শেয়ারবাজারের জন্য কেলেঙ্কারি এক অধ্যায় ২০১০ সাল। কারসাজি চক্রের খপ্পরে পড়ে অসংখ্য বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়। ১১ বছর কেটে গেল শেয়ারবাজারের সেই ক্ষত আজও শুকায়নি। শেয়ারবাজারের সেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ খতিয়ে দেখতে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১১ সালে তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে জমা দেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি (বর্তমানে বিএসইসি) পুনর্গঠনসহ কমিটি সরকারের কাছে ২৫টি সুপারিশ করে।
এই সুপারিশের প্রেক্ষিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়। শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ নীতিতে পরিবর্তন আনা হয়। বন্ধ করা হয় মার্চেন্ট ব্যাংকের অমনিবাস হিসাব। প্লেসমেন্ট শেয়ারের নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হয়ে। স্টক এক্সচেঞ্জ ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন বা মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথক করা হয়েছে। প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ধরনের আরও কিছু যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে শেয়ারবাজারে। প্রতিবেদনের নবম অধ্যায়জুড়ে থাকা সেই ২৫ দফা সুপারিশমালা এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো।
১. সীমিত সময়ের মধ্যে সর্বাধিক প্রচেষ্টায় তদন্ত কমিটি যেসব তথ্য-উপাত্ত, মতামত ও সুপারিশ সংগ্রহ করেছে, সেগুলো তদন্ত প্রতিবেদনের দ্বিতীয় থেকে অষ্টম অধ্যায়সমূহে বিষয়ভিত্তিকভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও পূর্ববর্তী অধ্যায়সমূহ বর্ণিত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সুপারিশমালা প্রণয়ন করে। সরকারের বিবেচনার্থে এই অধ্যায়ে প্রণীত সুপারিশসমূহ উপস্থাপন করা হলো। অনুধাবনের সুবিধার্থে প্রতিটি সুপারিশের পূর্বে সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা হয়েছে।
২. ব্যর্থতার মূল দায়-দায়িত্ব : প্রেক্ষাপট ২০০৯-১০ অর্থবছরে পুঁজিবাজার উত্থান-পতন উল্লম্ফন-ধসের কারণ বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়েছে যে, (ক) প্রাইমারি ইস্যু কর্মকাণ্ডে ডাইরেক্ট লিস্টিং, কোম্পানির সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন, শেয়ারের উচ্চমূল্য নির্ধারণ, বুক-বিল্ডিং প্রক্রিয়ার অপপ্রয়োগ, ফেইসভ্যালু বা কম মূল্যে বিশেষ ব্যক্তি/সংস্থাকে প্লেসমেন্ট প্রদান প্রভৃতি বিষয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইস্যুয়ার, ইস্যু-ম্যানেজার, ভ্যালুয়ার, অডিটর, ডিলার-ব্রোকারসহ অনেকেই সম্পৃক্ত। (খ) সেকেন্ডারি মার্কেটে সার্কুলার ট্রেডিং, ব্লক ট্রেডিং, অস্বাভাবিক লেনদেন প্রভৃতি বিষয়ে ডিলার-ব্রোকার ইনভেস্টরসহ সীমিতসংখ্যক ব্যক্তি/সংস্থা জড়িত। (গ) রাইট শেয়ার, প্রেফারেন্স শেয়ার, আইপিও-রিপিট, আনরিয়েলাইজড প্রফিটের বিপরীতে স্টক শেয়ার ইস্যু প্রভৃতি বিষয়ে অনিয়ম বা অসঙ্গতি বিদ্যমান।
(ঘ) এছাড়া ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কার্যক্রমের বিভিন্ন বিষয়ে পর্যালোচনাকালে অনেক অসংগতি, অনৈতিকতাকে বৈধতাদান এবং দায়িত্বে অবহেলার উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি মনে করে, এসইসি ডিউ ডিলিজেন্স প্রয়োগ করলে, পেশাগতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনা করলে এবং অসঙ্গতি-অস্বাভাবিকতাকে বৈধতা প্রদান না করলে এবারের পুঁজিবাজারে ধস হতো না। অতএব ব্যর্থতার মূল দায়িত্ব এসইসিকেই বহন করতে হবে।
সুপারিশ : অনৈতিকতাকে বৈধতা প্রদান প্রক্রিয়ায় মূল ঘটকের ভূমিকায় ছিলেন এসইসি মেম্বার জনাব মনসুর আলম। চেয়ারম্যানের আনুকূল্য ও সম্মতি ছাড়া যেহেতু কমিশনের অনুমোদনপ্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয় না, অতএব চেয়ারম্যান এবং মেম্বার জনাব মনসুর আলম উভয়ই দায়ী। শীর্ষ দায়ী কর্মকর্তাদ্বয়কে সক্রিয় সহায়তা প্রদান করে অন্যায় করেছেন দু’জন নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কবির ভূইয়া এবং তারিকুজ্জামান। এসইসির অনেক কর্মকর্তা সুবিধা গ্রহণ ও অনৈতিক কাজে সহায়তা করেছেন এই চারজন প্রধান নির্বাহীর ছত্রছায়ায়। অতএব চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খন্দকার, মেম্বার মনসুর আলম, নির্বাহী পরিচালকদ্বয় আনোয়ারুল কবির ভূঁইয়া এবং তারিকুজ্জামানকে এসইসি থেকে অপসারণ প্রয়োজন।
৩. এসইসি পুনর্গঠন প্রেক্ষাপট : (ক) পুঁজিবাজার বিনষ্টকরণে এসইসির সাম্প্রতিক ভূমিকা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হয়েও মার্কেট-প্লেয়ারদের পরামর্শে পরিচালিত হওয়া ও যোগসাজশে অনৈতিক কর্মে বৈধতা প্রদান, বাজার নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা ও শৈথিল্য প্রদর্শন প্রভৃতি কারণে এসইসির ভাবমূর্তি অতিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কমিশনের বৈধ নির্দেশ না মানার সাহস জন্মেছে।
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, ২১ মার্চ ২০১১ তারিখে এসইসির অনুমতিক্রমে প্রাইম ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডে তদন্ত কমিটি কাগজপত্র পরীক্ষার জন্য কর্মকর্তা পাঠালে, কোম্পানির শেখ মুর্তজা আহমেদ তাদের কার্যালয়ে প্রবেশ করতে দেননি। এসইসি পরদিন ২২/৩/১১ তারিখে পুনরায় ফোন করে লোক পাঠালে শেখ মুর্তজা পুনরায় বাধা দেন। আরও দু’একটি ঘটনা কমিটি প্রত্যক্ষ করেছে। ক্ষয়িষ্ণু ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে এসইসির বড় রকম পুনর্গঠন প্রয়োজন।
(খ) পুঁজিবাজার বেশ সম্প্রসারিত হয়েছে। বাজার পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের মতো লোকবল কমিশনের নেই। তদুপরি কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে পড়ায় অচলাবস্থা বিরাজ করছে। (গ) এসইসিতে কোয়ালিফাইড অ্যাকাউন্টন্যান্ট, ফিন্যান্সিয়াল এনালিস্ট ও বিশেষজ্ঞ না থাকায়, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা পেশাগতভাবে সম্পন্ন হয় না। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া জোরদার থাকে। (ঘ) কর্মকর্তাদের বেতনকাঠামো মেধা আকর্ষণ করে না, দুর্নীতির পথ প্রশস্ত করে।
সুপারিশ : দায়ী বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভাবমূর্তি সর্বনিম্নে বিধায় তাদের দ্বারা সংস্থা পুনর্গঠন সম্ভব নয়। দায়ী চারজনকে অব্যাহতিদান করে সৎ, দক্ষ, অতীতে সফল এবং গ্রহণযোগ্য একজন চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ পদ পূরণের পরই পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
(খ) এবার জরুরি ভিত্তিতে নিয়োগদানের পর, ভবিষ্যতে একটি উচ্চ পর্যায়ের সার্চ কমিটির দ্বারা বাছাইকৃত একটি প্যানেল থেকে সরকার চেয়ারম্যান ও মেম্বার নিয়োগ দেবে। সার্চ কমিটি প্রতি পদের বিপরীতে তিনজনের প্যানেল প্রস্তুত করবে। আবেদন করেননি- এমন যোগ্য ব্যক্তিকে খুঁজে নিয়ে (সম্মতি থাকলে) তালিকাভুক্ত করার ক্ষমতা সার্চ কমিটির থাকা উচিত। (গ) কমিশন চেয়ারম্যানসহ সাত সদস্যবিশিষ্ট হতে পারে। তারা হতে পারেন চার্টার্ড/কস্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আইনবিশেষজ্ঞ, ব্যাংকার, অ্যাকাউন্টিং/ফিনান্সের ভার্সিটি অধ্যাপক এবং প্রাজ্ঞ ও সফল ব্যক্তিত্ব (প্রশাসন/ব্যবস্থাপক/সাধারণ)।
(ঘ) নতুন চেয়ারম্যান-মেম্বার নিয়োগের পর নবগঠিত কমিশন একটি ‘এসইসি রিস্ট্রাস্টারিং প্লান’ প্রস্তুত করে সরকারের অনুমোদনের জন্য পেশ করতে পারে। পুনর্গঠন পরিকল্পনায় একটি শক্তিশালী ইন্সপেকশন বিভাগ এবং একটি কম্পানি হিসাব যাচাই বিভাগ অবশ্যই থাকতে হবে। এ ছাড়াও ‘পুঁজিবাজারবিধি পরিচালন’ বিভাগও থাকা উচিত। ইন্সপেকশন বিভাগ নিয়মিত ইন্সপেকশন করবে (সকল ডিলার-ব্রোকার হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংকার, অ্যাসেস্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ইত্যাদি)। বিধি পরিচালন বিভাগ বিচ্যুতির জন্য শাস্তি প্রয়োগ করবে। এটি আইন বিভাগ নয় বরং আইনের প্রয়োগ হবে। (ঙ) অর্গানাইজেশন স্টাডির ভিত্তিতে পুনর্গঠনের অন্যান্য উপাত্ত বের হবে। (চ) প্রতিটি ডেস্কের ‘জব স্পেসিফিকেশন’ ও ‘জব ডেসক্রিপশন’ তৈরি করতে হবে। (ছ) একটি উপযুক্ত বেতন কাঠামো অ্যাজেন্ডায় থাকা উচিত।
৪. স্টক এক্সচেঞ্জ ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন প্রেক্ষাপট : (ক) বাংলাদেশের দুটি স্টক এক্সচেঞ্জ। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ। দুটি স্টক এক্সচেঞ্জ পুঁজিবাজারের প্রাথমিক নিয়ন্ত্রক, যদিও প্রধান নিয়ন্ত্রক এসইসি। সেই বিচারে স্টক এক্সচেঞ্জ এর একটি নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাঠামো থাকা উচিত। (খ) দুটি স্টক এক্সচেঞ্জর পরিচালক পরিষদ ২৫ সদস্যবিশিষ্ট-১২ জন ডিলার-ব্রোকার সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত, ১২ জন মনোনীত, বাকিজন হলেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। বাস্তবে নির্বাচিত পরিচালকরাই প্রশাসন চালিয়ে থাকেন, যেহেতু মনোনীত সদস্যদের উৎসাহ ও সম্পৃক্ততা কম দেখা যায়। ফলে যাঁরা পুঁজিবাজারের প্লেয়ার তাঁরাই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়। স্বার্থের সংঘাত সংস্থার নিয়ন্ত্রক ভূমিকাকে ম্লান করে দেয়। (গ) এ পরিপ্রেক্ষিতে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন ধারণাটি এসেছে সঙ্গত কারণে।
ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশনের মর্মার্থ হলো, নিয়ন্ত্রিতের কার্যাবলী নিয়ন্ত্রকের কার্যাবলী থেকে পৃথক করে, প্লেয়ারের ওপর নিরপেক্ষভাবে ‘রুলস অব দি গেম’ প্রয়োগের জন্য নিয়ন্ত্রণ-প্রশাসনকে ক্ষমতা প্রদান এবং প্লেয়ারদের প্রভাববলয় থেকে বাইরে সরিয়ে রাখা। (ঘ) ভারতের মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জ সরকারি চাপে ডিমিউচ্যুয়ালাইজ করা হয়েছে। পাকিস্তানে প্রক্রিয়াধীন। (ঙ) তদন্ত কমিটি পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সংস্থা/ব্যক্তি এবং সিভিল সমাজের সাথে যে ব্যাপক আলোচনা করেছে, তাতে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন করার পক্ষে ব্যাপক দাবি ও সমর্থন পাওয়া গেছে, যদিও প্লেয়ারদের অনেকের অবস্থান দুর্বল। (চ) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ স্বপ্রণোদিত হয়ে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশনের বিষয়টি পরীক্ষার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে। (ছ) ডিএসইর মূল মালিক সদস্যরা, ক্ষমতাও তাদের।
তারা স্বেচ্ছায় ক্ষমতা তুলে দেবে প্রশাসনের হাতে, এমনটা স্বাভাবিক চিন্তা নয়। এ কারণে ভারত সরকার ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ গঠনের মাধ্যমে মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জ ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। ডিএসইর গঠিত কমিটি কি ফল দেবে, আদৌ দেবে কি দেবে না, তা সময়ই বলে দেবে। সুপারিশ : (ক) ডিএসই একটি ডিমিউচুয়্যালাইজেশন কমিটি গঠন করলেও কমিটিকে কোনো সময়সীমা প্রদান করেনি (এটাই স্বাভাবিক)। সরকার ডিএসইকে পরামর্শ দিতে পারে কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টের জন্য ছয় মাস সময়সীমা নির্ধারণ করে দিতে। (খ) ছয় মাস পর অগ্রগতি পর্যালোচনা করে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
(গ) কমিটির সুপারিশ এবং ডিএসইর অবস্থান সন্তোষজনক না হলে, সরকার নিজে ‘ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন পরিকল্পনা’ তৈরির জন্য বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্য নিতে পারে। পরিকল্পনা সরকার কর্তৃক গৃহীত হওয়ার পর বাস্তবায়নের জন্য সরকার (এসইসি র মাধ্যমে) ডিএসইতে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারে। (ঘ) ইমপ্লিমেন্টেশন শিডিউল অনুযায়ী ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন বাস্তবায়নের পর সংশোধিত ডিএসই মেমোরেন্ডাম অনুযায়ী নির্বাচন দিয়ে পুনর্গঠন সম্পন্ন করে প্রশাসক বিদায় নেবেন। (ঙ) বিষয়টি স্বার্থ-সংঘাতবিষয়ক এবং জটিলতামিশ্রিত বিধায় সরকার যথাসময়ে ‘ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন ইমপ্লিমেন্টেশন মনিটরিং সেল’ গঠন করতে পারে। সেলটি এসইসিতে কাজ করতে পারে।
৫. স্টক এক্সচেঞ্জ ও এসইসি কর্মসমন্বয় প্রেক্ষাপট : (ক) এসইসি এবং স্টক এক্সচেঞ্জদ্বয় উভয়ই নিয়ন্ত্রণ-কার্যাবলী পরিচালনা করে। ডিএসই/এসইসি প্রাইমারি রেগুলেটর এবং এসইসি প্রধান রেগুলেটর। এ কারণে উভয়ের কর্মপরিধিতে ওভারল্যাপ রয়েছে, যেহেতু এ পর্যন্ত র্যাশনালাইজেশন করা হয়নি। (খ) তদন্ত কমিটি লক্ষ্য করেছে, ডিএসই এবং এসইসি উভয় সংস্থাতেই সার্ভিলেন্স বিভাগ আছে একই কাজের জন্য। ডিএসই সার্ভিলেন্স বিভাগ কিছু কাজ করছে। এসইসি সার্ভিলেন্স দুর্বল। উভয়ের মধ্যে সমন্বয় নাই। (গ) তদন্ত কমিটি আরো লক্ষ্য করেছে, ডিএসই এবং সিএসইর লিস্টিং কমিটি প্রাইমারি রেগুলেটর হিসেবে কম্পানির তালিকাভুক্তির আবেদন যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অনেকগুলো কম্পানির ক্ষেত্রে বিরূপ মন্তব্য করেছে, অথচ এসইসি সেসব উপেক্ষা করে স্টক এক্সচেঞ্জদ্বয়কে লিস্টিংয়ে বাধ্য করেছে, কোনো যুক্তি না দিয়েই।
সুপারিশ : (ক) একটি স্টাডি টিম গঠন করে স্টক এক্সচেঞ্জ এবং এসইসির ওভারল্যাপ কর্ম ও গ্রে-এরিয়াগুলো চিহ্নিত করে কর্মতালিকা সুনির্দিষ্ট করা উচিত। (খ) তদন্ত কমিটির মতে, সার্বক্ষণিক সার্ভিলেন্সের দায়িত্ব স্টক এঙ্চেঞ্জের কাছে ন্যস্ত থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে ডিএসই/সিএসইর সার্ভিলেন্স বিভাগ আরো শক্তিশালী করতে হবে। কর্মী সংখ্যা বাড়াতে হবে, পদ্ধতি আধুনিকীকরণ করতে হবে। বাজারের যেকোনো অস্বাভাবিক লেনদেন তাৎক্ষণিকভাবে চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সক্ষমতা প্রদান করতে হবে। (গ) এসইসির সার্ভিলেন্স বিভাগকে পুনর্গঠন করে ‘ইন্সপেকশন বিভাগে’ রূপান্তর করতে হবে। বাজারের সকল সংস্থায় নিয়মিত ইন্সপেকশন পদ্ধতি প্রচলন করতে হবে। (ঘ) কম্পানি লিস্টিং স্টক এক্সচেঞ্জ এর কাজ। তাদের লিস্টিং প্রতিবেদন নিয়ে এসইসি প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে, কিন্তু উপেক্ষা করতে পারবে না।
৬. পুঁজিবাজারে ব্যাংকের অর্থায়ন প্রেক্ষাপট : (ক) পুঁজিবাজার এবং অর্থবাজারকে পৃথক রাখা বিশ্বস্বীকৃত রীতি। ব্যাসেলের পরবর্তী নীতিমালায় ‘এ্যবসলুট সেপারেশন’-এর কথা থাকছে। কারণ হলো, পুঁজিবাজার নিজস্ব পুঁজি বিনিয়োগের জন্য। আমানতকারীর জমা অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের অধিকার গ্রাহক ব্যাংককে দেয়নি। প্রয়োজনে গ্রাহক নিজের টাকা নিজেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করবেন। কিন্তু গ্রাহকের টাকা বিনা অনুমতিতে ব্যাংক কর্তৃক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ অনৈতিক।
(খ) এ কারণে ভারতীয় ব্যাংকিং আইনে এবং পাকিস্তানের ব্যাংকিং আইনে কোনো ব্যাংক কর্তৃক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ব্যাংকের ইক্যুইটির (অর্থাৎ মালিকের নিজস্ব পুঁজি) সঙ্গে। আমানত বা ব্যাংকের দায়ের সঙ্গে নয়। অথচ বাংলাদেশের ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের ২৬(২) ধারায় ব্যাংকগুলোকে তার দায় অর্থাৎ মোট আমানতের ১০% পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে। (গ) এ কারণে ব্যাংকের বড় অঙ্কের ঋণ পুঁজিবাজারে প্রবেশ করেছে, তারল্য বাড়িয়েছে, শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। এমনকি অর্থ বাজারেও সংকট সৃষ্টি করেছে। (ঘ) তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণ মতে, এ ব্যবস্থা সংশোধন করা না হলে, ভবিষ্যতে পুঁজি ও অর্থ উভয় বাজারে গুরুতর সংকট সৃষ্টি হবে এবং দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হতে পারে।
সুপারিশ : (ক) ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কাসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর অনুকরণে এবং ব্যাসল নীতিমালার বাস্তবায়ন ঘটিয়ে ব্যাংক কম্পানি আইনের ২৬ (২) ধারা অবিলম্বে সংশোধন করে ব্যাংকের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকে ব্যাংকের মূলধন (টিয়ার-১)-এর অংশ হিসেবে ধার্য করা হোক। আমানতের সঙ্গে সংযোগ রহিত করা হোক। (খ) যেসব ব্যাংক ২০০৯ ও ২০১০ সালে আইন ভেঙে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে এবং উল্লম্ফনে সাহায্য করেছে, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। (গ) পুঁজিবাজারে ব্যাংকের অবৈধ (কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত) পদচারণা বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর তদারকিতে থাকা উচিত।
৭. প্রাক-আইপিও এবং আইপও প্রক্রিয়া প্রেক্ষাপট : (ক) শেয়ার ডি-ম্যাটকরণ ও স্টক এক্সচেঞ্জ যান্ত্রিকীকরণে পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা অনেকটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাজারে প্রবেশের পূর্বের স্তরগুলো এখনো অস্বচ্ছ। স্টক এক্সচেঞ্জর লিস্টিং সুপারিশ না থাকলেও আইপিওর জন্য গ্রহণ করা হয়। সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন অস্বাভাবিক হলেও এসইসি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই গ্রহণ করে। অস্বাভাবিক ইন্ডিকেটিভ মূল্য নির্ধারণে যৌক্তিকতা থাকে না। (খ) এসইসি যেন শুধু অনুমোদনের জন্যই, কোন পেশাগত ডিউ ডিলিজেন্সের লক্ষণ নেই। মূলত এ কারণেই প্রাক-আইপিও/আইপিও পর্যায়ে প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় এবং ‘প্লেসমেন্ট বাণিজ্যে কার্ব মার্কেট’ সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় ব্যাপক মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। সে কারণে আসল পুঁজিবাজারের অর্থ ঘাটতি ঘটায় এবারের পুঁজিবাজার ধস ঘটেছে।
সুপারিশ : (ক) প্রাক-আইপিও/আইপিও প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে নিয়মাচার তৈরি ও তা প্রতিপালনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এসইসি নিয়মাচার তৈরি করতে পারে। তবে নিয়মাচার প্রকাশিত হতে হবে এবং পরিপালন কর্মও স্বচ্ছ হতে হবে।
৮. প্লেসমেন্ট ‘বাণিজ্য’/কার্ব মার্কেট প্রেক্ষাপট : (ক) তদন্ত কমিটির জনমত সংগ্রহে বেরিয়ে এসেছে যে, ‘প্লেসমেন্ট’ এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইপিও মূল্যের চাইতে কম মূল্যে প্লেসমেন্টের অনুমতি থাকছে। ফলে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ‘প্লেসমেন্ট’ দিয়ে প্রভাবিত করার প্রয়াস লক্ষণীয়। (খ) এসইসির কোনো প্লেসমেন্ট নিয়মাচার নাই। (গ) পাবলিক অফারের উদ্দেশ জনগণের অংশগ্রহণ। কিন্তু প্লেসমেন্টের ফলে জনগণের অংশ কমে গেছে।
(ঘ) রূপান্তরযোগ্য প্রেফারেন্স শেয়ার ২০০৯-১০ দু’বছরে আটটি কম্পানি ছেড়েছে, যার মধ্যে গড়ে ৬৯% প্লেসমেন্টে গেছে (সর্বোচ্চ ১০০% অগ্নি সিস্টেম এবং সর্বনিম্ন ৫৮% পিপলস লিজিং)। এ অবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ সংকুচিত। (ঙ) প্রাথমিক ইস্যুতে জনগণের অংশ সংকুচিত করে বড় অংশ প্লেসমেন্টে প্রদানের ফলে ‘চিটা হাতবদল’ বা প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের ঘটনা ঘটেছে। এটি কার্ব মার্কেটের সঙ্গে তুলনীয়। অস্বচ্ছতা চরম পর্যায়ে।
সুপারিশ : (ক) সুশীল সমাজ, জনপ্রতিনিধি, গবেষক, পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনার ভিত্তিতে ‘প্লেসমেন্ট নিয়মাচার’ তৈরি করতে হবে। পুনর্গঠিত এসইসি এ কাজটি করতে পারে। (খ) প্লেসমেন্ট বরাদ্দপত্র ইস্যু করতে হবে, যার কপি এসইসিকে দিতে হবে। (গ) বরাদ্দপত্র হস্তান্তরযোগ্য হবে না। বরাদ্দপত্রের বিপরীতে প্লেসমেন্ট ক্রয়ের অর্থ বিও অ্যাকাউন্টে জমা করতে হবে, যার বিপরীতে শেয়ার ইস্যু হবে। বরাদ্দপত্র ওয়ারেন্ট ধরনের হবে এবং শেয়ারে কনভার্ট হওয়ার পর প্রাইভেট প্লেসমেন্টের শেয়ার অন্তত এক বছর লক-ইন থাকবে, যেহেতু আইপিও ভ্যালুর চেয়ে কম মূল্যে দেওয়া হয়েছে। (ঘ) বিস্তারিত বিশ্লেষণের পর আরো প্রক্রিয়াযুক্ত করে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের অস্বচ্ছ কার্ব মার্কেট বন্ধ করতে হবে। (ঙ) আইপিও শেয়ারমূল্যের ২৫%-এর বেশি প্লেসমেন্ট হওয়া উচিত নয়। (চ) বর্তমানে আইপিও প্রায় ২৩ গুণ ওভারসাবসক্রাইবড হচ্ছে, এ পরিপ্রেক্ষিতে প্লেসমেন্ট নিষ্প্রয়োজন।
৯. অস্বচ্ছ অমনিবাস অ্যাকাউন্টে স্বচ্ছতা আনয়ন প্রেক্ষাপট : (ক) ষষ্ঠ অধ্যায়ে অমনিবাস অ্যাকাউন্টের আইনি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রক্রিয়াটি আইনানুগ নয় বলে প্রতীয়মান হয়। (খ) সিডিবিএলে পরিচালিত প্রতিটি অমনিবাস অ্যাকাউন্টের আড়ালে তিন হাজার থেকে ১০ হাজার পর্যন্ত গোপন হিসাব থাকে প্রতিটি মার্চেন্ট ব্যাংকারের খাতায়। অর্থাৎ ৩-১০ হাজার অ্যাকাউন্টের মোট অঙ্ক বিও হিসাবে যাচ্ছে মার্চেন্ট ব্যাংকারের নামে। ইনডিভিজ্যুয়াল অ্যাকাউন্ট অপ্রদর্শিত থাকছে। তদন্ত কমিটির তদন্তে প্রতীয়মান হয়েছে, এসব অ্যাকাউন্টেই অনৈতিক লেনদেন অধিক।
(গ) শেয়ার লেনদেন যেহেতু বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে হওয়া বাধ্যতামূলক, অতএব মার্চেন্ট ব্যাংকার কর্তৃক রক্ষিত হিসাবে শেয়ার লেনদেন দৃষ্টির বাইরে থাকে। সুপারিশ : (ক) অমনিবাস অ্যাকাউন্টের আড়ালে থাকা সব ইনডিভিজ্যুয়াল হিসাবের জন্য পৃথক পৃথক বিও অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শেয়ার লেনদেন হবে। (খ) মার্চেন্ট ব্যাংকার তাদের হিসাবের সুবিধার জন্য শ্যাডো অ্যাকাউন্ট রাখতে পারে। (গ) মার্চেন্ট ব্যাংকার ক্লায়েন্টের শেয়ারের ওপর প্রয়োজনে জেনারেল লিয়েন রাখতে পারে, যাতে শেয়ার লেনদেনে বাধা সৃষ্টি না করা হয় এবং মার্চেন্ট ব্যাংকারের ঋণ সিকিউরড থাকে।
১০. সরকারি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শেয়ার লেনদেন প্রেক্ষাপট : (ক) সরকারি এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের মধ্যে শেয়ার লেনদেনের প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। অফিসের কাজকর্ম ফেলে কম্পিউটারে বসে শেয়ার ট্রেডিংয়ে ব্যস্ত থাকার দৃশ্য প্রতিটি অফিসেই দেখা যাচ্ছে। এতে অফিসের কাজকর্মে ক্ষতি হচ্ছে। (খ) চাকরিবিধিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাস্তবায়ন নেই। অষ্টম অধ্যায়ে তথ্যচিত্র-১ এবং ২ নমুনা প্রমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এসইসিতে অনুরূপ ঘটনা অহরহ ঘটছে বলে ব্যাপক ধারণা। ব্যাংকগুলোতে প্রবণতা প্রবল। চাকরিবিধি প্রয়োগের দৃষ্টান্ত না থাকায় বিধিভঙ্গ বাড়ছে।
(গ) মিউচ্যুয়াল ফান্ড, আইপিওসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে প্লেসমেন্ট প্রদান ঘুষ প্রদানের নতুন সংস্করণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। প্রভাবশালী কর্মকর্তাসহ অন্যদের আনুকূল্য লাভের প্রত্যাশায় এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা ‘বেনামি’তে প্লেসমেন্ট নিয়ে থাকেন বলে ব্যাপক গণধারণা রয়েছে। ‘বেনামি’ চিহ্নিত করাও কঠিন। (ঘ) সরকারি তথা প্রভাবশালী মহল সুবিধা গ্রহণের ফলে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রণযোগ্য মহলের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে এবং অকার্যকর হয়ে পড়েছে। (ঙ) অষ্টম অধ্যায়ে ৮.১০ পর্বে প্লেসমেন্ট বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে।
সুপারিশ : (ক) এসইসি, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ, সিডিবিএল, বাংলাদেশ ব্যাংক ও তফসিলি ব্যাংকে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেয়ার লেনদেন (ট্রেডিং) সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। তবে তারা শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারবেন। চাকরিবিধিতে নিষেধাজ্ঞা অন্তর্ভুক্তকরণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। কর্মকর্তারা নিজ নামে, স্ত্রী, সন্তান, ভাইবোন, পিতামাতার নামে অথবা বেনামিতে শেয়ার লেনদেন করবেন না। (খ) প্রমাণ হলে গুরুদণ্ডের বিধান থাকতে হবে।
(গ) মার্চেন্ট ব্যাংকার, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কম্পানি এবং ব্রোকার-ডিলার কম্পানির কর্মকর্তারাও নিষেধাজ্ঞা মেনে চলবেন। (ঘ) সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তারা শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারবেন কিন্তু প্লেসমেন্ট নিতে পারবেন না এবং লেনদেন (ট্রেডিং) করতে পারবেন না। প্লেসমেন্ট ঘুষ হিসাবে বিবেচিত হবে। বিনিয়োগের জন্য বিও অ্যাকাউন্ট থাকবে এবং বিও অ্যাকাউন্ট নম্বরসহ কত টাকা শেয়ারে বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা নিজ নিজ কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে এবং আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করতে হবে।
১১. সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রেক্ষাপট : (ক) বর্তমানে সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন পদ্ধতির দুর্বলতার সুযোগে কম্পানি তার সম্পদের অতিমূল্যায়ন করছে, যা সম্পদের প্রকৃত মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতিহীন। (খ) অতি মূল্যায়িত সম্পদের ওপর ঘঅঠ হিসাবে করলে, ইনডিকেটরটি ভুল সিগন্যাল দেবে। (গ) অনেক কম্পানি পুনর্মূল্যায়িত সম্পদ মূল্যের আনরিয়েলাইজড গেইনের বিপরীতে বোনাস শেয়ার ইস্যু করেছে, যা বিধিসম্মত নয়। (ঘ) সম্পদ পুনর্মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ‘স্থিগিত কর দায়’ -এর বিপরীতে সংস্থান করার বিধি রয়েছে ভবিষ্যতে কর প্রদানের সুবিধার্থে। কিন্তু পুনর্মূল্যায়নকারী কম্পানিগুলো তা করছে না। (ঙ) বাংলাদেশে সার্টিফায়েড সার্ভেয়ার নেই (ইনস্টিটিউট অব সার্ভেয়ার্সও নেই)। আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট একইসঙ্গে কোনো কম্পানির অডিট এবং ভ্যালুয়েশন করতে পারেন না।
সুপারিশ : (ক) যে পর্যন্ত দেশে চার্টার্ড সার্ভেয়ার্স ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে, সে পর্যন্ত ভ্যালুয়েশন বা মূল্যায়নের দায়িত্ব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফার্ম পালন করবে। তবে শর্ত থাকে, একই কম্পানির ভ্যালুয়ার এবং অডিটর দুটি পৃথক চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট সংস্থা হতে হবে, কোনো অবস্থাতেই অভিন্ন হবে না। (খ) এসইসির কাছে কোনো কম্পানি পুনর্মূল্যায়িত সম্পদের হিসাব পেশ কররে, এসইসি সন্তুষ্ট না হলে মূল্যায়ন প্রত্যাখ্যান করতে পারবে।
১২. স্থিরমূল্য পদ্ধতিতে শেয়ার মূল্য নির্ধারণ প্রেক্ষাপট : (ক) স্থিরমূল্য পদ্ধতিতে শেয়ারমূল্য নির্ধারণে জটিলতা কম হলেও অধিকতর বাস্তবসম্মত এবং অবজেকটিভ করার সুযোগ রয়েছে। (খ) ভবিষ্যৎ তিন বছরের প্রেক্ষেপিত আয় বিবেচনার সুযোগ আইনে রাখা হয়েছে, যা প্রশ্নসাপেক্ষ। (গ) পূর্ববর্তী বছরের সমজাতীয় স্টক-এর বাজারমূল্য বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সমজাতীয় স্টকের সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
সুপারিশ : (ক) তিন বছরের প্রজেক্টেড মূল্য নির্ণয়ের ভিত্তি এবং ভ্যালুয়েশন লিপিবদ্ধ করতে হবে। এসইসির নিকট গ্রহণযোগ্য বিবেচিত না হলে প্রত্যাখ্যান করা হবে। (খ) সমজাতীয় স্টকের সংজ্ঞা নির্ণয় করতে হবে। তদন্ত কমিটির মতে, বিবেচনাকালীন সময়ে যেসব কম্পানির ঘঅঠ আবেদনকারী কম্পানির ঘঅঠ-এর তিনগুণের মধ্যে থাকবে এবং পিই রেশিও ১৫-এর বেশি হবে না, সেসব কম্পানি সমজাতীয় কম্পানি হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিত। তবে শর্ত থাকে, সমজাতীয় কম্পানির ব্যবসাক্ষেত্র একই রকমের থাকবে। একই ধরনের ব্যবসা কি না, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করবে এসইসি। (গ) সম্পদ মূল্যায়ন সতর্কভাবে পরীক্ষা করবে এসইসি।
১৩. বুক-বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ার মূল্য নির্ধারণ প্রেক্ষাপট : (ক) বাজার বিকৃতি এর একটি প্রধান হিসাবে বের হয়ে এসেছে বুক-বিল্ডিংয়ের মাধ্যমে শেয়ারের উচ্চমূল্য নির্ধারণ। (খ) বুক-বিল্ডিং মেথডে (ডাইরেক্ট লিস্টিং) কেপিসিএলের ১০ টাকা শেয়ারের ইনডিকেটিভ মূল্য ধার্য হয় ১৬২ টাকা, প্রথম দিন বিক্রি মূল্য ছিল ১৯৪.২৫ টাকা এবং বর্তমানে (২৯.৩.১১) বাজারমূল্য মাত্র ৯৬.৯০ টাকা অর্থাৎ প্রথম বিক্রি মূল্য থেকে ৯৭.৩৫ টাকা হ্রাস পেয়েছে। বুক-বিল্ডিং মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিতে ওসিএলের ১০ টাকার শেয়ারের ইনডিকেটিভ মূল্য ছিল ১২১.৪০ টাকা, প্রথম বিক্রি মূল্য ১৪৫ টাকা এবং বর্তমানে (২৯.৩.১১) বাজারমূল্য ১০৯.১০ টাকা অর্থাৎ প্রথম বাজারমূল্যের চেয়ে ৩৬.৯০ টাকা কম। প্রমাণ হয়, কোম্পানি দুটির মূল্য নির্ধারণ ভুল ছিল।
(গ) মূল্য নির্ধারণে কারসাজি না করলে যে মূল্যক্ষয় হয় না, তার প্রমাণ র্যাক সিরামিকস। একই বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে তাদের ১০ টাকার শেয়ারের ইনডিকেটিভ মূল্য ধার্য হয় ৪০ টাকা, প্রথম বিক্রিমূল্য ছিল ৪৮ টাকা এবং বর্তমান (২৯.৩.১১) মূল্য দাঁড়িয়েছে ১০৮.৭০ টাকা অর্থাৎ প্রথম বিক্রি মূল্যের চেয়ে ৬০.৭০ টাকা বেশি। (ঘ) ওপরের তিনটি উদাহরণ থেকে প্রমাণ হয়, ইস্যুয়ার কোম্পানি এবং ইস্যু ম্যানেজার সৎ ও পেশাদার হলে মূল্য বিকৃতি ঘটে না। কিন্তু ইস্যুয়ার ও ইস্যু ম্যানেজার এই পদ্ধতিতে মূল্য ম্যানিপুলেট করতে পারে। পদ্ধতির দুর্বলতা দূর করা প্রয়োজন। মূল্যবিকৃতি রোধকল্পে বিধান করতে হব, যেসব কোম্পানি প্রাইস বিড করবে, তারা সবাই মিলে ওয়েটেড গড় মূল্যে মোট ইস্যুযোগ্য শেয়ারের অন্তত ১০% হারাহারিভাবে ক্রয় করতে বাধ্য থাকবে। স্টেক না থাকলে, মূল্য নির্ধারণে দায়িত্ববোধ থাকে না। (ঙ) বিডারদের এইভাবে ক্রয়কৃত শেয়ার অন্তত ১২০ দিনের লক-ইন থাকবে।
১৪. নিয়ন্ত্রণকারী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দুর্নীতি প্রেক্ষাপট : (ক) অষ্টম অধ্যায়ে দুর্নীতি চিত্র-১-এ সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশনের নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কবির ভুঁইয়ার স্ত্রী রোকসানা আখতারের নামে চারটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের শেয়ার লেনদেনের সুনির্দিষ্ট তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। (খ) অষ্টম অধ্যায়ের দুর্নীতি চিত্র-২-এ আইসিবির তৎকালীন উপ-মহাব্যবস্থাপক (বর্তমানে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক) কফিল উদ্দিন আহমদ চৌধুরীর স্ত্রী ফারজানা আকতার এবং শ্যালক মনসুর বিল্লাহের নামে শেয়ার লেনদেন ও প্লেসমেন্ট গ্রহণের সুনির্দিষ্ট তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। লেনদেনের মুনাফার অর্থ কফিল উদ্দিন চৌধুরীর নিজ নামে স্থায়ী আমানত হিসাবে রক্ষিত হয়েছে, সে তথ্য এফডিআর নম্বরসহ উল্লেখ করা হয়েছে।
(গ) অষ্টম অধ্যায়ের ৮.৫ তথ্যচিত্রে এবি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী আর, ওয়াই, শমসের কর্তৃক নিজ নামে প্রায় ১২ কোটি টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার গ্রহণের সুনির্দিষ্ট তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। এটি স্বার্থ-সংঘাতজনিত কাজ। সুপারিশ : (ক) প্রথম দুজনেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন বিধায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভাগীয় মামলা গঠন করা উচিত। (খ) দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য বিভাগীয় মামলার অতিরিক্ত দুর্নীতির মামলা গঠনের উদ্দেশ্যে দুর্নীতি দমন বিভাগে প্রেরণ করা উচিত। (গ) আর ওয়াই শমসের হয়েও প্লেসমেন্ট নিয়ে অনৈতিক কাজ করেছেন বিধায় তাকে পদ থেকে অপসারণ করা উচিত।
১৫. সিরিয়াল ট্রেডিং ও কারসাজি প্রেক্ষাপট : (ক) অষ্টম অধ্যায়ে ৮.৬ প্যারায় জনাব সিরাজউদ্দৌলা ও সহযোগীবৃন্দ, ইয়াকুব আলী খন্দকার ও সহযোগীবৃন্দ এবং আনোয়ার হোসেন খান ও সহযোগীবৃন্দের মধ্যে লেনদেন করে কৃত্রিম ট্রেডিং পরিবেশ সৃষ্টির তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। (খ) ৮.৭ প্যারাতে আবু সাদত মো. সায়েম ও তার ভাই আব্দুল মোবিন মোল্লার সিরিয়াল ট্রেডিংয়ের তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। (গ) ৮.৮ প্যারাতে গোলাম মোস্তফার ছয়টি ব্রোকার হাউসের মাধমে ক্রয়-বিক্রয়, কারচুপি এবং অনৈতিকভাবে মূল্য উত্তেজক কর্মের তথ্য পরিবেশিত হয়েছে।
সুপারিশ : অনৈতিক কাজগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি কর্তৃক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ৮.৬ প্যারায় বর্ণিত কারসাজি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ আইনের ১৭(ই) ধারার পরিপন্থী।
১৬. শেয়ারের ফেইসভ্যালু ইউনিফর্মকরণ প্রেক্ষাপট : (ক) অষ্টম অধ্যায়ের ৮.৯ পর্বে দেখানো হয়েছে, স্টক স্প্লিটের ফলে বাজার বিচ্যুতি ঘটেছে ৮১.৫%। (খ) সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ও সুশীল সমাজের সঙ্গে কমিটির সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভাসমূহে শেয়ারে ফেইসভ্যালু ইউনিফরম করার পক্ষে ব্যাপক সুপারিশ প্রদান করা হয়। তবে সমমূল্য ১০০ নাকি ১০ টাকা হবে, তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। (গ) ফেইসভ্যালুতে ভিন্নতা থাকায় মার্কেট প্লেয়ারদের পার্সেপশন সমস্যা প্রকট এ কথা নিশ্চিত। এটি দেশজ সমস্যা। ১০০ টাকার শেয়ার ৫০০ টাকা হলে যেমন চোখে পড়ে, ১০ টাকার শেয়ার ৫০ টাকা হলে তেমন চোখে পড়ে না। সাধারণ ক্রেতা ৫০০ টাকার তুলনায় ৫০ টাকায় শেয়ার ক্রয় শ্রেয় মনে করেন, যাতে করে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে থাকে।
সুপারিশ : যেহেতু (ক) ১০০ টাকার অনেক শেয়ার এরই মধ্যে ১০ টাকায় রূপান্তরিত হয়েছে এবং (খ) ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০ টাকার শেয়ার ক্রয় সহজসাধ্য, অতএব কমিটি মনে করে, অন্যান্য মূল্যমানের শেয়ারগুলো সমমূল্য করার সুবিধার্থে ১০ টাকায় রূপান্তর করা হোক। ১০ টাকা ফেইসভ্যালু নয় এমন লিস্টেড কম্পানিগুলোকে ২০১১ সালের মধ্যে শেয়ারের ফেইসভ্যালু ১০ টাকায় কনভার্ট করার উৎসাহমূলক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
১৭. রাইট শেয়ার/প্রেফারেন্স শেয়ার ইস্যুতে অনৈতিকতা প্রেক্ষাপট : (ক) অষ্টম অধ্যায়ে ৮.১০ পর্বে বর্ণিত হয়েছে, রাইট শেয়ার ইস্যুর ক্ষেত্রে কনফিডেন্স সিমেন্ট ৬০০% প্রিমিয়ামে, বেলিজিং ২৫০% প্রিমিয়ামে, ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স ২০০% প্রিমিয়ামে এবং দি সিটি ব্যাংক, ফিনিক্স ফাইন্যান্স ও এশিয়া ইন্স্যুরেন্স প্রত্যেকে ১০০% প্রিমিয়ামে রাইট শেয়ার ইস্যু করেছে। এসইসির অনুমোদন প্রশ্নবিদ্ধ। শেয়ারসংখ্যা বৃদ্ধিতে দাম কমার কথা। কিন্তু রাইট ইস্যুর পর দাম বেড়েছে। রহস্যজনক।
(খ) রূপান্তরযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ারের প্রচলন দেশে খুব একটা ছিল না। অথচ ২০০৯-১০ দুবছরে ৮টি কম্পানি প্রেফারেন্স শেয়ারে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। বেক্সিমকো ফার্মা ৪১০ কোটি টাকা, সামিট পাওয়ার ৩০০ কোটি টাকা, আফতাব অটোমোবাইলস ১৮০ কোটি টাকা এবং পিপলস লিজিং ১২০ কোটি টাকা তুলেছে। (গ) অনেক প্রেফারেন্স শেয়ার মাত্র ২/৩ মাসের মেয়াদে ছাড়া হয়েছে। মাত্র ১ মাসের জন্যও ছাড়ার নজিরও রয়েছে। এত অল্প মেয়াদে রূপান্তরকরণ বিদেশে সাধারণত দেখা যায় না।
সুপারিশ : যেহেতু প্রেক্ষাপটে বর্ণিত অস্বাভাবিকতা ছিল রাইট/প্রেফারেন্স শেয়ার ইস্যু প্রক্রিয়ায় এবং যেহেতু এ সবকিছুই হয়েছে এসইসির অনুমোদনে, অতএব এসইসির সিদ্ধান্ত নৈতিকতাবর্জিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ। এসইসি পুনর্গঠিত হওয়ার পর বিষয়টি তদন্ত করে দেখা যেতে পারে, দায়ী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
১৮. শীর্ষ প্লেয়ারদের সন্দেহজনক লেনদেন প্রেক্ষাপট : (ক) পঞ্চম অধ্যায়ের বর্ণনা থেকে স্পর্শকাতর সময়ে শীর্ষ লেনদেনকারী ব্যক্তিদের মাঝে ছিলেন গোলাম মোস্তফা, আবু সাদাত মো. সায়েম, ইয়াকুব আলী খন্দকার, সৈয়দ সিরাজুদ্দৌলা, মো. খলিলুজ্জামান, মো. শহীদুল্লাহ, আরিফুর রহমান, সোমা আলম রহমান প্রমুখ। (খ) শীর্ষ লেনদেনকারী সংস্থার মধ্যে ছিল আইসিবি, ফ্রন্টিয়ার ফান্ড (বারমুডা), ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্স, এবি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, উত্তরা ফিনান্স, ন্যাশনাল ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক প্রভৃতি। সুপারিশ : এসইসি এসব সংস্থা ও ব্যক্তির শেয়ার লেনদেনের ওপর বিস্তারিত তদন্ত করতে পারে। আইনের ব্যত্যয় পরিলক্ষ্মিত হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। (খ) এই অ্যাকাউন্টগুলো সার্বক্ষণিক ভিজিলেন্সের আওতায় রাখতে হবে।
১৯. অমনিবাস অ্যাকাউন্টের শ্যাডো হিসাবে কারসাজি প্রেক্ষাপট : (ক) সময়স্বল্পতায় তদন্ত কমিটি অমনিবাস অ্যাকাউন্টের অন্তরালে থাকা কয়েক লাখ ছায়া-হিসাব পরীক্ষা করতে পারেনি। নমুনা চয়ন করে কয়েকটি হিসাব পরীক্ষাকালে (পঞ্চম অধ্যায় ৫.১৩ প্যারা) মোসাদ্দেক আলী ফালু, ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস লি. ডা. এইচ বি এম ইকবাল, মুনিরুদ্দিন আহমদ, রোকসানা আমজাদ, গোলাম মোস্তফা, আহসান ইমাম, ইয়াকুব আলী খন্দকার, নিউ ইংল্যান্ড ইক্যুইটি লি., মো. লুৎফর রহমান (বাদল), সোমা আলম রহমান প্রমুখের (প্যারা ৫.১৫) ছায়া-হিসাবে লেনদেন হিসাবের মাধ্যমে যথাযথ জমা-উত্তোলন প্রতিফলিত হয়নি। সুপারিশ : (ক) পুনর্গঠিত এসইসি সব অমনিবাস অ্যাকাউন্টের আড়ালে থাকা ছায়া-হিসাবগুলো যথাযথ পরীক্ষা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (খ) হিসাবগুলোকে বিও অ্যাকাউন্টে রূপান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
২০. ব্লক প্লেসমেন্ট প্রেক্ষাপট : (ক) পঞ্চম অধ্যায়ের ৫.১৯ পর্বে মাত্র ২টি ঠিকানায় ১৯ ব্যক্তিকে ১৯ কোটি টাকার শেয়ার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা সন্দেহজনক ব্লক ট্রেডিং। (ঘ) ৫.২০ প্যারাতে আহসান ইমাম, সোমা আলম রহমান, শামিমা শরীফ, লুৎফর রহমান বাদল, মনসুর বিল্লাহ প্রমুখের নামে বিপুল অঙ্কের শেয়ার বরাদ্দের তথ্য রয়েছে। সুপারিশ : এসইসি পুনর্গঠনের পর এসব তথ্যের ভিত্তিতে বিস্তারিত তদন্ত করে এদের মধ্যে আন্তঃসংযোগ, যোগসাজশে বরাদ্দগ্রহণ প্রভৃতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য বের করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২১. কেস স্টাডি পর্বে চিহ্নিত সমস্যা প্রেক্ষাপট : সপ্তম অধ্যায়ে মোট ১৭টি কোম্পানির কেসস্টাডি করা হয়েছে। সীমাবদ্ধতার মধ্যে সর্বাধিক তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপন করা হয়েছে। মন্তব্য সন্নিবেশিত হয়েছে। সুপারিশ: কেসসমূহে চিহ্নিত অস্বাভাবিকতা, অনিয়ম, আইন লঙ্ঘন, প্রভৃতির জন্য কে দায়ী এবং এগুলোকে অনুমোদনের জন্য নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা কে কে দায়ী, তা পরীক্ষা করে নিরূপণ করা প্রয়োজন। পুনর্গঠিত এসইসি এ দায়িত্ব পালন করতে পারে।
২২. তদন্ত পরবর্তী ধারাবাহিক কর্ম প্রেক্ষাপট : শেয়ার লেনদেনের অর্থ বিও অ্যাকাউন্ট, মার্চেন্ট ব্যাংকার অ্যাকাউন্ট, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট প্রভৃতির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। কখনো বা নগদায়ন হয়। ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্য সংস্থাসমূহের নিয়ন্ত্রক এসইসি। উভয় সংস্থার ‘সম্মিলিত পরিদর্শন ও তদন্ত’ ব্যতিরেকে অর্থের হদিস করা অসম্ভব। তদন্ত কমিটি নিজস্ব প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের যৌথ তদারকিতে তদন্ত চালিয়ে কয়েকটি নমুনা অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করেছে। আশ্চর্যজনকভাবে এত অল্প নমুনা পরীক্ষাতেও দুর্নীতির তথ্য বের হয়ে এসেছে, যা অষ্টম অধ্যায়সহ অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে। কমিটি নিশ্চিত, নিবিড় যৌথ তদন্ত অব্যাহত থাকলে আরো অনেক-অধিক দুর্নীতি-অনিয়ম বের হয়ে আসবে এবং স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
সুপারিশ : যৌথ তদন্ত অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে এসইসি, ডিএসই, সিএসই, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর সমন্বয়ে একটি সার্বক্ষণিক ‘যৌথ ইন্সপেকশন দল’ গঠন করা যেতে পারে। নেতৃত্বে থাকবে এসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দুজন নির্বাহী পরিচালক (নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত)। এ দুজন ‘ইন্সপেকশন পরিকল্পনা’ প্রণয়ন করবেন এবং যৌথ দল তদনুযায়ী কাজ করে উভয়ের কাছে রিপোর্ট প্রদান করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক পরীক্ষা করবে অর্থের সংস্থান কোথা থেকে আসছে, অর্থ কোথায় যাচ্ছে, মানি লন্ডারিং হচ্ছে কি না? এসইসি দেখবে লেনদেনে কারসাজি, অনৈতিকতা বা আইনভঙ্গ হচ্ছে কি না?
২৩ বাস্তবায়ন মনিটরিং প্রেক্ষাপট : (ক) ১৯৯৬ সালের শেয়ার তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বাস্তবায়ন দূরের কথা, বিবেচিত হয়েছে কি-না, সে প্রশ্ন রয়েছে। ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। (খ) বর্তমান কমিটি অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও উল্লেখযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করেছে, দুর্নীতি-অনিয়ম সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে, নমুনা ইন্সপেকশন করেছে এবং তদনুযায়ী সুপারিশ প্রণয়ন করেছে। এসবের যুক্তিযুক্ত পরিণতি থাকা উচিত।
সুপারিশ : তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন, বিশেষ করে সুপারিশ পর্যালোচনা করে সরকার যেগুলো গ্রহণ করবে, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য একটি ‘বাস্তবায়ন মনিটরিং কমিটি’ গঠন করা প্রয়োজন। ব্যাংকিং বিভাগের সচিবের নেতেৃত্বে এসইসির চেয়ারম্যান ও দুজন মেম্বার সমন্বয়ে এই কমিটি গঠিত হতে পারে। কমিটি প্রথম তিন মাস সাপ্তাহিক ভিত্তিতে, পরবর্তী ছয় মাস পাক্ষিক ভিত্তিতে এবং তৎপরবর্তী সময়ে মাসিক ভিত্তিতে বাস্তবায়ন তদারকি করবে। কমিটি মাসিক ভিত্তিতে মন্ত্রী মহোদয়কে বাস্তবায়ন অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করবে। সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতে থাকবে।
২৪. সরকারের সতর্কতা প্রয়োজন প্রেক্ষাপট : ১৯৯৬ সালের তদন্ত প্রতিবেদনে সন্দেহের তালিকায় ছিলেন ইমতিয়াজ হোসেন, খোরশেদ আলম, সালমান এফ রহমান, এনায়েতুর রহিম, রকিবুর রহমান, শাকিল রিজভি প্রমুখ। বর্তমান তদন্তে এদের মধ্যে সালমান এফ রহমান এবং রকিবুর রহমানের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক মতামত এসেছে এবং কিছু তথ্যও পরিবেশিত হয়েছে। এসইসিকে প্রভাবিত করতে দুজনেই সক্রিয় ছিলেন মর্মে অনেকেরই ধারণা।
এসইসির বর্তমান চেয়ারম্যানের নিয়োগ এবং মেম্বার মনসুর আলমের পুনর্নিয়োগে সালমান এফ রহমান ও রকিবের জোরালো তদবির ও সমর্থন ছিল বলে অনেকের বিশ্বাস। বিডি থাই এলুমিনিয়ামের অস্বচ্ছ কেসটির তদবিরে সালমান নিজেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে ধর্না দিয়েছেন। জিএমজি, ইউনিক হোটেল প্রভৃতি কেসে সালমান সম্পৃক্ত। কেসগুলো অস্বচ্ছ। এসইসি পরিচালনায় দুজনেরই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব ছিল। এ কারণে সাধারণ্যে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।
সুপারিশ : পুঁজিবাজার লেনদেন ও পরিচালনায় সালমান ও জনাব রকিবের প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন বলে তদন্ত কমিটি মনে করে।
২৫. বিবিধ প্রসঙ্গ (ক) বিও অ্যাকাউন্ট খোলার সময় টিন নম্বর প্রদানের বিধান করা হোক। (খ) এসইসির অবসরপ্রাপ্ত, পদত্যাগকাারী, অন্য কোনোভাবে অপসারিত বা চাকরি অবসায়নকৃত কর্মকর্তাদের পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে নিয়োগ, পরমার্শক, উপদেষ্টা বা অন্য কোনোভাবে পূর্ণ বা খণ্ডকালীন নিয়োগ প্রদান এবং শেয়ার-ইস্যু বা পুঁজিবাজারসংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে পরমার্শ-সার্ভিস প্রদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ তাদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থাকে এবং স্বার্থ সংঘাত সৃষ্টি হয়। (এসইসির প্রাক্তন মেম্বার জনাব সাহবুব আলম কনসালটেন্সির সুযোগে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন মর্মে অভিযোগ রয়েছে)।
(গ) সিডিবিএল থেকে দৈনন্দিন ভিত্তিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারহোল্ডিংয়ের তথ্য কোম্পানিকে প্রদান বন্ধ করা হোক। সিডিবিএল ও স্টক এক্সচেঞ্জদ্বরে তথ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা আরো সংহত করতে হবে। কারণ তথ্য পাচারের অভিযোগ রয়েছে এবং পাচারকৃত ছাপানো তালিকা তদন্ত কমিটির হস্তগত হয়েছে। (ঘ) গুজবনির্ভর শেয়ার ট্রেডিং বন্ধ করার লক্ষ্যে এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পরমার্শ সহায়তা প্রদানের জন্য এসইসি ‘বিনিয়োগ পরমার্শক’ নিবন্ধনপ্রথা প্রচলন করতে পারে।