দৈনিক প্রত্যয় ডেস্কঃ করোনাভাইরাসের কারণে গেল কয়েক মাস ধরে নাস্তানাবুদ গোটা বিশ্ব। এই ভাইরাস সারাবিশ্বে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ার কারণে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে মানুষ। বন্ধ হয়ে গেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তবে এখনো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ, সংঘাত সহিসংতা অব্যাহত রয়েছে। স্বাস্থ্যঝুঁকি স্বত্ত্বেও বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ।
আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা রেডক্রসের সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, মহামারিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর লাখ লাখ মানুষ নূন্যতম জরুরি স্বাস্থ্যসেবাটুকুও পাচ্ছে না। রয়েছে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও বাসস্থান সঙ্কট। কোভিড-১৯ এর কারণে এসব দেশে আয়ের উৎস বন্ধ গেছে। বিদেশি সহায়তার ওপর আরও বেশি নির্ভর হয়ে পড়ছে তারা।
রেডক্রসের পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের উপ-প্রধান লেইতে পিকোলি চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম সিজিটিএনকে বলেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোর বাসিন্দারা এমনিতেই নানা ভয় আর আতঙ্কর মধ্যে বসবাস করছেন। কোভিড-১৯-এর কারণে সেই মাত্রা আরও বেড়েছে। এমনিতেই অস্ত্র, গোলা বর্ষণ আর বোমা বিস্ফোরণের কারণে তাদের জীবন চরম হুমকির মুখে। এসব অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবারও চরম অভাব। করোনাভাইরাস থেকে তাদের রক্ষা করা এখন সত্যিই অনেক চ্যালেঞ্জ।’
গেল মার্চ মাসে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বৈশ্বিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও বিভিন্ন দেশে সংঘাত সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। নরওয়ের শরণার্থী কাউন্সিল-এনআরসির তথ্যমতে, সংঘাত সহিংসতার কারণে গেল ২৩ শে মার্চ থেকে ১৫ই মে পর্যন্ত ১৯টি দেশের ৬ লাখ ৬১ হাজার মানুষ বাস্তচ্যুত হয়েছে।
এসব দেশে বিশেষ করে আফগানিস্তান, ইয়েমেন এবং সিরিয়ায় দীর্ঘদিনের সহিংসতার কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এছাড়া, দুর্ভিক্ষ ও পুষ্টিহীনতায় নানা রোগ মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে তারা। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বর্তমানে এসব দেশগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এক সাথে অনেক রোগ মোকাবিলা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
লেইতে পিকোলি বলেন, রেডক্রসের কর্মীরা অল্প কিছু জায়গায় ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ব্যবস্থা নিলেও বেশির ভাগ জায়গায় সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। সম্পদের ঘাটতি থাকায় সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। যার ফলে দ্রুতই এসব অঞ্চলে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যেও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে। রেডক্রসের কর্মীরাও চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। সঠিক সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াই কাজ করে যাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। যার কারণে এসব দেশে মোট আক্রান্তের ১৪ শতাংশই স্বাস্থ্যকর্মী।
এনআরসির গবেষণা তথ্যমতে, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো-ডিআরসিতে ৪ লাখ ৮২ হাজার মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তাদের জরিপ বলছে, করোনা ভাইরাসের মধ্যেই সহিসংতার কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এছাড়া, চলতি বছরে কমপক্ষে ৪০টি হাসপাতালে চিকিৎসা সামগ্রী লুটপাট এবং ধ্বংস করা হয়েছে। বর্তমানে এই দেশটিতে ৪ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত।
গেল পহেলা জুন করোনা ভাইরাসের পাশাপাশি ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণের কথা জানায় কঙ্গো সরকার। এই ভাইরাসে ছয়জন আক্রান্ত হলেও মারা গেছেন চারজন। এতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করবে। কোভিড-১৯ ইবোলা এবং হাম এই তিনটি রোগ একসাথে ছড়িয়ে পড়লে তা মোকাবিলা করা দেশটির পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে।
সৌদি জোট এবং হাউথি বিদ্রোহীদের মধ্যে দীর্ঘ দিনের সংঘাত, সহিংসতা ও গৃহযুদ্ধের কারণে মহামারির আগে থেকেই চরম মানবিক সঙ্কটে ইয়েমেন। বর্তমানে দেশটিতে আড়াই কোটি মানুষের জরুরি মানবিক সহায়তা দরকার। এরমধ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষ চরম দুর্ভিক্ষের মধ্যে রয়েছেন।
জাতিসংঘে শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে এখন পর্যন্ত ৯৪ হাজার মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। ২০১৪ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে লাখ লাখ মানুষ বাস্তচ্যুত হয়ে পড়ে। উভয়পক্ষই বিভিন্ন হাসপাতাল এবং বেসামরিক অঞ্চল লক্ষ্য করে হামলা চালায়। সবশেষ ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলে সৌদি জোটের বিমান হামলায় ৪ শিশুসহ অন্তত ১৩ জন নিহত হয়।
এর আগে, এক বিবৃতিতে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সামগ্রী এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিতে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায় রেডক্রস। বেসামরিক নাগরিকদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় এমন কার্যক্রম থেকে সব পক্ষকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়। গেলো ১০ই এপ্রিল ইয়েমেনে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। দেশটির আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৮৪৪ জন। জাতিসংঘ বলছে, বর্তমানে দেশটি চরম সঙ্কট অতিক্রম করছে। সংস্থাটির আশঙ্কা, করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে গত ৫ বছরে সংঘাত সহিংসতা এবং দুর্ভিক্ষে যত মানুষ মারা গেছে, করোনায় তারচেয়ে বেশি মানুষ মারা যেতে পারে।
লেইতে পিকোলি বলেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে করোনার বিরুদ্ধে সরকার ও সাহায্য সংস্থাগুলোকে সম্মিলিতভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। যুদ্ধকবলিত অঞ্চলে প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা সেবা নিশ্চিত করতে হবে।’
ডিপিআর/ জাহিরুল মিলন