বিশেষ প্রতিবেদন:
সকলেই জানতেন। কিন্তু সেই জানাকেই রীতিমতো অজানা বানিয়ে দিল সুপার সাইক্লোন আমফান। প্রথমে দক্ষিণবঙ্গের উপকূল, তার পর গোটা দক্ষিণবাংলা জুড়েই রীতিমতো তাণ্ডব চালাল এই ঘূর্ণিদানব। তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে প্রবল ধ্বংসলীলা চালিয়ে গেল দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে। তার পর আরও ঘণ্টা পাঁচেক ধরে চলেছে তার দাপট। স্মরণাতীত কালে আর কোনও ঝড় পশ্চিমবাংলাকে এমন ভাবে অসহায় করে দিয়েছে বলে প্রায় কেউই মনে করতে পারছেন না।
উন্নত প্রযুক্তির হাত ধরে আবহাওয়া দফতর এই ঘূর্ণিঝড়ের যে পূর্বাভাস দিয়েছিল, এদিন তা পুরোপুরি মিলে গিয়েছে। এমনকী, এই সাইক্লোন থেকে রেহাই পায়নি মহানগরী কলকাতাও। সবচেয়ে বড় কথা, বুধবার কলকাতায় এই ঝড় আছড়ে পড়েছে ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটারেরও বেশি অস্বাভাবিক গতিতে।
আয়লার তেজকেও হার মানিয়ে দিয়েছে এই আমফান। ২০০৯ সালে আয়লার সার্বিক গতি ছিল ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। কলকাতায় সেই ঝড় বয়ে গিয়েছিল ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে। কিন্তু এদিন আমফানের তাণ্ডবে সেই আয়লাও ম্লান হয়ে গিয়েছে।
কলকাতার বহু জায়গায় পুলিশের গার্ড রেল উড়ে গিয়েছে। অসংখ্য রাস্তায় ভেঙে পড়েছে গাছ। উপড়ে গিয়েছে অনেক ল্যাম্পপোস্ট। বেশ কিছু জায়গায় বাড়ির উপরেও গাছ পড়েছে। শুধু ঝড় নয়, এদিন কলকাতাকে রীতিমতো নাস্তানাবুদ করে দেয় বৃষ্টিও। বহু রাস্তা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। কলকাতার বহু পুরনো বাড়ি থেকে বাসিন্দাদের নিকটবর্তী সুরক্ষিত স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার ঘোষণা করা হয়, কেউ যেন দুপুর বারোটার পর রাস্তায় বের না হন। তাই বিকেলে ঝড় বয়ে যাওয়ার সময় কলকাতার পথঘাট ছিল প্রায় জনহীন।
তাজপুর, দিঘা, হলদিয়া, সাগরদ্বীপ —কোথায় ধ্বংসলীলা চালায়নি এই ঝড়! নবান্ন সূত্রে খবর, গোটা বাংলায় কমপক্ষে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। সঠিক সংখ্যা জানা যাবে হয়তো বৃহস্পতিবার। দুই ২৪ পরগনা এবং দুই মেদিনীপুর সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রচুর বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে। বকখালিও লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে। সেখানকার বহু কঁাচাবাড়ি ভেঙে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে বহু গাছ এবং বাড়ির দেওয়াল। রাস্তাঘাটে অনেক বড় বড় ল্যাম্পপোস্ট উপড়ে পড়েছে। প্রচুর বাড়ির অ্যাসবেস্টসের চাল উড়ে গিয়েছে। ঝড় শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্যুৎহীন হয়ে যায় দক্ষিণবঙ্গের বহু অঞ্চল।
এদিন দুপুর আড়াইটে নাগাদ স্থলভাগে ঢুকতে শুরু করে আমফান। বিকেল চারটে নাগাদ আমফানের একটি অংশ প্রবল আক্রোশে সাগরদ্বীপে ঢুকে পড়ে। তখন দিঘা থেকে এই ঘূর্ণিঝড়ের দূরত্ব ছিল ৭০ কিলোমিটারের মতো। উত্তাল হয়ে ওঠে সমুদ্র। ঝড়ের ধাক্কায় ভেঙে যেতে থাকে একের পর এক বাঁধ। উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ, দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমার জি প্লট, পূর্ব মেদিনীপুরের জেলিংহাম, সাগরের মৌসুনি দ্বীপের একটি বাঁধও ভেঙে গিয়েছে। এ ছাড়া ভেঙে গিয়েছে নামখানার একটি বাঁধের তিনটি এবং ক্যানিংয়ে মাতলা নদীর উপর একটি বাঁধের দুটি পয়েন্ট।
বেশি রাতের দিকে ঝড়ের দাপট কমলেও দুর্যোগ কমার কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। গভীর রাতেও কলকাতা–সহ দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে ঝোড়ো হাওয়া এবং বৃষ্টির দাপট অব্যাহত রয়েছে। আলিপুর আবহাওয়া দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত এই ঝড় সাইক্লোনের চেহারা বজায় রাখবে। জেলাগুলিতে ঘণ্টায় ৭০ থেকে ১০০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিকেল নাগাদ আবহাওয়ার পরিবর্তন আশা করা যায়।
আমফানের তাণ্ডবে রাজ্যের কতখানি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এদিনই হিসেব করে উঠতে পারেনি পশ্চিমবাংলা সরকার। তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এই ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, ‘কী করে পুনর্বাসনের কাজ করব ভাবতেই পারছি না!’ তাঁর কথায়, ‘এত বছর ধরে কলকাতায় রয়েছি, কিন্তু কখনও এমন ঝড় দেখিনি!’ আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘বাংলার ভয়ঙ্কর সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। দুই ২৪ পরগনার প্রায় সব বাঁধ ভেঙে গিয়েছে।’ রামকৃষ্ণ মিশন–সহ সমস্ত সংগঠনকেই পাশে দাঁড়ানোর জন্য আবেদন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
রাজনৈতিক বিবাদ ভুলে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারের কাছে তিনি সাহায্য চেয়েছেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে টাস্ক ফোর্সের বৈঠক ডেকেছেন। সেখানে ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি ও পুনর্বাসন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। উল্লেখ্য, মঙ্গলবারই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিজে ফোন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ঝড়–সংক্রান্ত সব রকম সাহায্য করার আশ্বাসও দিয়েছিলেন তিনি। এদিন মুখ্যমন্ত্রী জানান, এই ঝড়ে রাজ্যের যে ভয়াবহ অবস্থা হয়েছে, তা থেকে দক্ষিণবঙ্গের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে ১২ থেকে ১৪ দিন লাগবে।