এ এম উবায়েদ: যিনি বাংলার লক্ষণ সেনকে পরাস্ত করে প্রথম বাংলা দখল করেন।
বাংলা ও বিহার অঞ্চলে প্রথম মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন তুর্কি সেনাপতি ও বীর যোদ্ধা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি। তিনি ছিলেন তুর্কি জাতিভুক্ত খিলজি বংশের সন্তান। বখতিয়ার খিলজির পূর্বপুরুষ আফগানিস্তানের গরমশির অঞ্চলে বাস করতেন। অল্প বয়সে তিনি ভাগ্যান্বেষণে বের হন এবং বহু দরবার ঘুরে অযোধ্যার শাসক হুসামুদ্দিনের সেনাবাহিনীতে থিতু হন।
হুসামুদ্দিন তাঁকে ‘ভগবত’ ও ‘ভিউলা’ নামক দুটি পরগনার জায়গির দান করেন। এর পরই তাঁর জীবনধারা বদলে যায় এবং নিজেকে একজন শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠার সুযোগ পান।
একজন যোগ্য শাসক ও সেনাপতি হিসেবে বখতিয়ার খিলজির সুনাম ছড়িয়ে পড়লে দিল্লির শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেকের সুদৃষ্টি লাভ করেন এবং তাঁর আনুগত্য স্বীকারের বিনিময়ে বিহার অভিযানের অনুমতি পান। বিহার বিজয়ের পর বখতিয়ার খিলজির ক্ষমতা ও সামর্থ্য আরো সংহত হয়।
তিনি বিশাল এক বাহিনী গঠন করেন এবং ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা লক্ষ্মণ সেনের শাসনাধীন বাংলার নদীয়া জয় করেন। আকস্মিক আক্রমণে রাজা লক্ষ্মণ সেন প্রধান রাজধানী বিক্রমপুর পালিয়ে যান। এভাবেই বাংলার মাটিতে মুসলিম শাসনের সূচনা হয়।
এরপর তিনি ধীরে ধীরে লক্ষ্মণাবতী, গৌড়সহ সমগ্র উত্তরবঙ্গ বিজয় করেন।
লক্ষ্মণাবতীর নাম পরিবর্তন করে লখনৌতি করে তাকে রাজধানী ঘোষণা করেন। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজি তিব্বত অভিযানে বের হন। কিন্তু উপজাতিদের বিশ্বাসঘাতকতা ও কূটকৌশলের কাছে পরাস্ত হন। এতে তাঁর সেনাদলের বৃহদাংশ ধ্বংস হয়ে যায়। তিব্বত বিপর্যয়ের পর ব্যর্থতার গ্লানি ও শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং দেবকোটে (বর্তমান দিনাজপুর) ফিরে আসেন।
এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। তবে কেউ কেউ বলেন মীর মর্দানের হাতে নিহত হন।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ইতিহাসের পাতায় যতটা উচ্চারিত, যতটা চর্চিত, যতটা স্মরিত; ঠিক ততটাই অবহেলিত ও অজ্ঞাত বখতিয়ারের সমাধিস্থল। বখতিয়ার খিলজির কবর যে এখনো চিহ্নিত আছে তা-ও হয়তো বহু মানুষের জানা নেই। বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা বখতিয়ার খিলজি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় ঘুমিয়ে আছেন। জেলার গঙ্গারামপুর থানায় পীরপালে এখনো টিকে আছে তাঁর সমাধিসৌধ।
অযত্নে-অবহেলায় ধ্বংসের মুখে বখতিয়ার খিলজির সমাধিসৌধও। সমাধিস্থলে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে বারো দুয়ারি ও দীঘির ঘাট এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। ধসে গেছে সমাধিসৌধের দেয়ালের একাংশ। ধারণা করা হয়, বারো দুয়ারি নামে চিহ্নিত স্থাপনাটি মূলত একটি মসজিদ ছিল। মসজিদের মুসল্লি ও কবর জিয়ারতকারীদের অজুর জন্য পাথর বাঁধানো ঘাট তৈরি করা হয়েছিল। সমাধি ও বারো দুয়ারি পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। তবে ব্রিটিশ সার্ভেয়ার স্যার ফ্রান্সিস বুকানন হামিল্টন, যিনি ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে উত্তরবঙ্গ ও বিহারের জরিপকাজে নিযুক্ত হন। তিনি বখতিয়ার খিলজির সমাধির বিবরণ দেওয়ার সময় বারো দুয়ারির ভেতরে একটি কবর আছে বলে উল্লেখ করেছেন। স্যার হামিল্টনের ধারণা বারো দুয়ারির কবরটিই বখতিয়ার খিলজির এবং এখনো টিকে থাকা কবরটি বখতিয়ারের সহচর পীর বাহাউদ্দিনের। অবশ্য সমাধিসৌধের সামনে টানানো বতর্মান নামফলকে স্যার হামিল্টনের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং টিকে থাকা সৌধটিকেই বখতিয়ারের বলে দাবি করা হয়েছে।
বর্তমানে কালের নিয়মে বখতিয়ার খিলজির সমাধি অবহেলার পাত্র হলেও স্থানীয় সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘দেবতুল্য’। কথিত আছে বখতিয়ার খিলজি মাটিতে শুয়ে আছেন বলে পীরপালের মানুষরা খাট বা চৌকিতে ঘুমায় না। তারা অনেকাংশে শত শত বছর ধরে মাটিতেই ঘুমিয়ে আসছে।