প্রত্যয় নিউজডেস্ক: বিনিয়োগকারীদের নামমাত্র লভ্যাংশ দেয়া প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম চলতি বছরের মে মাস শেষে ছিল ৩৭ টাকা ৬০ পয়সা। সেই শেয়ারের দাম টানা বেড়ে এখন (১৫ অক্টোবর পর্যন্ত) ১৪৭ টাকায় উঠেছে। অর্থাৎ দাম বেড়েছে ২৯১ শতাংশ বা চার গুণ।
অন্যভাবে বলা যায়, কোনো বিনিয়োগকারী ৩১ মে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের এক লাখ টাকার শেয়ার কিনে সেই শেয়ার ধরে রাখলে বর্তমানে তার বিনিয়োগ করা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৯১ হাজার টাকায়। অর্থাৎ এক লাখ বিনিয়োগ করে সাড়ে চার মাসে লাভ দুই লাখ ৯১ হাজার টাকা।
হঠাৎ শেয়ারের দাম এমন ফুলে-ফেঁপে উঠলেও প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের লভ্যাংশ দেয়ার ইতিহাস খুব একটা ভালো নয়। ২০১৮ সালে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছিল।
তার আগে অর্থাৎ ২০১৭ সালে ১০ শতাংশ বোনাস এবং ২০১৬ সালে ২ শতাংশ নগদ ও ৮ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়। এছাড়া ২০০৬ থেকে পরবর্তী প্রতিটি বছরে কোম্পানিটি লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার দিয়েছে। অর্থাৎ কোম্পানিটির লভ্যাংশ অনেকটাই বোনাস শেয়ারনির্ভর।
বীমা খাতের আরেক কোম্পানি এশিয়া প্যাসিফিক জেনারেল ইন্স্যুরেন্স। ২০১৯ ও ২০১৮ সালে ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়া এ কোম্পানি ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। অর্থাৎ এক শেয়ারের বিপরীতে কোম্পানিটি বছরে লভ্যাংশ হিসেবে বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ দেড় টাকা পর্যন্ত দিতে পেরেছে।
এমন একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম গত আড়াই মাসে বেড়েছে আড়াইশ’ শতাংশের ওপরে। এশিয়া প্যাসিফিক জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম গত ২ জুলাই ছিল ১৯ টাকা ১০ পয়সা। যা ২৫৫ শতাংশ বেড়ে এখন ৬৭ টাকা ৮০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।
শুধু প্যারামাউন্ট বা এশিয়া প্যাসিফিক জেনারেল ইন্স্যুরেন্স নয়, সম্প্রতি প্রায় সবকটি বীমা কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে। হঠাৎ বীমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম বৃদ্ধির হারকে অস্বাভাবিক বলছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, সম্প্রতি অনেক বীমা কোম্পানির শেয়ারের দাম একশ’ থেকে দুইশ’ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এই দাম বাড়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এমন দাম বাড়া অস্বাভাবিক। সাধারণ বিনিয়োগকারী তথা সার্বিক শেয়ারবাজারের জন্য এটি ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। কোনো চক্র মুনাফা হাতিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম এমন ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলছে কিনা, নিয়ন্ত্রক সংস্থার তা খতিয়ে দেখা উচিত।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম গত ৭ জুলাই ছিল ১৮ টাকা ৩০ পয়সা। এখন সেই শেয়ারের দাম বেড়ে ৫৫ টাকা ৬০ পয়সা হয়েছে। অর্থাৎ শেয়ারের দাম বেড়েছে ২০৪ শতাংশ।
এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম গত ২ জুলাই ছিল ১৭ টাকা, যা টানা বেড়ে এখন ৪৮ টাকা ২০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। এ হিসাবে দাম বেড়েছে ১৮৪ শতাংশ। ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম গত ২ জুলাই ছিল ২৯ টাকা ৮০ পয়সা। যা ১৫২ শতাংশ বেড়ে এখন ৮০ টাকা ৫০ পয়সা হয়েছে।
একইভাবে নিটল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম গত ১৩ জুলাই ছিল ২১ টাকা ৮০ পয়সা, যা ১৪৩ শতাংশ বেড়ে এখন ৫৩ টাকা হয়েছে। ২ জুলাই ১৮ টাকা ৮০ পয়সায় থাকা রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম ১৩১ শতাংশ বেড়ে এখন ৪৩ টাকা ৫০ পয়সা হয়েছে। পূরবী জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম ১২৩ শতাংশ বেড়ে ২৬ টাকা ৭০ পয়সা হয়েছে, যা গত ২ জুলাই ছিল ১২ টাকা।
এভাবে প্রায় সবকটি বীমা কোম্পানির শেয়ারের দাম সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। এই দাম বাড়া ‘অস্বাভাবিক’ উল্লেখ করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সভাপতি ড. মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, ‘যে হারে বীমা কোম্পানিগুলোর শেয়ার দাম বেড়েছে তা অস্বাভাবিক। বীমা খাতে হঠাৎ এমন কিছু ঘটে যায়নি যে শেয়ারের এমন দাম বাড়বে। এই দাম বাড়ার পেছনে কোনো চক্র আছে কি-না, তা নিয়ন্ত্রক সংস্থার খতিয়ে দেখা উচিত।’
তিনি বলেন, বীমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম যে হারে বেড়েছে তা অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। এই দামে শেয়ার কিনে যে কোনো বিনিয়োগকারী লোকসানের মুখে পড়তে পারেন। তাই বিনিয়োগের আগে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভালো করে তথ্য যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গুজবের ভিত্তিতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলে ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে।
এদিকে শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণে সম্প্রতি কয়েকটি বীমা কোম্পানিতে মার্জিন ঋণ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইউসিবি ক্যাপিটাল। এতে গত ১২ অক্টোবর শেয়ারবাজারে বীমা খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দরপতন হয়। পরের দিন ১৩ অক্টোবর ইউসিবি ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) ডেকে নিয়ে শোকজ করে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ মনে করায় ইউসিবি ক্যাপিটাল কিছু বীমা কোম্পানির শেয়ারের মার্জিন ঋণ না দেয়ার সিদ্ধান্ত জানায়। আমি মনে করি, ইউসিবির সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। কারণ এখন প্রায় সবকটি বীমা কোম্পানির শেয়ারের দাম অতিমূল্যায়িত। ইতোমধ্যে বীমার শেয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে বাজারে। এই দামে শেয়ার কিনে যে কোনো বিনিয়োগকারী ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন।
তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বীমা কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। কারণ মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে বীমা খাতের ব্যবসায় এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর সঙ্গে সম্প্রতি মোটর বীমার তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা তুলে দেয়া হয়েছে। এখানে বীমা কোম্পানিগুলোর আয় কমে যাবে। সুতরাং চলমান বছরে বীমা কোম্পানিগুলোর আয় বাড়ার বদলে কমার আশঙ্কা বেশি। এমন পরিস্থিতিতে শেয়ারের দাম একশ’ থেকে দুইশ’ শতাংশ পর্যন্ত কোন যুক্তিতে বাড়ছে, তা সংশ্লিষ্টদের খতিয়ে দেখা উচিত।
সম্প্রতি শেয়ারের দাম বাড়ার বিষয়ে কোনো বীমা কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কেউ সরাসরি বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জানান, গড়পড়তা বীমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম যে হারে বেড়েছে তা অস্বাভাবিক। তবে বাজারে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করা যায় না। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী নির্ভর হওয়ায় শেয়ারের দাম বাড়া বা কমার ক্ষেত্রে গুজব বড় ভূমিকা রাখে।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি ও নিটল ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান এ কে এম মনিরুল হক বলেন, ‘শেয়ারবাজার সম্পর্কে আমার আসলে ভালো ধারণা নেই। সুতরাং বীমা কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ার বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’
অবশ্য তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা তুলে দেয়ার কারণে সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানান একাধিক বীমা কোম্পানির সিইও।
এ বিষয়ে সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. জাহিদ আনোয়ার খান বলেন, তৃতীয় পক্ষের বীমা তুলে দিলেও কম্প্রিহেনসিভ বীমা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। সুতরাং পরিবহনের ক্ষেত্রে এখন বীমা করা বাধ্যতামূলক নয়। এতে সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর আয়ে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ বাংলাদেশে যে মোটর বীমা হয় তার প্রায় সম্পূর্ণ অংশ তৃতীয় পক্ষের বীমা।