দৈনিক প্রত্যয় ডেস্কঃ করোনায় থমকে আছে বিশ্ব। কবে মুক্তি মিলবে তা অজানা। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এ ভাইরাসের প্রভাব দেখা গেছে। অনেক দেশেই করোনাভাইরাসের প্রভাবে অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যখাতসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রের অবস্থাই শোচনীয়। উন্নত দেশে করোনার যে ধরনের প্রভাব পড়েছে সেখানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা আরও কঠিন। সংশ্লিষ্ট শিক্ষাখাতে চলমান সংকট মোকাবিলায় দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন।
বছরের শুরুর হিসেব যদি আমরা দেখতে যাই, তাহলে চলতি বছরও অন্যান্য বছরের মতোই শুরু হয়েছিলো। নতুন বছরের প্রথম দিনে বই বিতরণ, ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি, দাখিল ও সমমানের পরীক্ষা, ৬০ দিনের মধ্যে ফল ঘোষণা, এপ্রিলে এইচএসসি, আলিম ও সমমানের পরীক্ষা একইভাবে ফল ঘোষণা, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে সাময়িক ও অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, নির্ধারিত সময়ে ক্লাস, পরীক্ষা ও ডিগ্রি প্রদান সবই নিয়ম মেনে চলছিলো।
করোনার ছোবলে শিক্ষাব্যবস্থার অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। এরই মধ্যে একাধিক বিকল্প নিয়ে ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের বক্তব্য এখনই সুনিশ্চিত কোনো পরিকল্পনা ঘোষণা করা সম্ভব না। শিক্ষার দায়িত্বের থাকা মন্ত্রণালয়গুলোও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনি করোনাকালে তাদের শিক্ষার ভাবনা নিয়ে বেশ কিছু বিষয়ে কথা বলেছেন গণমাধ্যমের সাথে। যেখানে তিনি জানিয়েছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কোনো অবস্থাতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে ভাবছেন না তারা।
মন্ত্রী জানান, প্রয়োজনে তারা চলতি বছরের শিক্ষাবর্ষের সাথে আরো কয়েকমাস যুক্ত করে হলেও ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ শেষ করার চেষ্টা করবেন এবং আগামী শিক্ষাবর্ষের সময় কমিয়ে দ্রুত সে সময়টাতে কাজে লাগনোর চেষ্টা করা হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যে ছুটি থাকে তাও কমিয়ে আনার ইঙ্গিত দিয়েছেন মন্ত্রী।
প্রাথমিক শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর গত ৭ এপ্রিল থেকে সংসদ টেলিভিশনে প্রাথমিক ক্লাস সম্প্রচারিত হচ্ছে। তবে এতে শতভাগ শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস প্রচার করে ৫৯ থেকে ৫২ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে পাঠ পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। বাকিরা থাকছেন পড়াশুনার বাইরে। তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য ৮ নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে- প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের জন্য ‘হ্যালো টিচার’ নামে নতুন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপস) তৈরি করা। এই অ্যাপস ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা পছন্দের শিক্ষক বাছাই করে তার কাছ থেকে শিক্ষার বিষয়ে পরামর্শ নিতে পারবে। গণিত, ইংরেজি, বাংলা, বিজ্ঞানসহ নির্দিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক বাছাই করে পাঠ সম্পর্কে বুঝতে ও জানতে পারবে। মন্ত্রণালয় বলছে, বেতারে পাঠ প্রচার শুরু হলে আরও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানো যাবে।
দেশের ৯৮ শতাংশের বেশি মানুষ মুঠোফোন ব্যবহার করে। অভিভাবকদের মুঠোফোন ব্যবহার করে শিশুরা অ্যাপসের মাধ্যমে তাদের প্রশ্নের উত্তর জানতে পারবে। এর বাইরে হটলাইন সেবা চালু করার কথাও ভাবা হচ্ছে। যেখানে কিছু নম্বরে ফোন করে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজনীয় বিষয়ে শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানতে পারবেন। এর পাশাপাশি পাঠ প্রচারের সময়সূচি স্থানীয় মসজিদের মাইকের মাধ্যমে অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের জানিয়ে দেয়া, বিদ্যালয়ভিত্তিক প্রশ্নপত্র তৈরি করে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বাড়ি পৌঁছে দেয়া এবং তা যাচাই করা, প্রত্যেক বিদ্যালয়ের নামে ফেসবুক আইডি খুলে পাঠদান কার্যক্রম ভিডিও আপলোড করার বিষয়ে ভাবা হচ্ছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম আল হোসেন জানান, করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের পাঠে মনোযোগী রাখতে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যত দ্রুত এবং যত ভালোভাবে সম্ভব আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছি।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস শুরু হয় ২৯ মার্চ থেকে। তবে ইন্টারনেটে সমস্যা, ডিভাইসের অপর্যাপ্ততা এই ক্লাসের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে তাদের জরিপে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে তারা এর আওতায় আনতে পেরেছেন। তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এই সুযোগের বাইরে থাকছেন। কারণে ইন্টারনেটের গতি অনেক দূর্বল, বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ইন্টারনেট ডিভাইস নেই, শিক্ষকরাও একই সমস্যায় রয়েছেন। প্রশিক্ষণ না থাকাও বড় বাধা হয়েছে তাদের জন্য।
এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। মহাপারিচালক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক জানান, এরই মধ্যে আমরা অনেককে অনলাইন ক্লাসে সংযুক্ত করতে পেরেছি, যারা ক্লাসের আওতায় আসছে না তাদের জন্য ভিন্ন পন্থা নেয়া হবে।
উচ্চশিক্ষা
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক এগিয়ে। তারা বন্ধের মধ্যেই অনলাইনে ক্লাস শুরু চালু রেখেছে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থীও এতে অংশ নিচ্ছে। নতুন সেমিস্টারে ভর্তিও হচ্ছে। উদ্যোগ নেয়া হয়েছে পরীক্ষা গ্রহণেরও। তবে এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিরা এখনো অনলাইনে ক্লাস শুরু করতে পারেনি।
গত মাসে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাথে বৈঠকের পর কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এখানেও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ও ডিভাইসের সংকটের কথাই বলা হচ্ছে। অপরিকল্পিত, অপ্রস্তুত ও বৈষম্যমূলক পন্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা আত্মঘাতি হবে বলে মনে করছেন শিক্ষকরা।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলছে, অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম চালুর আগে প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বাস্তব অসুবিধার কথা বিবেচনা করতে হবে। অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম চালানোর প্রতিবন্ধকতা ও পূর্বশর্তগুলো চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী প্রতিকার ও পদক্ষেপ নেওয়ার পরেই কেবল অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে যাওয়া যেতে পারে।
পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা
করোনার কারণে সাময়িক ও অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা বাতিল হয়ে গেছে। বছরের শেষে জেএসসি, জেডিসি, প্রাথমিক ও ইবতেদায়ীর মতো পাবলিক পরীক্ষা রয়েছে। পরবর্তী ক্লাসে উত্তরণোর জন্য প্রতিটি ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষাও নিতে হবে। কিন্তু এখনো সিলেবাস শেষ না করা এবং কবে নাগাদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে তার নিশ্চিয়তা না থাকায় বিপাকে শিক্ষার্থীরা।
অনিশ্চিত একাদশে ভর্তি-ক্লাস, এইচএসসি, আলিম পরীক্ষা
করোনার মধ্যেই এসএসসি, দাখিল ও সমমানের পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হয়েছে। তবে উত্তীর্ণরা এখনো একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারেননি। অন্যদিকে এইচএসসি, আলিম ও সমমানের পরীক্ষা এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও সেটি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এর সাথে সংযুক্ত রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি। রেজাল্ট হলেই কেবল এই কার্যক্রম শুরু হবে।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার সংসদে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতেও ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি নীতিমালা-২০২০ ইতোমধ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে। গত ৩১ মে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলেও কোভিড-১৯ এর কারণে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। ভর্তির বিষয়ে শিক্ষাবোর্ড প্রস্তত রয়েছে। খুব শিগগিরই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হবে। এবার ২০ লাখ ৪০ হাজার ২৮ জন শিক্ষার্থী মাধ্যমিকের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেয়, তাদের মধ্যে ১৬ লাখ ৯০ হাজার ৫২৩ জন পাস করেছে। অর্থাৎ তারাই এবার একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির আবেদন করবে।
বিদেশে পড়ার সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীরা অনিশ্চয়তায়
ইউনেসকোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষার্থী দেশের বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। সবচেয়ে বেশি যান মালয়েশিয়ায়। এরপর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, কানাডা, ভারত ও জাপান। এছাড়া অন্য দেশেও বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন। শিক্ষামূলক পরামর্শক সংগঠন ফরেন অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টের কনসালটেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ফ্যাকড-ক্যাব) জানিয়েছে, বছরে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখের মতো শিক্ষার্থী তাদের বিভিন্ন এজেন্সিতে পরামর্শের জন্য যান।
গত বছরের শেষ দিকে করোনাভাইরাস ছড়াতে শুরু করে। এ বছরে এসে তা মহামারি আকার ধারণ করেছে। যেসব দেশে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা যান, সেসব দেশেও করোনা ছড়িয়েছে। যেখানে প্রকোপ সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, ক্লাস চলে অনলাইনে। বাংলাদেশেও প্রতিদিন করোনায় সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। যেসব শিক্ষার্থীর গ্রীষ্মের সেশনে যাওয়ার কথা ছিল, তারা এখন আটকা পড়েছেন।
শিক্ষার্থীদের ঋণ দেয়ার প্রস্তাব
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসে টানতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে দুটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। ফ্রি ইন্টারনেট সুবিধা নিশ্চিতকরণ ও স্মার্টফোন কিনতে সহজ ঋণের ব্যবস্থা করার এ প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। গত ৩০ জুন ইউজিসি থেকে এ প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
করোনাভাইরাসের প্রভাবের ফলে বর্তমানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে। অনলাইনে ক্লাস শুরু করতে পারেনি অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলো। গত ২৫ জুন ইউজিসির সঙ্গে এক ভার্চুয়াল সভায় ৪৬ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করতে সম্মতি জানিয়েছেন। তার ভিত্তিতে গত ৩০ জুন ইউজিসিতে থেকে দুটি প্রস্তাব উল্লেখ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তাতে শিক্ষার্থীদের ফ্রি ইন্টারনেট প্রদান ও যাদের স্মার্ট ফোন নেই তাদের লোনের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।
ডিপিআর/ জাহিরুল মিলন