নজর লাগা বা Evil eye: ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ
—————————————
পৃথিবীর সবগুলো প্রধান ধর্মে এবং গ্রিক, মিশরীয়, ব্যবিলন, চীনা, ভারতীয়, মায়ান, রোমানসহ সকল প্রধান সভ্যতায় বিস্ময়করভাবে কিছু বিষয়ে সাদৃশ্য আছে। তার মধ্যে একটি হল “নজর লাগা বা বদ নজর”।
অপরের ভাল দেখে হিংসা বা ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে তাকানোই হল বদ নজর। সব ধর্মই বদ নজর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে, আমি এখানে চারটি প্রধান ধর্মের অবস্থান চম্বুকাংশ উল্লেখ করছি।
এক- ইহুদি ধর্ম
—————————
ইহুদি ধর্মের পবিত্রগ্রন্থ তোরাহ বা বাইবেলের আদিপুস্তকে উল্লেখ আছে,
….and thine eye be evil against thy poor brother, and thou givest him nought; and he cry unto the Lord against thee, and it be sin unto thee
—Deuteronomy 15:9
ইহুদি ধর্মের অন্যতম পবিত্রগ্রন্থ তালমুদে,
One who enters a city and fears the evil eye should hold the thumb of his right hand in his left hand and the thumb of his left hand in his right hand and recite the following: I, so-and-so son of so-and-so, come from the descendants of Joseph, over whom the evil eye has no dominion.
—Berakhot 55b
দুই- খৃষ্টধর্ম
————————
বাইবেলের আদি পুস্তক তথা ওল্ড টেস্টামেন্ট খৃষ্টানদেরও পবিত্র তাই ডিউটরনোমির পংক্তি এখানে সমান প্রাসঙ্গিক। এছাড়া বাইবেলের নতুন পুস্তক বা নিউ টেস্টামেন্টেও একাধিক জায়গায় বদ নজর নিয়ে বলা হয়েছে যেমনঃ
Is it not lawful for me to do what I will with mine own? Is thine eye evil, because I am good?
—Matthew 20:15
Thefts, covetousness, wickedness, deceit, lasciviousness, an evil eye, blasphemy, pride, foolishness:
All these evil things come from within, and defile the man.
—Mark 7:22-23
The light of the body is the eye: therefore when thine eye is single, thy whole body also is full of light;
but when thine eye is evil, thy body also is full of darkness
—Luke 11:34-36
তিন- হিন্দুধর্ম
————————
হিন্দুধর্মের গ্রন্থগুলোতে বদ নজরকে বলা হয়েছে “দৃষটি” যা “আওরা” এর জন্য হয়। বদ নজর থেকে রক্ষা পেতে হিন্দু পুরোহিতরা কপালে কালো টিকা বা কাজল পরতে বলেন।
চার- ইসলাম
————————
ইসলামে বদ নজর এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে পবিত্র কুরআনের দুইটা সম্পূর্ণ সূরা (আল ফালাক এবং আন নাস) নাজিল করা হয়েছে এই সংক্রান্ত ব্যাপারে।
বলুন, আমি পানাহ চাচ্ছি প্রভাতের পালনকর্তার,
তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে,
অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট থেকে, যখন তা সমাগত হয়,
গ্রন্থিতে ফুঁৎকার দিয়ে জাদুকারিণীদের অনিষ্ট থেকে
এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে।
—আল ফালাক: ১-৫
কাফিররা যখন কুরআন শুনে তখন তারা যেন তাদের দৃষ্টি দিয়ে তোমাকে আছড়ে ফেলবে। আর তারা বলে, ‘‘সে তো অবশ্যই পাগল।’’
—আল কালাম: ৫১
রাসুলুল্লাহ সাঃ একাধিক বার বদ নজর নিয়ে সর্তক করেছেন,
তোমরা বদ নজরের খারাপ প্রভাব থেকে রক্ষার জন্যে আল্লাহ তায়ালার সাহায্য প্রার্থনা কর। কেননা তা সত্য।
—ইবনে মাযাহ: ৩৫০৮
১২শ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক এবং দর্শনিক ইবনুল কাইয়্যিম জাওযি নজর লাগার ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন,
“যুগ যুগের জ্ঞানীজনেরা বদ নজরকে অস্বীকার করেননি, যদিও তারা তার কারণ এবং দিক নিয়ে মতভেদ করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা মানুষের শরীর ও আত্মায় বিভিন্ন প্রকারের ক্ষমতা ও প্রাকৃতিক ক্রিয়াশীলতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আর এদের ভেতর অপরকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাও দিয়েছেন।
কোন জ্ঞানী ব্যক্তি শরীর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আত্মার প্রতিক্রিয়ার অস্বীকার করতে পারবে না, কেননা এটা এমন একটি বিষয় যা আমরা দৈনন্দিন জীবনে পরিলক্ষিত ও অনুভব করতে পারি। যেমন মানুষের চেহারা লাল রং ধারণ করে যখন তার দিকে কোন লজ্জাকারী ব্যক্তির দৃষ্টি পড়ে। তেমনি ভাবে ভয়ের কিছু দেখলে হলদে রং ধারণ করে। আর এসব আত্মার প্রভাবে হয়ে থাকে। আর যেহেতু আত্মার সম্পর্ক চোখের সাথে খুবই গভীর এজন্য এটাকে চোখ লাগা বলা হয় কিন্তু চোখের নিজস্ব এমন কোন প্রভাব নেই বরং প্রতিক্রিয়া কেবল আত্মার মাধ্যমে হয়ে থাকে। আর আত্মার মত, প্রকৃতি ও এর গুণ বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। সুতরাং হিংসুক থেকে হিংসার মাধ্যমে হিংসাকৃতের উপর স্পষ্ট কষ্টের প্রভাব পড়ে”।
কুরআনের শেষ দুইটা সুরা ছাড়াও রাসুলুল্লাহ সাঃ বদ-নজর থেকে বাঁচতে বেশ কিছু দোয়া শিখিয়েছেন। যেমনঃ
“আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালামসমূহের মাধ্যমে শয়তানের সব আক্রমণ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। বিষধর প্রাণীর ও বদনজরকারীর অনিষ্টতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি।”
—বুখারি
আমার পরিচিত মহলে অনেকেই বিশেষত স্বামীর বা স্ত্রীর আন্তরিকতাপূর্ণ সময়ের, ঘুরতে যাওয়া, উপহার লেনদেন ইত্যাদির ছবি ফেইসবুকে দেন। অনেক বেশিই দেন। আমি কখনো এমন পোস্ট করবো না, মনে মনে এটা বলেই এই পোস্টগুলো এড়িয়ে যেতাম।
এখন মনে হচ্ছে কিছু বলা উচিত। কারন কিছু মানুষের ইতিহাস চোখে পড়লো যারা পারিবারিক কলহের কারনে আত্নহননের দিকে চলে গেছেন কিন্তু ফেইসবুকে স্বামী/স্ত্রীর সাথে প্রেমময় ছবিতে ভরা। ব্যাপারটা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, বদ নজর মানুষকে কবর পর্যন্ত পৌঁছে দেয় আর উটকে পাতিলে। সবাই হয়তো এই ব্যাপারটা সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন না, তাই এই লেখা।
মুসলমানদের জন্য শুধু ইসলামের অংশটা লিখলেই হতো। কিন্তু তারপরেও বিভিন্ন সভ্যতা এবং ধর্মের কথা উল্লেখ করলাম কারন আপনার যদি আপনার ধর্মের প্রতি বিশ্বাস শক্ত না হয়। সেটা হতেই পারে, আমার কোন মন্তব্য নেই।
তবে সবগুলো প্রধান ধর্ম এবং সবগুলো সভ্যতা যে বিষয়ে এতটা গুরুত্ব দিয়েছে সেটাকে হেলায় উড়িয়ে দেওয়া অর্থ আপনি হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা মানুষের “collective intelligence” কে অবজ্ঞা করলেন।
লেখক:মীর সালমান শামিল।