প্রত্যয় ডেস্ক: নতুন করে সংক্রমণে ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে সরকারগুলোর ফের জারিকৃত লকডাউন সংক্রান্ত বিধিনিষেধের কবলে পড়েছে ইউরোপের কোটি কোটি মানুষ। এক সপ্তাহের ব্যবধানে মহাদেশটিতে করোনার সংক্রমণ ৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘মারাত্মক উদ্বেগের’ বলে সতর্ক করার পর বিধিনিষেধ আরও বাড়ছে। শনিবার সন্ধ্যা থেকে প্যারিসসহ ফ্রান্সের বেশ কিছু শহরে এক মাসব্যাপী রাত্রীকালীন কারফিউ শুরু হয়েছে। রাজধানীসহ অন্যান্য এলাকায় দুই পরিবারের মিলিত হওয়া নিষিদ্ধ ইংলান্ডে। ইতালির সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চলে খেলাধুলার আয়োজন বাতিল ছাড়াও নির্দিষ্ট সময় বার খোলার রাখার নির্দেশনা জারি হয়েছে।
একদিনে রেকর্ড সর্বোচ্চ ৩২ হাজারের বেশি শনাক্ত হওয়ার পর এমন পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল ফ্রান্সের জন্য। বছরের প্রথমদিকে করোনার যে সংক্রমণ ছিল তাতে লকডাউন নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সব অচল করে দেয়া হয়। এখনকার সংক্রমণ তাকেও ছাড়িয়েছে। শুক্রবার প্রথমবার একদিনে ৪ লাখের বেশি শনাক্ত হয়েছে। নতুন সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ায় সরকারগুলো লকডাউন নিষেধাজ্ঞা ফের বহাল করার পথে হাঁটছে। কিন্তু অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি যে কতটা ভয়াবহ তা ইতোমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ব। ফলে অনেকে সরকারের নতুন করে আরোপিত বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আদালতের শরণাপন্নও হয়েছেন।
রাজধানী অঞ্চল প্যারিস ছাড়াও ফ্রান্সের আরও আটটি শহরের বাসিন্দারা শনিবার থেকে রাত ৯টা থেকে সকাল ৬টার কারফিউয়ের কবলে পড়েছে। প্রতিনিয়ত সেখানে এমন হারে সংক্রমণ বাড়ছে যে অনেকে আশঙ্কা করছেন ইউরোপে এই অঞ্চল আরও একবার মহামারি করোনা প্রাদুর্ভাবের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা আর করোনার কারণে এমনিতেই ব্যবসায়ে বিরাট ক্ষতির মুখে থাকা রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা সরকারের নতুন এই কারফিউ নিয়ে নাখোশ। জেরার্ড নামে এক রেস্তোরাঁ ব্যবস্থাপক বলছেন, ‘রাত ৯টায় বন্ধ করে দেয়ায় তা মহামারির ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। সঠিক উপায়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।’
ইউরোপে মহামারি করোনায় সবচেয়ে বিপর্যস্ত দেশগুলোর একটি যুক্তরাজ্য। প্রায় ৭ লাখ করোনা সংক্রমিত মানুষের মধ্যে ৪৩ হাজার মারা গেছে। কিন্তু সংক্রমণ বাড়ায় সরকার বিধিনিষেধ জোরালো করে লন্ডনসহ বেশ কিছু শহরে এক পরিবারের সঙ্গে অপর পরিবারের দেখা-সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করায় তা সমালোচনার মুখে পড়েছে। নতুন বিধিনিষেধ আরোপের কারণে ২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ অর্থাৎ ইংল্যান্ডের অর্ধেক জনগণ এখন কঠোর সামাজিক বিধিনিষেধের মুখে। নতুন করে সরকার যে তিন স্তরের বিধিনিষেধ আরোপ করছে, নিজেদের শহরকে সর্বোচ্চ বিধিনিষেধের আওতায় ফেলায় তাতে আপত্তি জানিয়েছেন উত্তর-পশ্চিম ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন স্বীকার করেছেন যে, স্থানীয় পর্যায়ে বিধিনিষেধের এই নীতি বেদনাদায়ক। তবে নতুন করে যেন আবার আগের মতো লকডাউন দিয়ে সব অচল করে দিতে না হয় তাই এসব বিধিনিষেধ দেয়া হচ্ছে। দেশটির অন্যতম অঞ্চল উত্তর আয়ারল্যান্ডে গত শুক্রবার থেকে এক মাসের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে রেস্তোরাঁ ও পাব। এ ছাড়া স্কুলছুটির সময়সীমা আরও বাড়ানো হয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৭ হাজার ৮৩০ জনের দেহে মহামারি করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর দেশের মানুষকে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল। তিনি বলেছেন, আগামী সপ্তাহে কি ঘটতে যাচ্ছে তার ওপর নির্ভর করছে আসন্ন শীত ও আমাদের বড়দিনের উৎসব কেমন হবে। তবে আগাম বার ও রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের জারিকৃত এক বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে গত শুক্রবার রায় দিয়েছেন রাজধানী বার্লিনের একটি আদালত। করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ঠেকাতে জার্মানির জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সবশেষ আইনগত ধাক্কা ছিল এটি।
ইতালির ধনী অঞ্চল লোম্বার্ডিতে মধ্যরাতে বোর বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে গত ফেব্রুয়ারির দিকে ইতালিতে যে মারাত্মক প্রকোপ দেখা দিয়েছিল তাতে সবচেয়ে বিপর্যস্ত ছিল এই অঞ্চল।
এদিকে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার ইউরোপের আরেক দেশ স্লোভাকিয়া ঘোষণা দিয়েছে যে, দশ বছরের বেশি বয়সী দেশের সকল নাগরিকের করোনা পরীক্ষা করা হবে। ৫৪ লাখ মানুষের এই দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইগোর মাতোভিচে বলেছেন, বিনামূল্য সবার জন্য করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় করোনা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরও কঠোর করেছে সুইজারল্যান্ড। এ দিকে দৈনিক রেকর্ড সর্বোচ্চ কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক এবং বেলজিয়ামেও। মধ্যরাত থেকে কারফিউ এবং চার সপ্তাহের জন্য ক্যাফে রেস্তোরাঁ বন্ধ ঘোষণা করেছে বেলজিয়াম।
প্রধান শহরগুলোর স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিয়েছে পোল্যান্ড। এ ছাড়া রাত ৯টার পর বন্ধ হবে রেস্তোরাঁ। মহামারি করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে অস্ট্রিয়া, স্লোভেনিয়া এবং হাঙ্গেরিতেও। শনিবার থেকে জনসম্মুখে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছে স্লোভেনিয়া। ইউরোপের বাকি দেশগুলোর করোনা পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক।