সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০২:০৪ অপরাহ্ন
ওয়েব ডেস্ক: ‘আমার রুমালে একটু গ্লিসারিন মেখে দাও। যেন লাশ দেখে রুমাল ধরতেই চোখে পানি এসে যায়।’ বিরোধী দলে থাকতে শেখ হাসিনা এভাবেই কান্নার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে ‘আমার ফাঁসি চাই’ বইয়ে। মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান রেন্টুর লেখা সেই বইয়ের কিছু কথা উঠে এসেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে টানা পাঁচদিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছিল প্রসিকিউশন। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেলে এ মামলার বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা দিতে গিয়ে যুক্তিতর্কের পঞ্চম দিনে ওই উদ্ধৃতি টানেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। বিশেষ করে জাহানারা ইমাম ও লাশ দেখতে গিয়ে রুমালে গ্লিসারিন মাখার লেখাগুলো পড়ে শোনান তিনি।
লাশের রাজনীতি প্রসঙ্গে বইটির ৭১ নম্বর পৃষ্ঠার কিছু বক্তব্য ট্রাইব্যুনালের সামনে তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর। এতে উল্লেখ রয়েছে, ‘বিকেল বেলা বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বললেন, কিরে এত লোক আসে যায়, এত ফুলের তোড়া, ফুলের মালা। কিন্তু হানিফকে (সদ্য নবনির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ) দেখছি না! এখন পর্যন্ত একটা ফোনও করল না। ব্যাপারটা কি? ঠিক আছে তো, না ভাইগা টাইগা গেল। এই মেয়র হওয়ার লোভেই কিন্তু হানিফ স্বৈরাচারী জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। এরশাদের কাছে চান্স না পেয়ে হানিফ মেয়র হওয়ার জন্য আবার আমার কাছে ফিরে এসেছে। আমি এক কোটি সাতত্রিশ লক্ষ টাকা খরচ করে হানিফকে মেয়র করেছি। তাড়াতাড়ি খোঁজ খবর নাও। ফোন কর এবং একজন হানিফের বাড়ি গিয়ে দেখ আসল ব্যাপার কি?’
সদ্য নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের বাসায় ফোন করে বলা হলো, ‘জননেত্রী বিরোধী দলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা হানিফ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলবেন। জবাবে মিসেস হানিফ বললেন, তিনি অসুস্থ এখন কথা বলতে পারবেন না। বললেন, শিগগিরই হানিফের বাসায় যাও, দেখ গিয়ে ঘটনা খারাপ।’
তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মেয়র হানিফের বাড়ি ছুটে যাওয়া হলো। মেয়র হানিফ তখন দশ-বারো জন লোকের সঙ্গে বসে কথা বলছেন। সেখানেই শোনা গেল বিকেলে লালবাগে বিএনপির পরাজিত কমিশনার প্রার্থী আব্দুল আজিজ গুলি করে সাতজন লোককে হত্যা করেছে। শেখ হাসিনা কথা বলতে চেয়েছেন বলায় মেয়র হানিফ বললেন- ‘নেত্রীকে আমার সালাম দিও, বলো আমার শরীরটা খুব খারাপ, আমি কথা বলতে পারছি না। শুধু লালবাগের খুনের জন্য আমি ওনাদের সঙ্গে কথা বলছি।’
মেয়র হানিফের বাসা থেকে সোজা মিন্টু রোডে এসে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে লালবাগের বিএনপি কমিশনার প্রার্থী আজিজের সাতজনকে খুন করার সংবাদ দিলে খুশিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা জিন্দেগি জিন্দেগি গান গাইতে থাকেন আর নাচতে থাকেন। পরদিন সকালে লালবাগে সাতজনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে দেখতে যাওয়ার আগে হাসিনা বলতে থাকেন, ‘আমার (শেখ হাসিনা) রুমালে একটু গ্লিসারিন মেখে দাও। ওই যে, নায়িকারা অভিনয়ের সময় গ্লিসারিন দিয়ে চোখের পানি বের করে কান্নার অভিনয় করে। আমার রুমালে ওই রকমের গ্লিসারিন লাগিয়ে দাও। যাতে আমি লাশ দেখে রুমাল ধরতেই চোখে পানি এসে যায়।’
একজন বলল, ‘গ্লিসারিনের দরকার নেই। শুধু চোখে রুমাল ধরে রাখবেন তাতেই মনে হবে আপনি কাঁদছেন। আর আমরা ফটো সাংবাদিক (ফটো সাংবাদিক) ভাইদের বলে দেব ছবির নিচে আপনি কাঁদছেন ক্যাপশন লাগিয়ে দিতে।’
হাসপাতালের মর্গে সাতজনের লাশ দেখে শেখ হাসিনা চোখে রুমাল ধরলে সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকরা অসংখ্য ছবি তুলল। ছবি তোলা শেষে বঙ্গবন্ধুকন্যা গাড়িতে উঠলেন। গাড়ি চলতে শুরু করল। তখনও শেখ হাসিনার চোখে রুমাল। গাড়ির চালক জালাল বলল, আপা (শেখ হাসিনা) এখন রুমাল নামান ফটো সাংবাদিক নেই।
গাড়ির সব আরোহী হেসে উঠলো। শেখ হাসিনা বললেন, ঠিক মতো দেখেছ তো। কোনো ফটো সাংবাদিক নেই তো?
না, নেই।
তাহলে আমি (শেখ হাসিনা) এবার রুমাল নামাই।
২৯ নম্বর মিন্টো রোডের বাসায় এসে শেখ হাসিনা বললেন, ময়না (মিসেস মতিযুর রহমান রেন্টু) খাওয়া-দাওয়া বেশি করে এনেছো তো? লাশ দেখে এসেছি, লাশ। আজ আমি বেশি করে খাব। এরপর তিনি জিন্দেগি জিন্দেগি গাইতে গাইতে নাচতে লাগলেন। সত্যি সত্যিই তিনি (শেখ হাসিনা) অস্বাভাবিক রকমের বেশি খেলেন। এমনিতেই তিনি (শেখ হাসিনা) বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নিহতদের লাশ দেখে এসে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি খেতেন। কিন্তু আজ খেলেন অস্বাভাবিকের চেয়েও অনেক বেশি।
শেখ হাসিনার এ মামলার রায় ঘোষণা হবে আজ সোমবার (১৭ নভেম্বর)। বেলা ১১টায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেলে রায় পড়া শুরু হবে। এমনটিই জানিয়েছে রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্র।
এ মামলার রায় ঘোষণার জন্য আজকের দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। গত ১৩ নভেম্বর দুপুর ১২টা ৯ মিনিটে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ দিন নির্ধারণ করেন। ট্রাইব্যুনালের বাকি সদস্যরা হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
শেখ হাসিনার এ মামলায় মোট ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য-জেরা শেষ হয়। আর ৯ কার্যদিনে চলে প্রসিকিউশন-স্টেট ডিফেন্সের যুক্তিতর্ক পাল্টা যুক্তিখণ্ডন। ২৩ অক্টোবর রাষ্ট্রের প্রধান আইনকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের সমাপনী বক্তব্য এবং চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেনের যুক্তিখণ্ডন শেষে রায়ের তারিখ নির্ধারণে সময় দেওয়া হয়।
যুক্তিতর্কে শেখ হাসিনা ও কামালের সর্বোচ্চ সাজা চেয়েছে প্রসিকিউশন। তবে রাজসাক্ষী হওয়ায় মামলার অন্যতম আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। যদিও তার খালাস চেয়েছেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ। হাসিনা-কামালও খালাস পাবেন বলে দৃঢ় বিশ্বাস রাষ্ট্রনিযুক্ত আমির হোসেনের।