ওয়েব ডেস্ক: দেশে করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর উচ্চ আদালতে বন্ধ হয়ে যায় সরাসরি বিচার কার্যক্রম। কয়েক ধাপে কমিয়ে-বাড়িয়ে ভার্চুয়ালি চালু রাখা হয় আদালত। পরে করোনার সংক্রমণ কমে আসা ও আদালতের বিচারক-কর্মকর্তারা টিকা নেওয়ায় কয়েকটি চালু করা হয় বেঞ্চ সরাসরি।
করোনার সংক্রমণ আরও কমে এলে সব বেঞ্চ সরাসরি চালু করা হবে কি না বা করোনা মহামারি আরও দীর্ঘায়িত হলে ভার্চুয়ালিই বিচারকাজ চলবে কি না, তা নিয়ে আদালতপাড়ায় চলছে আলোচনা। তবে ভার্চুয়াল ও সরাসরি, দুই পদ্ধতিই চালু রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন আইনজীবীরা।
আদালতের অধিকাংশ সিনিয়র আইনজীবী ভার্চুয়াল কোর্টের পক্ষে মত দিলেও জুনিয়রদের অনেকেই সরাসরি কোর্ট পরিচালনার পক্ষে মত দিয়েছেন।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার উদ্ভূত পরিস্থিতে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির মধ্যে বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের কথা মাথায় রেখে দেশের আদালত বন্ধ না রেখে ভার্চুয়াল কোর্ট চালুর ব্যবস্থা করা হয়। এজন্য ২০২০ সালের ২৬ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের রুলস কমিটি পুনরায় গঠন এবং ভার্চুয়াল কোর্ট চালুর প্রয়োজনীয় আইনি প্রতিবন্ধকতা দূর করতে নেওয়া হয় পদক্ষেপ।
ওই বছরই প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন দেশের ইতিহাসে প্রথম ভিডিও কনফারেন্সে ফুলকোর্ট সভা করেন। যেখানে ভিডিও কনফারেন্সে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট উভয় বিভাগের ৮৮ জন বিচারপতি যুক্ত ছিলেন।
এরপর দেশের বিচারপ্রার্থী জনগণের দুর্ভোগের কথা মাথায় রেখে ওই বছরই ৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গণভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ -২০২০’ এর খসড়া অনুমোদন দেন। এর পরে ৯ মে ভার্চুয়াল কোর্ট সম্পর্কিত অধ্যাদেশ জারি করা হয়। পরে এটি সংসদেও পাস করা হয়। এরপরেই ভার্চুয়ালি শুরু হয় বিচারিক কাজ।
এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগে ৫৩টি বেঞ্চে বিচারকাজ পরিচালিত হয়ে আসছে।
তবে গত ৫ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতির নির্দেশক্রমে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাইকোর্টের কোনো বেঞ্চ চাইলে শারীরিক উপস্থিতিতে বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারবে।
এরপর থেকে কয়েকটি বেঞ্চ শারীরিক উপস্থিতিতে শুনানি করে আসছেন। আবার তারা ভার্চুয়ালি শুনানির ব্যবস্থাও রেখেছেন।
নতুন করে শারীরিক উপস্থিতিতে আদালত পরিচালনার কোনো সিদ্ধান্ত আসবে কি না জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের স্পেশাল অফিসার ও মুখপাত্র ব্যারিস্টার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আপাতত এ বিষয়ে নতুন করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনা একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। এ কারণে আমরা একটা পর্যায়ে গিয়ে ডিজিটাল সিস্টেমে অনলাইনে মামলা পরিচালনা করে আসছি। এখন যেহেতু করোনার প্রাদুর্ভাব কম, তাই প্রধান বিচারপতি সরাসরি আদালত চালানোর জন্য বিচারপতিদের স্বাধীনতা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে সাধারণ আইনজীবীদের মধ্যে অধিকাংশেরই মত আদালতের কার্যক্রম সশরীরে চালু হোক। আবার অনেক সিনিয়র আইনজীবী আদালতে আসতে চান না, করোনাভীতির কারণে। তারা চান ভার্চুয়াল আদালত অব্যাহত থাক।
তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে দুই পক্ষের মধ্যে ভারসাম্য আনার জন্য আমার মনে হয় দুটি সিস্টেমই চালু থাকা দরকার। সামনে আমাদের ছুটি আছে। সে ছুটির পর পরিস্থিতি বিবেচনায় যদি করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্ত কম থাকে তাহলে সেক্ষত্রে সশরীরে আদালত খোলা যেতে পারে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, আমার মতে ভার্চুয়ালি চলাই উচিত। আবার কেউ কেউ ফিজিক্যালি আদালত করতে চান। তাই ভার্চুয়াল ও ফিজিক্যাল দু’ভাবেই থাকা উচিত। শারীরিক উপস্থিতিতে বিচারকাজ চালু করা হলেও ভার্চুয়ালি সুযোগ থাকা দরকার। সিনিয়রদের অনেকেরই সমস্যা আছে। তাদের জন্য হলেও ভার্চুয়াল কোর্ট চালু থাকা দরকার।
ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ড. মো. বশির উল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, অনেকেই চান শারীরিক উপস্থিতিতে কোর্ট চলুক। আবার কেউ কেউ চান যেন ভার্চুয়ালই হোক। ভার্চুয়ালি কোনো প্রতিবন্ধকতা বা অসুবিধার সম্মুখীন রাষ্ট্রপক্ষ হচ্ছে বলে মনে করি না। কারণ ভার্চুয়ালি আদালত চলার কারণেই আইনজীবীদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা কম। এ কারণে সংক্রমণ শূন্যে না নামা পর্যন্ত ভার্চুয়াল কোর্ট থাকাটা শ্রেয়।
তবে আইনজীবীদের মধ্যে ভিন্নমতও আছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এমএ আলী হোসেন বলেন, আমাদের সব ডকুমেন্টস বা প্রপার ডকুমেন্টস আমরা দেখাতে পারি না। কথাও বলা যায় না। সাজিয়ে গুছিয়ে বেশি ক্থা বলাও কঠিন হয়। দেখা গেলো মেনশন করার সময় অনলাইনে কমপক্ষে ৫০ জন কথা বলছেন। কিন্তু শারীরিক উপস্থিতিতে শুনানি হলে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে হতো। সেখানে একজনের পেছনে আরেকজন দাঁড়িয়ে, একজনের কথা শেষ হওয়ার পর আরেকজনের কথা শুরু হয়। এর মাধ্যমে ডিসিপ্লিনের মধ্যে চলে যেতাম।
এম এ আলী হোসেন আরও বলেন, মহামারি যদি আবারও বাড়ে বা থাকে তাহলে ভার্চুয়ালিও কোর্ট বা মামলা পরিচালনা হওয়া উচিত।
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. শিহাব উদ্দিন খান বলেন, ভার্চুয়াল সুবিধাটি ওপেন রাখা উচিত। কারণ এখনো তো করোনা পুরোপুরি চলে যায়নি। এখনই ফুল ফিজিক্যাল করলে আরেকটা ঢেউ যদি আবার আসে, তখন দেখা গেলো কোর্ট বন্ধ করে নতুন করে শুরু করতে হয়। কিছু সুযোগ-সুবিধা রাখা উচিত। তা না হলে মামলার শুনানি বন্ধ করে দিলে স্থবির হয়ে যায়।
হাইকোর্ট বিভাগের এনেক্স ১৭ নম্বর আদালতের উদাহরণ তুলে শিহাব উদ্দিন খান বলেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীম স্যারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে মেনশনটা ভার্চুয়ালি করে পরিস্থিতি বুঝে উনি শুনানি শারীরিক উপস্থিতিতে নেন। এভাবে কোর্ট ফিজিক্যাল করে দেওয়া উচিত। তবে মেনশনসহ অন্য সময় যখন চাপ বাড়বে তখন কৌশল কিছুটা কাজ করা দরকার। আইনজীবীদের ভিড় এড়িয়ে যাওয়া যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে সেটি ভার্চুয়াল রেখে আইটেম ওয়াইজ ফিজিক্যালি শুনানি হতে পারে।
সূত্র: জাগো নিউজ