স্বপ্ন শূন্যতা এবং
(শেষ পর্ব)
উপমন্যু রায়
শেষ পর্ব
তখন সন্ধ্যা। রাস্তার নিয়ন আলোগুলো সব জ্বলে উঠেছে। বিবেকানন্দ রোড আর বিধান সরণির সংযোগস্থলটাকে বেশ লাগে এই সময়। মিশ্র সংস্কৃতির ধারা প্রবাহিত হয়ে গেলেও ঠিক এই জায়গাতেই চিরন্তন বাঙালিয়ানার অনেকটা স্পর্শ যেন এখনও পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে পুরনো কলকাতার গন্ধও যেন ভেসে বেড়ায় এই একুশ–আধুনিক অঞ্চলে।
স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ির সামনে যযাতিদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল কুশলের। যযাতিদা হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কী খবর কুশল? ক’দিন ধরে দেখা পাচ্ছি না কেন? খুব ব্যস্ত নাকি?’’
কুশল হেসে জবাব দেয়, ‘‘আমার আর ব্যস্ততা কী!’’
যযাতিদা পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘‘তা হলে কোথায় ডুব মেরেছিলি?’’
হাসিমুখেই কুশল জবাব দিল, ‘‘ক’দিন রেস্ট নিলাম। একটু জ্বর মতো হয়েছিল।’’
যযাতিদা ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন, ‘‘বলিস কী! ডাক্তার দেখিয়েছিস? এখন কেমন আছিস?’’
কুশল হাসিমুখে বলল, ‘‘আরে, একটা করে জিজ্ঞাসা করো। এতগুলো প্রশ্নের জবাব একসঙ্গে দেব কী করে?’’
যযাতিদা হাসলেন না। প্রশ্ন করলেন, ‘‘আমাকে খবর দিসনি কেন?’’
কুশল বলল, ‘‘তেমন বড় কিছু হয়নি আমার। সামান্য জ্বর হয়েছিল। ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন হয়নি। এখন ভালো আছি।’’
কুশলের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন যযাতিদা। বললেন, ‘‘দ্যাখ কুশল, যে কোনও প্রয়োজনে আমাকে খবর দিবি। তোরা ছাড়া আমার আর কে আছে বল? তুই তো আমার ভাই রে!’’
কুশল হাসে। যযাতিদার চোখের দিকে তাকায়। তাঁর চোখ দুটো চিকচিক করছে! বড় আন্তরিক লাগছে তাঁকে। মাথা নেড়ে যযাতিদার কথায় সায় দেয়।
যযাতিদা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে জানতে চাইলেন, ‘‘আর— কাজকর্মের কোনও খবর আছে কি?’’
কুশলের হাসিমুখ ম্লান হয়ে যায়। ঘাড় নেড়ে বলে, ‘‘না।’’
যযাতিদা বুঝতে পারলেন কুশলের মনের আকাশ ভার হয়ে আসছে। পরিবেশ হালকা করতে মুখে হাসির রেখা চওড়া করে তিনি বললেন, ‘‘আমার মনে হচ্ছে, এবার ভালো খবর আসবে তোর। যে কোনও দিন এ ভাবেই একটা ভালো খবর তুই পাবি। বিশ্বাস হারাস না। এই সময় বিশ্বাস হারানো ভুল নয়, অপরাধ। কারণ, তুই শিশু নয়। এই সময়টা যে বৃষ্টি আসার পূর্বাভাস দিচ্ছে, তা বোঝার মতো বয়স তোর কিন্তু হয়ে গিয়েছে। আর তা এখনই, —এখনই।’’
কিন্তু, কথা আর এগোলো না। দূর থেকে কান্নাভেজা কিছু কথা এসে চুপ করিয়ে দিল দু’জনকেই। যযাতিদার সঙ্গে সে–ও ঘুরে তাকাল এক মধ্যবয়স্ক মহিলার দিকে।
মহিলাটি তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘‘আমার ছেলে তিনমাস ধরে হাসপাতালে ভর্তি। ডাক্তার বলছে একটা বড় অপারেশন করাতে হবে। না হলে আর বাঁচবে না।’’
কথাটা শুনে ভুরু কুঁচকে গেল কুশলের। মহিলাটিকে গরিব সাধারণ কেউ বলে মনে হল না! আবার, এ কথাও মনে হল না যে, বিশেষ কোনও অসৎ উদ্দেশ্যে তিনি এ ভাবে তাদের কাছে হাত পেতেছেন।
যযাতিদাও স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন সেই মহিলার দিকে।
মহিলাটি কেঁদে বলে চললেন, ‘‘আমাকে ফিরিয়ে দিও না বাবা। কিছু সাহায্য করো।’’ একটু থেমে তিনি বললেন, ‘‘এতদিন জমানো টাকা খরচ করে ছেলের চিকিৎসা করিয়েছি। আমার কাছে আর টাকা নেই। তাই তোমাদের সকলের কাছে হাত পেতেছি।’’ ভদ্রমহিলা কেঁদে বললেন, ‘‘ফিরিয়ে দিও না আমাকে বাবা!’’
শেষের কথাগুলি যেন মহিলাটির বুক ফাটিয়ে তীব্র ভাবে বেরিয়ে এলো। কুশল ভালো করে তাঁকে লক্ষ্য করল। সে জানে, এখন আত্মীয়–পরিজনের দারিদ্র এবং এমনকী, মৃত্যুও বিক্রি করা এ–দেশের মানুষের কাছে এক ধরনের পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ট্রেনে–বাসে এমন নারী–পুরুষের দেখা হরবখতই পাওয়া যায়। বাবা মারা গেছেন বলে ধরাচুড়ো পরে রাস্তায় ভিক্ষে করতে অনেকে বেরিয়ে পড়ে। কারণ, বাবার শ্রাদ্ধের পয়সা নেই। শ্রাদ্ধ করবে। অতএব, সাহায্য করো। —বাড়িতে পয়সা নেই, তবু মৃত বাবার শ্রাদ্ধ করতে হবে! চমৎকার যুক্তি।
এই যযাতিদা–ই একদিন শিয়ালদা স্টেশনে এমনই এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে কুশলকে বলেছিলেন, ‘‘এই লোকটির বাবা যে কতবার মারা যান, আর ইনি যে কতবার তাঁর শ্রাদ্ধশান্তি করে চলেছেন, কে জানে! আমিই নয়–নয় করে এই লোকটিকে শিয়ালদা থেকে শ্যামবাজারের মধ্যে স্টেশন থেকে বাসে পাঁচ–ছ’বার দেখে ফেললাম!
কুশল প্রশ্ন করেছিল, ‘‘তা হলে এই জালিয়াতি ধরিয়ে দাওনি কেন?’’
যযাতিদা বলেছিলেন, ‘‘তৃতীয়বার যখন দেখি, আমিই তাকে পাকড়াও করেছিলাম। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে পালিয়ে গিয়েছিল। তার পরও আমি তাকে একই কায়দায় বারকয়েক দেখেছি। কিন্তু আমার কাছে আর সে আসেনি। হয়তো আমাকে সে–ও দেখেছে!’’
এই মহিলাকে দেখে তেমন মনে হল না। আসলে সন্তানের জন্য সত্যিই যদি কোনও মায়ের বুকফাটা হাহাকার বেরিয়ে আসে, যদি না শ্রোতা বুঝতে না–চায়, সেই হাহাকার কারও বুঝতে অসুবিধে হয় না। হওয়ার কথা নয়। সন্তানকে বাঁচাতে ভদ্রমহিলা এতটাই বেপরোয়া যে, অন্যের গু–মুত পরিষ্কার করার কাজ করতেও তাঁর আপত্তি নেই। আর, সে কথাও তিনি দ্বিধা না রেখেই বলে দিলেন!মহিলাটি ভাঙা গলায় বললেন, ‘‘না বোলো না বাবা! কিছু দাও। এ–ছাড়া আমার আর কোনও পথ নেই।’’
মহিলাটিকে সত্যিকারের মা–ই মনে হচ্ছে।
কুশল কী করবে বুঝতে পারল না। অসুস্থ ছেলেকে চিকিৎসার জন্য এক মা হাত পেতেছেন। তাঁকে তো ভিক্ষে দেওয়া যায় না! চিকিৎসার খরচ ভিক্ষে করে ওঠে না। তাঁকে দিতে হলে দিতে হবে সামান্য হলেও শ–দুয়েক টাকা। পকেটে হাত দিল সে। পকেট একেবারে গড়ের মাঠ! এটা অস্বাভাবিক নয়। থাকলেও দশ–পনেরো টাকা থাকে তার পকেটে। এর বেশি রাখার ক্ষমতা তার নেই। তা থাকলেও বা কী করে দিত এই অসহায় মাকে!
যযাতিদা পকেটে হাত দিয়ে পার্স বের করলেন। কুশল দেখল, পার্সে থাকা টাকাগুলি বের করলেন তিনি। গুনে দেখলেন বারোশো পঞ্চাশ। তা–ই দিয়ে দিলেন সেই মাকে। বললেন, ‘‘আমার কাছে আর নেই।’’
এই না হলে যযাতিদা!
ভদ্রমহিলাও দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন। কান্নাভেজা গলায় বললেন, ‘‘আল্লাহ্ তোমার ভালো করবে বাবা। দেখো তোমার ব্যাগ টাকায় ভরে যাবে!’’
অর্থাৎ, ভদ্রমহিলা বাঙালি মুসলমান। দেখে বুঝতে পারেনি কুশল। হাতে চুড়ি একটা ছিল। তবু হাতটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। তার মনে হয়েছিল, তিনি হয়তো বিধবা হবেন। তার মানে এক মুসলমান মা এসেছেন তাঁর হিন্দু ছেলেদের কাছে সাহায্য চাইতে!
তাঁর কথার প্রত্যুত্তরে যযাতিদা কিছু বললেন না।
কুশল বলল, ‘‘ঠিক আছে। আপনি এখন যান। ওষুধপত্র কিনুন।’’
ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন।
কুশল যযাতিদাকে বলল, ‘‘তুমি বোধ হয় কোথাও যাচ্ছিলে! সব টাকা তো ওই মহিলাকে দিয়ে দিলে! এখন যাবে কী করে?’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘দেখি, বাড়ি যাই আবার!’’
যযাতিদা বাড়ির দিকে পা–বাড়াতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন কুশলের কথায়। গম্ভীর গলায় ঠিক তখনই কুশল বলে উঠল, ‘‘মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে এই পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে দিতে।’’
কয়েক মুহূর্ত কুশলের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন যযাতিদা। বুঝতে পারলেন না তার কথা। প্রশ্ন করলেন, ‘‘মানে?’’
কুশল তাঁর কথার কোনও জবাব দিল না। পালটা প্রশ্ন করল, ‘‘তোমার কি মনে হয় না যযাতিদা, এই পৃথিবীটার টিকে থাকার আর কোনও প্রয়োজন নেই?’’
যযাতিদা কী বলবেন ভেবে পেলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। কুশলকে তার কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছে! এই কুশলকে তিনি কখনও দেখেননি। তার বুকে যে এত অভিমান জমে আছে, তা তিনি কখনও টেরও পাননি! সেই অভিমান আজ তীব্র ক্ষোভে পরিণত হয়েছে। যে কারণে পৃথিবীটাকেই আজ তার মূল্যহীন মনে হচ্ছে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কুশল বলল, ‘‘আমার কিন্তু তা–ই মনে হয়।’’
তবে যযাতিদা বুঝতে পারলেন, পৃথিবীর প্রতি তার এই ক্ষোভ আসলে এই জগৎ–সংসারটাকে ভালবাসারই জন্য। সেখানে বারবার হেরে যেতে যেতে তার মনে এই অভিমান জমে উঠেছে। তাই মাথা নেড়ে তার কথায় সায় দিলেন তিনি। বললেন, ‘‘ঠিকই বলেছিস। পৃথিবীটা না থাকলেও এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনও ক্ষতি হত না। হবেও না।’’
কুশল কোনও কথা বলে না।
যযাতিদা–ই বললেন, ‘‘বিশেষ করে আমাদের এই মানব সভ্যতা। এই সভ্যতা টিকে থাকল, কী থাকল না, তাতে বিশ্বসংসারের কিছু এসে–যায় না।’’
কুশল নীরবই থাকে।
যযাতিদা বললেন, ‘‘এমনকী, আমাদের এই সভ্যতা যদি না–ও থাকে, তা হলে পৃথিবীরও কোনও অসুবিধে নেই। বরং, তাতে লাভই। আজ পর্যন্ত পৃথিবীর যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, তা অন্য কোনও প্রাণী বা উদ্ভিদ করেনি। করেছে মানুষই। তাই মানব–সভ্যতা যদি ধ্বংস হয়ে যায়, পৃথিবীর অন্তত সেই ক্ষতিগুলি আর হবে না, যা মানুষ প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে করে চলেছে!’’
কুশল জোর দিয়ে বলে ওঠে, ‘‘ঠিক তা–ই। মহাবিশ্বের মঙ্গলের জন্য মানব–সভ্যতা, প্রয়োজনে পৃথিবীটারই আজ ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রয়োজন।’’
কুশলের মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন যযাতিদা। তার পর তার কাঁধে হাত রাখলেন। মাথা নেড়ে বললেন, ‘‘তবু পৃথিবীটা কেন টিকে আছে জানিস?’’
কুশল মাথা নেড়ে ‘‘না’’ বলল।
যযাতিদা হাসিমুখে বললেন, ‘‘তোর মতো ছেলেদের জন্য। যারা জীবনের কঠিন সময়ের সঙ্গে লড়াই করেও বেঁচে থাকে। যারা এই দুঃসময়েও স্বপ্ন দ্যাখে। ভাবিস না বড়লোক, কোটিপতি, শিল্পপতিদের জন্য পৃথিবীটা টিকে আছে। এ কথা ঠিক, পৃথিবীটা চালাচ্ছেন তাঁরাই। সেটুকুর জন্যই পৃথিবীর কাছে তাঁদের তাৎপর্য। বাকিটা নয়। এই পৃথিবী, এই সভ্যতার যতটুকু আবেগ, ভালবাসা আর প্রাণশক্তি রয়েছে, তা তোদের মতো ভালো ছেলেদের জন্যই।’’
কুশল তাকিয়ে থাকে যযাতিদার দিকে।
তিনি বললেন, ‘‘তুই ভাবিস না, তুই একাই জীবনের সঙ্গে লড়াই করছিস! সারা পৃথিবীতে তোর মতো কোটি কোটি ছেলেমেয়ে প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করছে। আর সে ভাবে তারা শুধু নিজেরাই বেঁচে থাকছে না, বাঁচিয়ে রাখছে এই সভ্যতাকেও।’’
কুশল ম্লান হাসে।
যযাতিদা বললেন, ‘‘ঠিক আছে। এখন আসি আমি। ফ্ল্যাটে আসিস কিন্তু।’’ আর কথা না বলে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে হঁাটা দিলেন তিনি।কুশলও তাঁকে কিছু বলল না। মাথা নীচু করে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে রইল ফুটপাথে। তার পর হাঁটতে শুরু করল। চার রাস্তার মোড়ে পৌঁছে বিবেকানন্দ রোড পার হয়ে বিধান সরণির ফুটপাথে উঠে এলো। তবে বিধান সরণি দিয়ে গেল না। বিবেকানন্দ রোড ধরে পশ্চিম দিকে পা বাড়াল। কিন্তু, —আর হাঁটা হল না। কেউ যেন তাকে ডাকছে মনে হল।
— ‘‘এক্সকিউজ মি।’’
থমকে দাঁড়িয়ে দেখল, তারই কাছে ফুটপাথ ঘেঁষে একটি অডি গাড়ি দাঁড়িয়ে। তার দরজা অল্প খোলা। সেই গাড়ির পিছনের আসন থেকে মুখ বাড়িয়ে এক তন্বি।
তবে—, সব কেমন যেন চেনা–চেনা লাগছে! —হ্যাঁ, গাড়িটা! এমনকী, গাড়ির এই মালকিন! স্বপ্নেই কি দেখেছে এই গাড়ি আর গাড়ির অধিশ্বরীকে?
তাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে তরুণীটি জিজ্ঞাসা করল, ‘‘রবীন্দ্রনাথের বাড়িটা ঠিক কোথায় বলতে পারবেন?’’
ভুরু কুঁচকে গেল কুশলের। বিস্মিত ভাবে বলল, ‘‘রবীন্দ্রনাথ!’’
মেয়েটি যেন একটু বিরক্ত হয়েই বলল, ‘‘আপনি কলকাতায় থাকেন তো? তা হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চেনেন না? মনে হচ্ছে তাঁর নামই শোনেননি কোনও দিন!’’
— ‘‘ও!’’ একটু হেসে কুশল বলল, ‘‘চিনব না কেন? বাঙালির ছেলে হয়েও এত বড় দার্শনিককে না চেনাটা ভুল নয়, একটা অপরাধ! কিন্তু—।’’ থেমে গেল সে।
মেয়েটি পালটা বলল, ‘‘মানে—? মানে কী?’’
কুশল হাসিমুখে বলল, ‘‘আপনি যে ভাবে রবীন্দ্রনাথের নাম ধরে বললেন, তাই ভাবলাম বুঝি এখানকার বাসিন্দা কারও কথা বলছেন!’’
একটা অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে সে যে এ ভাবে কথা বলতে পারে, তা কুশলের নিজেরই জানা ছিল না। নিজের সাহসিকতায় নিজেই বিস্মিত হল।
মেয়েটি রেগে গেল। বলল, ‘‘কী বাজে কথা বলছেন! রবীন্দ্রনাথ কি এই অঞ্চলের বাসিন্দা নন?’’
কুশলও মুখে হাসি বজায় রেখে জবাব দিল, ‘‘হ্যাঁ, এই অঞ্চলেরই। তবে রবীন্দ্রনাথকে তো কোনও অঞ্চল, রাজ্য বা দেশ দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। তিনি গোটা পৃথিবীর। আর আপনি এমন ভাবে তাঁর বাড়িটা কোথায় জানতে চাইলেন, যেন মনে হল, কোনও রামবাবু, শ্যামবাবুর বাড়ির কথা জানতে চাইছেন!’’
মেয়েটি এবার হেসে ফেলল। প্রশ্ন করল, ‘‘আপনি সত্যিই কি আমার কথা বুঝতে পারেননি?’’
কুশল হেসে বলল, ‘‘পারিনি বলেই তো ফের জিজ্ঞেস করলাম।’’
মেয়েটি হাসিমুখে বলল, ‘‘ঠিক আছে, আপনার সঙ্গে এ নিয়ে আর তর্ক করতে চাই না। কিন্তু, আপনি কি আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিতে পারবেন?’’
কুশল বলল, ‘‘কী প্রশ্ন? ও–হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের বাড়ি?’’
মেয়েটি বলল, ‘‘হ্যাঁ।’’
কুশল বলল, ‘‘চিনব না কেন? কিন্তু, ওই বাড়ি তো জোড়াসাঁকোয়!’’
মেয়েটি ফের বিরক্ত হল। বলল, ‘‘সে তো আমিও জানি। আমাকে বলুন সেটা কোথায়?’’
এবার কুশল আপন মনেই বলল, ‘‘এখান থেকে আপনাকে বোঝাই কী করে?’’ তার পর মেয়েটিকে বলল, ‘‘এক কাজ করুন, এই দিক দিয়ে সোজা চলে যান গিরিশ পার্কের মোড়ে। তার পর বাঁ–দিকে টার্ন নিয়ে কিছুটা গিয়ে আবার ডানদিকে—। কিন্তু—!’’ আবার থেমে গেল সে।
মেয়েটি বলল, ‘‘বুঝেছি।’’
কুশল বলল, ‘‘তা হলে চলে যান।’’
মেয়েটি বলল, ‘‘আপনি মনে হয় লোকাল পার্সন!’’
কুশল মাথা নাড়ে।
একটু লাজুক ভাবে সে বলে, ‘‘আপনার হাতে একটু সময় হবে? আসলে আমি এখানে থাকি না। লন্ডনে থাকি। এখানে আমার দাদু–দিদা থাকেন। তাঁদের কাছে আমি কিছুদিনের জন্য এসেছি। এখানকার প্রায় কিছুই তেমন চিনি না। যদি আমাকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে নিয়ে যান, তা হলে ভালো হয়।’’ একটু যেন অপরাধীর মতো শোনায় তার কণ্ঠস্বর।
কুশল বলল, ‘‘তা না–হয় নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু—।’’ একটু থেমে নিজের মনেই বলে ওঠে, ‘‘এখন কি ঠাকুরবাড়ি খোলা থাকবে?’’ তার পর নিজেই জবাব দেয়, ‘‘জানি না!’’
তার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে মেয়েটি বলল, ‘‘উঠে আসুন।’’ বলেই সে গাড়ির ভিতরে ঢুকে যায়। একটু সরে বসে তাকে জায়গা করে দেয়। বলে, ‘‘না খোলা থাকলে ফিরে আসব। অন্য একদিন যাব।’’
কুশল গাড়িতে উঠে বসতেই ড্রাইভার স্টার্ট দেয়।
—অচেনা সেই স্বপ্নের মেয়েই যেন আজ সত্যি হয়ে এলো কুশলের কাছে! (সমাপ্ত)