সালটা ১৯৯০ ডিসেম্বর মাস
এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল। তখন শুক্রবারেও পরীক্ষা হচ্চিল।দুইটা কি তিনটা পরীক্ষা শেষ হইছে। প্রতিদিনের মতো পরীক্ষা শেষ করে আলোর মেলা মাঠে খেলতে যাই আমরা কয়েকজন বন্ধু। নূরের বাসা একটু দূর হলেও সে প্রায় সময়ই আমাদের সাথে খেলতে আসত। আরো থাকত বাবু, সোহাগ, অমি, সজীব, শাহীন ও অন্যান্যরা। বরাবরই বাসা থেকে পরীক্ষার পরে বের হতে নিষেধ করত। কিন্তু কে শুনে কার কথা? বাবুর কাছে পাখি শিকার করার জন্য একটা এয়ারগান ছিল।উলেখ্য বাবুর বাবা ছিলো তখন কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার।বাবু এই এয়ারগান নিয়ে সবসময় ভাব ধরত। আমরা তার সাথে যাইতাম আর পাখি মারতে পারলে পাখিটা ব্যাগের ভিতর রাখতাম।
ঐদিন যথারীতি বাবু এয়ারগান নিয়ে বের হইছে। আমরা সবাই নিয়ত করছি বাবুর সাথে আজকে যাব না। সে আমাদের বন্দুক দেয় না, শুধু পিছনে পিছনে ঘুরায়। আমরা না যাওয়াতে সে আমাদের সাথে ফাজলামি শুরু করে। সে আমাদের কানের কাছে এয়ারগান এনে ট্রিগার টিপ মারে। এতে বিকট শব্দ হয়। এভাবেই সে আমাদের সাথে দুষ্টুমি করতে থাকে। এয়ারগানের ভিতর গুলি না ভরে ট্রিগার টেনে টিপ দিলে বিকট শব্দ হত। এতেই সে খুব মজা পাচ্ছিল।
আমরা সবাই দুই আঙুল দুই কানে ধরে আছি। বাবু আমাদের কানের কাছে আঙুলের উপর বন্দুকের নল ধরে গুলি করত আমাদের দৌড়াতে দৌড়াতে। এরকম করতে করতে বাবু আমার কানের কাছে আঙুলের উপর বন্দুকের নল রেখে গুলি করল। ভিতরে যে গুলি ছিল আমরা কেউই জানতাম না। বাবু জানত কি না এটা আমি এখনও জানি না। গুলি করার সাথে সাথে আমি মাটিতে বসে পড়লাম। আমার সারা হাত রক্তে মাখামাখি। রক্ত দেখে বাবু ভো দৌড়। গুলি আমার বা আঙুল ছিদ্র করে কানে বিঁধেছিল। কে যেন গুলি টান দিয়ে বের করল। সবাই বলতে লাগল বাবু পিপলুরে গুলি মারছে। আমি বসে আছি আর চিন্তা করছি আজকে বাসায় গেলে খবর আছে, কালকে কিভাবে পরীক্ষা দিব ইত্যাদি।
তারপর খবর পেয়ে আমার বাসার লোক ও বাবুর বাসার লোক আসল। বাবুর কোন পাত্তা নাই। আমার আঙুল কাপড় দিয়ে বেঁধে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি প্রথম ভাবছিলাম আঙুল কেটে গুলি বের করা হবে। কিন্তু ডাক্তার বলল, গুলি আগেই বের হয়ে গেছে। আমি তখনও জানতাম না আমার কানের ভিতর থেকে গুলি বের করা হইছে।
আমি তখনও ভয়ে আছি আজ বাসায় গেলে জানি কি হয়? যে চিন্তা সেই কাজ। হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে বাসায় গেলাম অমনিই আমার বড় বোন ধুম বকা! মারতেও আসছে। কিন্তু অন্য প্রতিবেশীরা বলে কয়ে মাইর এর হাত থেকে রক্ষা পাই। কোনরকম পড়াশোনা করে পরদিন পরীক্ষা দিতে যাই। এরপর পরীক্ষা চলাকালীন বাসা থেকে আর বের হতে পারি নাই। বাসা থেকে বের না হওয়ার দুঃখে নিয়ত করছিলাম, টাকা জমিয়ে বন্দুক কিনে বাবুকে একটা গুলি করব। তা আর হলো না। বাবুর সাথে আমি এরপর খুব একটা মিশতাম না। তারপর বাবুরা বদলী হয়ে চলে যায়। আমার সাথে আর কোনদিন দেখা হয় নাই।
৩০বছর আগের সেই দুষ্ট বাবু আজ কোথায় কেমন আছে,খুব জানতে ইচ্ছে করে।বাবুর ও কি আমাদের কথা মনে পড়ে ?