কক্সবাজার সংবাদাতা:কক্সবাজার ঝিলাংজা মৌজার কলাতলী পিবিআই’র আফিস ব্যুরোর জমি অধিগ্রহণে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় ২৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অবশেষে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) প্রধান করে ৬ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
কক্সবাজারের সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে মামলাটি দায়ের করেন কক্সবাজার শহরের সৈকতপাড়ার মৃত নুরুল কবিরের ছেলে নুরুল আলম।
মামলায় কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আশরাফুল আফসার, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. শামীম হোসাইন, সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা আবু হাসনাত মো. শহিদুল হক, সাবেক অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা দেবতোষ চক্রবর্তী, সাবেক সার্ভেয়ার মো. সোহেল মিয়াজী, সাবেক সার্ভেয়ার মো. মাহবুবুর রহমান, কক্সবাজার শহরের সৈকত পাড়ার মৃত সুলতান আহমদের ছেলে মোহাম্মদ ইদ্রিছ সিআইপি (গর্জনিয়া), ইদ্রিছ সিআইপির স্ত্রী জিনাত রেহেনা, কক্সবাজার সদর মডেল থানার সাবেক ওসি মোহাম্মদ শাহজাহানের স্ত্রী ফেরদৌসী আক্তার পাপড়ী, শহরের বাহারছড়ার মৃত রশিদ আহমদের ছেলে এডভোকেট নুরুল হক (ইসলামাবাদ), কলাতলী আদর্শগ্রামের সিরাজ আহমদের ছেলে বেলায়েত হোসেন, চকরিয়া ডুলাহাজারা ইউনিয়নের পশ্চিম মাইজপাড়ার এনামুল হকের ছেলে নাছির উদ্দিন, ছাতক থানার ছাতক পৌরসভার মন্ডলীভোগ এলাকার মোঃ আবুল কাশেমের ছেলে মো. টিপু সুলতান ও ইলিয়াছ ব্রাদার্সের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আলহাজ নুরুল আবছারকে আসামী করা হয়েছে।
আদালত ফৌজদারি দরখাস্তটি আমলে নিয়ে রেকর্ডভূক্ত করেছেন। একই সাথে অভিযোগ তদন্ত করে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ধারায় আমলে নেয়া কোন ফৌজদারি দরখাস্ত দুর্নীতি দমন কমিশনকে তদন্তে না দিয়ে জেলা প্রশাসককে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া কতটুকু যৌক্তিক তা প্রশ্ন তুলেছেন অনেক আইনজীবী।
আইনজীবীরা বলছেন, সাধারণত এসব আইনের ধারায় দায়েরকৃত মামলাগুলো দুদককে তদন্তে দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে দায়েরকৃত মামলার বাদি পক্ষের আইনজীবী এডভোকেট সম্যক দৃষ্টি বড়–য়া বলেন দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ধারায় দায়েরকৃত দরখাস্তগুলো আমলে নিলে দুদককে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু জেলা প্রশাসকের অধীনস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা জেলা প্রশাসককে তদন্তের দায়িত্ব দেয়ায় স্বাভাবিকভাবেই একটি আশঙ্কা তৈরী হয়েছে। এক্ষেত্রে মামলার তদন্ত প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন ভূক্তভোগী। এরপরও আদালতের আদেশকে সম্মান জানিয়ে আদালতের পরবর্তী কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনে এ বিষয়টি উচ্চ আদালতের নজরে আনা হবে।
পিবিআই এর জমি অধিগ্রহণে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘কোন অনিয়মই আমি ছাড় দিই না। এ বিষয়ে অধীনস্তদের আমি কঠোর নির্দেশনা দিয়েছি। পিবিআই এর বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার পর আমি ৩ সদস্য বিশিষ্ঠ একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি করে দিয়েছিলাম। তারা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার পরই ক্ষতিপূরণের টাকা ছাড় দেয়া হয়েছে। এখানে অনিয়মের কোন সুযোগ নেই।’
মামলা সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজারের কলাতলীর ঝিলংজা মৌজায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশনের (পিবিআই) অফিস ভবন নির্মাণ প্রকল্পের জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এল.এ ০৪/২০১৮-১৯ইং নং মামলা মূলে বি.এস ১৭০৫০, ২০৩০৭, ২০৩০৬ ও ২০১৬৩ দাগের প্রায় এক একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। জমি অধিগ্রহণে মোহাম্মদ ইদ্রিছ সিআইপি, নুরুল হক ও বেলায়েত হোসেনের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট গঠন করা হয়।
সিন্ডিকেটে নাছির উদ্দিন, টিপু সুলতান, ফেরদৌসী আক্তারসহ সিন্ডিকেট সদস্যদের স্ত্রী এবং বিভিন্ন নামে-বেনামে প্রায় ২৮ কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে। সেখানে শুধু মামলার বাদি নুরুল আলম নয়, মফিজুর রহমান, সেলিম গং, ইলিয়াছ সওদাগরসহ বিভিন্ন মানুষের জমি জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে অধিগ্রহণ দেখিয়ে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। জমির প্রকৃত মালিকরা সেখানে ক্ষতিপূরণের কোন টাকা পাননি।জমির প্রকৃত মালিকরা কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকসহ সরকারের বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ দিয়েও কোন প্রতিকার পাননি।
এমনকি আদালতের আশ্রয় নিলেও আদালতের নিষেধাজ্ঞাকেও পরোয়া করেননি সিন্ডিকেট সদস্যরা। আদালত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আশরাফুল আফসার ও ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তাকে শোকজও করেছিলেন। কিন্তু মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে জমির প্রকৃত মালিকদের একাধিক অভিযোগ এবং মামলাকে পাশ কাটিয়ে পূর্বের তারিখ দিয়ে কৌশলে সিন্ডিকেট সদস্যদের নামে-বেনামে ক্ষতিপূরণের চেক ইস্যু করে সরকারি টাকা আত্মসাতের সুযোগ করে দেন সরকারি কর্মকর্তারা। শুধু তাই নয়, বাতিলকৃত খতিয়ান দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। জমি না থাকলেও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল পরিমান টাকা তুলে নেয়া হয়েছে।
এক্ষেত্রে দেখা যায়, ঝিলংজা মৌজার বি.এস ৫৭২ নং খতিয়ানের বি.এস ২০৩০৬ দাগ থেকে ১৯৯১ সালে সড়ক ও জনপথ বিভাগ ১৩/৯১-৯২ নং মামলা মূলে ০.৮৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে। সওজ এর ট্রেসম্যাপ অনুযায়ী অধিগ্রহণকৃত জমি বাদে রাস্তার দক্ষিণ পাশে ০.০৯ একর জমি অবশিষ্ট থাকে। কিন্তু জালিয়াতির মাধ্যমে মূল তথ্য গোপন করে রাস্তার দক্ষিণ পাশে বি.এস ২০৩০৬ দাগ থেকে ০.১৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এভাবে ০.০৯ একর জমির অস্থিত্ব না থাকলেও তা অতিরিক্ত অধিগ্রহণ করে সরকারের বিপুল অঙ্কের টাকা আতœসাৎ করা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, অধিগ্রহণকৃত ০.১৮ একর জমির মধ্যে ০.০২ একর জমির বি.এস ১২৩৩৬ নং খতিয়ানটিই বাতিল। ওই বাতিল খতিয়ান দেখিয়েই জমির ক্ষতিপূরণের টাকা নেয়া হয়েছে। এছাড়া এক জায়গা দুই বার দেখিয়েও টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এভাবে নানা জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি এসব টাকা আত্মসাৎ করা হয়। যা নিরপেক্ষ তদন্ত করলে পিলে চমকানোর মতো তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে জানান ভূক্ত ভোগীরা।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিন্ডিকেটটি এতোই শক্তিশালী যে কোভিড-১৯ এর কারণে লকডাউন চলাকালীন সময়ে অতিগোপনে ভূমি অধিগ্রহন শাখার অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে পূর্বের তারিখ দিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকার চেক তুলে নিয়েছেন। চেকের তারিখ, ট্রেজারি, সোনালি ব্যাংক ও স্ব স্ব ব্যাংকের তারিখ পর্যালোচনা করলে তা বেরিয়ে আসবে। এমনকি ভূমি অধিগ্রহন শাখার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চেকের স্বাক্ষর নিয়েছেন সিন্ডিকেট সদস্যদের বাসা ও হোটেলে গিয়ে। এভাবে এডভোকেট নুরুল হকের নামে দুই দফে ১১৩৫৪১০২ টাকা ও ১০৮৫০৫১৪ টাকা, বেলায়েত হোসেনের নামে দুই দফে ১৪৯৭৯৪৭০ টাকা ও ১০৮৫০০০০ টাকা, এডভোকেট নেজামুল হকের নামে ৫২৪৯১৯৮৭ টাকা, ইদ্রিছ সিআইপির নামে ৫ দফে ৩১৭৭৩৫১ টাকা, ১৯১২৩৮৯ টাকা, ৮৯১৫২৩০ টাকা, ৭৭৪৭৭৫৯ টাকা ও ৩১২৫৬৫৫ টাকা, ইদ্রিছের স্ত্রী জিন্নাত রেহেনার নামে ৩ দফে ৭০৭৫৫৭০ টাকা, ১৯৬৪৫৭০৩ টাকা ও ১৫৬০১৬৫৩ টাকা, মিজানুর রহমানের নামে ২ দফে ৪৩৯৩৭৭ টাকা ও ৭৬৮৫৯৭২ টাকা, নাছির উদ্দিনের নামে ৫২৩৩০৭৩ টাকা, শাওরিন জাহানের নামে ১৪২১৪৯৩২ টাকাসহ বিভিন্ন ব্যক্তির নামে-বেনামে আরও বিপুল অঙ্কের টাকা তুলে নেয়া হয়।
অথচ এদের অনেকের নামে ভূমি অধিগ্রহন শাখা থেকে নোটিশ ইস্যু হয়নি। নামে-বেনামে তুলে নেয়া অধিকাংশ টাকা জমা হয়েছে ইদ্রিছ সিআইপি ও এডভোকেট নুরুল হক এর ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে। এছাড়া পিবিআই এর জমি অধিগ্রহন নিয়ে গড়ে উঠা সিন্ডিকেট এর আরও ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে আসছে।
জানা গেছে, পিবিআই’র জমি অধিগ্রহণের টাকা অবৈধ উপায়ে হাতিয়ে নিতে ঢাকার একজন সিনিয়র সাংবাদিক তদবির করেছেন। ওই তদবিরবাজ সাংবাদিক উপর মহল থেকে বিভিন্ন ক্ষমতাধর আমলা-নেতাকে ফোন করিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা।অবৈধ উপায়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মিশনে সিনিয়র এই সাংবাদিক বেশ কয়েকবার কক্সবাজার এসেছিলেন। লাইভ ফিস রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন নামী-দামী রেস্তোরাঁয় দালাল চক্রের সাথে একাধিকবার বৈঠকও করেছিলেন।