ওয়েব ডেস্ক: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর প্রকাশ্যে গুলি ছুড়ে আলোচনায় আসেন ময়মনসিংহ মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নওশেল আহমেদ অনি। ক্যাডার বাহিনী নিয়ে তার গুলি করার ভিডিও ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে নেট দুনিয়ায়। রাজধানী ঢাকায় আত্মগোপনে থেকেও শেষ রক্ষা হয়নি; ধরা পড়ছেন র্যাবের হাতে। এতে স্বস্তি ফিরেছে ময়মনসিংহে।
গ্রেপ্তারের পর ছাত্রলীগ নেতা অনির কুকীর্তি আর অস্ত্রবাজি ফের আলোচনায় এসেছে। অপরাধের সাম্রাজ্য পরিচালনায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন কিশোর গ্যাং। ক্ষমতার দাপটে কারণে-অকারণে গুলি ছুড়ে ভীতসন্ত্রস্ত পরিবেশ তৈরিতে সিদ্ধহস্ত অনি এখন ময়মনসিংহের রাজনীতিতে ‘হট টপিক’। তার অন্ধকার জীবনের কাহিনী নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দিনভর নগরীর নতুন বাজার এলাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকার অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে অনির নানা অপকর্মের কথা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নগরীর নতুন বাজার মোড়-সংলগ্ন জমির মুন্সি লেনের পিয়নপাড়া এলাকার বাসিন্দা মো. হুমায়ুন কবীরের ছেলে নওশেল আহমেদ অনি। তিন ভাইয়ের মধ্যে অনি সবার ছোট। কৈশোর থেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তার সম্পৃক্ততা শুরু হয়। নগরীর বিভিন্ন এলাকার বেপরোয়া ছেলেদের নিয়ে গড়ে তোলেন কিশোর গ্যাং। ওই কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে দাপিয়ে বেড়াতেন নগরীর সর্বত্র। এরপর স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি প্রভাবশালী পক্ষের আনুকূল্যে শহর ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক পদ বাগিয়ে নেন। এতে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন অনি। সেই থেকে দলীয় সভা-সমাবেশে বিশাল শোডাউন করে বাগিয়ে নেন মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক পদ।
জানা গেছে, স্থানীয়দের কাছে অনি ছিল এক আতঙ্কের নাম। ওই এলাকায় কেউ নতুন বাড়ি নির্মাণ করলে তাকে চাঁদা দিতে হতো। কেউ প্রতিবাদ করলে টর্চার সেলে ধরে নিয়ে চালানো হতো নির্যাতন। নতুন বাজার এলাকার ব্যবসায়ীরাও ছিলেন অনির কাছে জিম্মি। ছোট পান ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বাদ যাননি বড় বড় ব্যবসায়ীরাও, সবাইকেই চাঁদা দিতে হতো।
প্রতিবন্ধী পান ব্যবসায়ী খাইরুল ইসলাম সাদেক বলেন, ১৯৭২ সাল থেকে আমার বাবা ও চাচা ভিট (স্থান) ভাড়া নিয়ে এই বাজারে ব্যবসা করতেন। তাদের পর আমি এই দোকানে ব্যবসা করি। ৪ বছর আগে ছাত্রলীগ নেতা অনি আমার দোকানটি জোরপূর্বক দখল করে নেন। আমি পঙ্গু মানুষ, ভয়ে কিছু বলতে পারিনি। আমি থানায় লিখিত অভিযোগ করেছিলাম, কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি। ৫ আগস্টের পর আমি এলাকাবাসীর সহযোগিতায় আমার দোকান ফিরে পেয়েছি।
নগরীর একাধিক বাসিন্দা জানান, দলীয় গ্রুপিং, বিভেদসহ নানা কারণে এবং ব্যক্তি বিরোধে প্রকাশ্য গুলি ছোড়া ছিল অনির চেনা রূপ। বিএনপি হটাও থেকে শুরু করে দলীয় বিক্ষোভ মিছিলে সুযোগ পেলেই প্রকাশ্যে গুলি করার মতো ঘটনা তার অহরহ। ফলে নগরবাসীর কাছে অস্ত্রবাজ হিসেবে অনির পরিচিতি ছিল ব্যাপক।
ফুলবাড়ীয়া উপজেলা তাঁতীদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. হারুন অর রশিদ অভিযোগ করে বলেন, ছাত্রলীগ নেতা অনি ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী হিসেবে তেলিগ্রাম বাজারে এসে প্রকাশ্যে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এবং গুলি করে আমার জমি জোরপূর্বক দখল করে বাউন্ডারি নির্মাণ করেছিল। এতে সহযোগিতা করেছিল স্থানীয় সন্ত্রাসী কামরুল ও ইমরান। ৫ আগস্টের পর ওই জমিটি দখলমুক্ত করা হয়েছে।
অপর একটি সূত্র জানায়, ত্রিশাল থানার যুবলীগ কর্মী আবির হত্যা মামলায় সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল অনি। ২০২২ সালে ত্রিশালে আওয়ামী লীগের কর্মী সম্মেলনে দুই পক্ষের বিরোধে প্রকাশ্য হামলায় এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কিন্তু প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের কারণে ওই মামলায় তাকে এবং হামলায় অংশ নেওয়া তার অনুসারীদের আসামি করা হয়নি। বর্তমানেও মামলাটির তদন্ত চলমান রয়েছে।
পিয়নপাড়া এলাকার ফয়জুর রহমান নামে এক ব্যক্তির মালিকানাধীন পাঁচতলা ভবনের দুইটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে দলীয় কার্যালয় বানানোর চেষ্টা করেন অনি। এতে আপত্তি জানালে বাসার মালিকের কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন তিনি। এ ঘটনায় ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ফয়জুর রহমান বাদী হয়ে কোতোয়ালি মডেল থানায় চাঁদাবাজির মামলা করেন। ওই মামলায় অনি ও তার বড় ভাই নওশাদ আহমেদ অভিকে প্রধান আসামি করে ১১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১০ থেকে ১২ জনকে আসামি করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, রাজাকার তকমা দিয়ে নগরীর বাউন্ডারি রোড ও জিলা স্কুল রোড এলাকায় প্রয়াত মোনায়েম খানের পৈতৃক সম্পত্তি বেদখল করেন অনি। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যস্থতায় অর্ধকোটি টাকায় ওই জমি দখলমুক্ত করার ঘটনা ঘটে।
নতুন বাজার এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত কয়েক বছর আগে ছাত্রলীগ নেতা অনি প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করে নতুন বাজার ইজারা নেন। এরপর থেকে বাজারের প্রতিটি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে জোরপূর্বক অতিরিক্ত ইজারা আদায় করা হয়। কিন্তু বাজারের ব্যবসায়ীরা ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারেননি। এছাড়া বাজারের একাধিক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করার ঘটনাও রয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ইতোমধ্যে সাগর হত্যা মামলায় ছাত্রলীগ নেতা অনিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে থানায় চাঁদাবাজিসহ আরও অনেক মামলা ও অভিযোগ রয়েছে। সবগুলো অভিযোগ খতিয়ে দেখে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।