে মোট করোনা আক্রান্ত রোগী মোট শনাক্ত হয়েছেন ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৯৮৫ এবং মোট মারা গেছেন ৯ হাজার ৮৯১ জন।
এদিকে, করোনা ভাইরাসের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সংক্রমিত ও জটিল ভ্যারিয়েন্ট হলো সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট। দেশে বর্তমানে এই ভ্যারিয়েন্টের আধিপত্য রয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআর,বি।
অপরদিকে, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে বাজার ও গণপরিবহন থেকে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে ৬১ শতাংশ। অন্যদিকে জনসমাগম স্থল থেকে করোনা ছড়ানোর ঝুঁকি শতকরা ৩৫ ভাগ। আইইডিসিআর জানায়, গত ৫ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে আট হাজার করোনা রোগীর তথ্য পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশেরই বাজারে যাওয়া এবং গণপরিবহন ব্যবহারের ইতিহাস আছে। গণপরিবহন ও বাজারের বাইরেও সভা-সেমিনারসহ অন্য জায়গা থেকেও করোনায় সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে আইইডিসিআর।
এই পরিস্থিতিতে সরকার ঘোষিত সার্বিক কার্যাবলী ও চলাচলে বিধিনিষেধ শুরুর আগে শ্রমজীবী মানুষ ঢাকা ছাড়তে শুরু করে।এতে করে দেশের কম সংক্রমিত এলাকাগুলোয় সংক্রমণ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন।
ডা. মুশতাক হোসেন আরও বলেন, ‘এখন ভ্যারিয়েন্টের কারণে ছড়াচ্ছে বেশি। আগে ১ জনের কাছ থেকে ১০ জন সংক্রমিত হতো এখন ১ জনের কাছ থেকে ১৬ জন সংক্রমিত হচ্ছে। যা শতকরা ৬০ ভাগ বেশি।’
দেশের শতকরা ৫০ শতাংশ সংক্রমণ ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ আর গাজীপুর জেলায় জানিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এসব জেলা থেকে মানুষ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যাওয়া মানে সংক্রমণ যেটা ঢাকার ভেতরে ছিল সেটা ঢাকা থেকে পুরো দেশে ছড়িয়ে গেলো।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাউথ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি, সিকোয়েন্সিং না করে বোঝা যাচ্ছে। আর এই ভ্যারিয়েন্ট এতদিন ঢাকার ভেতরে ছিল। কিন্তু এখন যে মানুষটা সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ছিল তিনি এখন তার জেলাতে গিয়ে অন্যদের সংক্রমিত করবেন।’
‘সাধারণত ১৪ থেকে ২১ দিনের মধ্যে করোনার লক্ষ্মণ-উপসর্গ প্রকাশ পায়।সে হিসেবে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া লোকজন বাড়ি ফেরার ১৪ থেকে ২১ দিন পর এর ফলাফল আমরা দেখতে পাবো। আর এটা হয়ে গেলো একটা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে করোনাভাইরাস সারাদেশে ছড়ানোর উপায়’—বলেন ডা. জাহিদুর রহমান।
মানুষ যেন শহর ছাড়তে না পারে সে ব্যবস্থা করে লকডাউন ঘোষণা করা দরকার জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রস্তুতি নিয়ে লকডাউন ঘোষণা করা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়। এই অবস্থায় ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানে অবশ্যই সারাদেশে ভাইরাস ছড়িয়ে যাচ্ছে, যেখানে সংক্রমণ ছিল না বা কম ছিল সেখানেও এটা ছড়িয়ে যাবে।’
‘মোট কথা ঢাকা ছেড়ে মানুষ আগামী বিপদ হতে যাচ্ছে’—বলেন জাহিদুর রহমান।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইনফেকশাস ডিজিজ বিভাগের চিকিৎসক ডা. ফরহাদ হাছান চৌধুরী মারুফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন যে হারে দেশে ম্যাসিভ ট্রান্সমিশন হয়েছে তাতে করে এখন আর ক্লাস্টার লকডাউন করে কোনও লাভ নেই’। ‘সারাদেশে এখন সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে গেলো, এর ফল আমরা ভবিষ্যতে দেখতে পাবো, যেটা আশাজনক কিছু হলো না’—বলেন ডা. ফরহাদ হাছান চৌধুরী।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লকডাউন দেওয়াই হয়েছে মানুষ চলাচল যাতে বন্ধ হয়। অথচ লকডাউনের আগেই মানুষ চলাচল হয়ে গেলো, এতে করে লকডাউনের যে উদ্দেশ্য ছিল সেটা পূরণ হলো না, সেটা ব্যাহত হলো। দেশের অর্ধেক জেলায় করোনার সংক্রমণের হার ছিল ১০ শতাংশের ওপরে, বাকি অর্ধেকে ছিল নীচে। এখন দেশের সব জেলায় সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের ওপরে যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে গেলো।
ছবি: নাসিরুল ইসলাম
সূত্র :বাংলা ট্রিবিউন।