বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা: শেষ পর্যন্ত কি পর্বতের মুষিক প্রসবই হল? বাংলার রাজনৈতিক মহলের সকলেরই দৃষ্টি ছিল বৃহস্পতিবারে পূর্ব মেদিনীপুরে রামনগরের ‘মেগা শো’র দিকে। সেই ‘মেগা শো’য়ে জনসমাগমও ভালোই হয়েছে। কিন্তু সেই ‘মেগা শো’য়ে কোনও বোমাই ফাটালেন না শুভেন্দু অধিকারী। বরং পুরোদস্তুর ধোঁয়াশা জিইয়ে রাখলেন সেই ‘অরাজনৈতিক’ সমাবেশে। বললেন, ‘আমি এখনও দলের প্রাথমিক সদস্য। রাজ্য মন্ত্রিসভারও সদস্য। দলের নিয়ন্ত্রকরা আমাকে তাড়াননি। আমিও দল ছাড়িনি। মুখ্যমন্ত্রী আমায় মন্ত্রিসভা থেকে তাড়িয়ে দেননি। আমিও ছাড়িনি। যে ক’টি পদে আছি, সব কটিতেই আমি নির্বাচিত। মন্ত্রিসভায় থেকে দলের বিরুদ্ধে আমি কথা বলব না। আমরা বিদ্যাসাগরের দেশের মানুষ। আমরা এত অনৈতিক কাজ করি না।’ যদিও দলের বা মুখ্যমন্ত্রীর নাম একবারের জন্যেও তিনি এদিন উচ্চারণ করেননি।
তবে জল্পনার সমাপ্তিও এদিন হতে দেননি তিনি। এখনও যে পুরোপুরি নিজের অবস্থান থেকে পুরোপুরি সরে আসেননি, তা বুঝিয়ে দিতে ইঙ্গিতবহ ভাবে রামনগরের এই সমবায় সমাবেশে বলেন, ‘একদিন–দুদিনের লোক নই, বসন্তের কোকিল নই আমি। সবার সঙ্গে আত্মিক পরিচয় রয়েছে। আর শুধু ভোট চাই ভোট দাও, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও তো বলি না। লকডাউনে, কোভিডে, আমফানে —সবসময়ই আমি মানুষের পাশে থাকি। নিজেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছি।’ মানুষও তাঁকে পরপর নির্বাচনে জয়ী করেছেন। এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘ওটা পেশার মতো করিনি। নেশার মতো করেছি।’ পাশাপাশি নিজেরও যে ক্যারিশমা আছে, সেই বার্তা নিয়ে নাম না নিয়ে দলকেও কিছুটা সতর্ক করে দিয়েছেন এদিন। বলেছেন, ‘অরাজনৈতিক এই সমবায়ের মঞ্চে ২০ হাজার মানুষের সমাগম। এটা একদিনে হয় না, দশকেরও বেশি সময় ধরে যুক্ত থাকতে হয়। গোটা দেশেও এমন নজির আর নেই।’
তবে যেহেতু তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর আলোচনা চলছে, তাই দলের বিরুদ্ধে এদিন সে ভাবে তোপও দাগেননি। কিছুটা যেন সাফাই দিয়েই বলেছেন, ‘দল করতে গেলে বিভিন্ন কারণে বিভেদ আসে। বিভেদ থেকে বিচ্ছেদও আসে। কিন্তু যতক্ষণ মন্ত্রিসভায় আছি বা দলে আছি, ততক্ষণ কোনও রাজনৈতিক কথা বলা যায় না। আমি সেটা বলতে পারি না।’ নন্দীগ্রাম দিবসে তাঁর সভার পালটায় তৃণমূলের সভা এবং সেখান থেকে তাঁর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে রীতিমতো শোরগোল পড়ে হয়। প্রশ্ন ওঠে, তিনি কি নতুনভাবে রাজনৈতিক কেরিয়ার শুরু করতে চলেছেন? বিজেপিতেই কি যোগ দিয়ে সেই কেরিয়ার শুরু হবে, নাকি নতুন কোনও দল তৈরি করতে চলেছেন? বলা বাহুল্য, সেই প্রশ্নের জবাব এদিনও শুভেন্দুর কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।
এর কারণও অবশ্য আছে। শুভেন্দু–বিতর্ক মেটাতে তৃণমূলের তরফে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের কয়েকজন সাংসদকে দায়িত্ব দিয়েছেন। সেই সূত্রে শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে কথা বলেছেন বলে জানিয়েছেন সাংসদ সৌগত রায়। বৃহস্পতিবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘শুভেন্দু দল ছাড়েননি। এখনও অন্য কোনও দলে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু ভাবেনওনি। তিনি রাজ্য মন্ত্রিসভার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও। আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁর কিছু বক্তব্য ছিল। সব বলেছেন। আমি শুনেছি। তাঁর সব কথা আমি দলনেত্রীকে জানিয়েছি। সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার, তিনিই নেবেন।’ সোমবার ভাইফোঁটার দিন শুভেন্দুর সঙ্গে তাঁর কথা হয় বলে তিনি জানান। সাংসদ বলেন, ‘সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও আমার এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে ফের শুভেন্দুর সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তার দিনক্ষণ এখনও ঠিক হয়নি।’ সৌগত জানিয়েছেন, শুভেন্দুর সঙ্গে আলোচনার আগে ফের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলবেন। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই শুভেন্দুর ‘বক্তব্য’ নিয়ে হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
সূত্রের খবর, সৌগত রায়ের সঙ্গে আলোচনায় দলে নিজের অবস্থান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শুভেন্দু। সম্প্রতি দলের সাংগঠনিক রদবদলে জেলা পর্যবেক্ষক পদটি তুলে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে শুভেন্দুর গতিবিধি মেদিনীপুরেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তার আগে মুর্শিদাবাদ জেলার পর্যবেক্ষক ছিলেন তিনি। সেই পদ ফেরানো–সহ সমস্ত সাংগঠনিক পদ তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি দলে তাঁর গুরুত্ব বাড়ানোরও দাবি জানিয়েছেন শুভেন্দু। তাঁর অনুগামী নেতাদেরও দলের বিভিন্ন দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁদেরও ফের একই দায়িত্ব দিতে হবে। যদিও শুভেন্দুর বিরুদ্ধ শিবিরে থাকা রামনগরের বিধায়ক অখিল গিরি কোনও রকম গুরুত্ব দিতে রাজি নন তাঁকে। তিনি বলেন, ‘দলের কাছে তাঁর গুরুত্ব কতটুকু? কী করেছেন তিনি দলের জন্য? তাই তিনি দলে থাকলেও লাভ কিছুই নেই, আবার দল ছেড়ে গেলেও ক্ষতি কিছুই হবে না।’ দলের শীর্ষনেতারা যে ভাবে শুভেন্দুর সঙ্গে কথা বলছেন, তা নিয়ে অবশ্য কোনও মন্তব্য করেননি তিনি। তবে দলের এই উদ্যোগে তিনি যে খুব বেশি খুশি নন, তা ঘনিষ্ঠ মহলে গোপন রাখেননি।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, তৃণমূলের তরফে ইতিবাচক বার্তা পাওয়ার পরই কি নমনীয় অবস্থান নিলেন শুভেন্দু? বিষয়টি নিয়ে এদিন থেকে চর্চা শুরু হয়েছে রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে। উল্লেখ্য, কয়েকদিন আগে শুভেন্দু নিজেই বলেছিলেন, ১৯ নভেম্বর রামনগরে ‘মেগা শো’ হবে। তাই বৃহস্পতিবার রামনগরে শুভেন্দুর সভা ঘিরে সকলেরই আগ্রহ ছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন, এই সভায় বুঝি নিজের চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্তের কথা তিনি জানাবেন। কিন্তু এদিন তাঁর গলায় তেমন কোনও কড়া সিদ্ধান্তের কথা শোনা যায়নি। এদিন রামনগরের সমাবেশে শুভেন্দু বলেন, ‘অনেকে এই মঞ্চে আমি রাজনৈতিক কথা বলব বলে মনে করেছিলেন। তাঁদের ছড়ানো খবরের দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। আমি নেব না। সমবায় তথা অরাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমি রাজনীতির কথা বলব না। শুভেন্দু অধিকারী স্থান, কাল, পাত্র জানেন।’
এদিকে, পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগরে সমাবেশের আগেই তৃণমূলের মুখপাত্র তথা সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় জানিয়ে দেন, রাজ্যের মন্ত্রিসভা তো বটেই, দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক কমিটিতেও রয়েছেন শুভেন্দু। শুভেন্দু অধিকারী দলের বড় নেতা। সূত্রের খবর, শুভেন্দু নিজেও দলকে জানিয়েছেন, এখনও তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি। তার পরেই সুখেন্দুশেখর রায়ের এই মন্তব্যকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। শুভেন্দুর সভার আগে এ ভাবে তাঁর উদ্দেশ্যে দলের তরফে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয় বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। পাশাপাশি কোচবিহারের প্রবীণ বিধায়ক মিহির গোস্বামী সম্পর্কে সুখেন্দুবাবু জানান, মিহির যেহেতু নিজের অবস্থান নিজেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তাই তাঁর সম্পর্কে তিনি কিছু বলবেন না।
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মধ্যে অনেকের ধারণা, যেহেতু দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে এবং ইতিবাচক বার্তা দেওয়া হচ্ছে, তাই শুভেন্দু আলোচনার পথ খোলা রাখতে চাইছেন। সেইজন্য রামনগরের সমাবেশে তিনি কড়া কোনও সিদ্ধান্তের কথা জানাননি। অপরদিকে, রাজনীতি পর্যবেক্ষকদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করছেন, দলের বিরুদ্ধে যে ভাবে এতদূর এগিয়ে গিয়েছেন শুভেন্দু, তাতে তাঁর পিছিয়ে আসার পথ অনেকটাই জটিল হয়ে গিয়েছে। তাই তিনি যদি এখন দলে থেকে যান, পরবর্তী কালে দলে তাঁর অবস্থানে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।