ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা দখলমুক্ত করতে ঢাকা-১৪ আসনের সাংসদ আসলামুল হকের মালিকানাধীন মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্ট ও আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন অবিলম্বে উচ্ছেদের সুপারিশ করেছে সরকারের একটি সংস্থা।
প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বাজেট নিয়ে সাভারের শ্যামলাপুর, কেরানীগঞ্জের ওয়াশপুর ও ঘাটারচর অংশে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের তীর এবং প্লাবনভূমি দখল করে এই দুই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছিলেন আসলামুল হক। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর জমি দখল করে এই সাংসদ বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বিশেষ অর্থনৈতিক জোন গড়ে তুলছিলেন বলে কয়েকটি সংস্থার যৌথ জরিপে প্রমাণ মিলেছে।
বুধবার (২৫ নভেম্বর) জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে প্রতিবেদন দাখিল করে আসলামুলের দুটি স্থাপনা অবিলম্বে উচ্ছেদের সুপারিশ করো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের রায় ও আইনকানুনের ভিত্তিতে কেরানীগঞ্জের ওয়াশপুর, ঘাটারচর এবং সাভারের শ্যামলাপুর মৌজায় বুড়িগঙ্গা-তুরাগ নদীর জমি, নদীর তীরভূমি, প্লাবনভূমিসহ মোট ৫৪ দশমিক ০১৭৮ একর জমিতে মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্ট ও আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন কর্তৃক নির্মিত অবৈধ স্থাপনা অবিলম্বে উচ্ছেদ করবে। সেই সঙ্গে নদী, নদীর প্লাবন ভূমি জরুরিভিত্তিতে উদ্ধারের সুপারিশ করা হলো। বিআইডব্লিটিএ ইতিপূর্বে যে উচ্ছেদ ও উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেছিল তা অগ্রাধিকারভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গভাবে সুসম্পন্নের সুপারিশ করা হলো।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্থাপনা সরিয়ে নিতে ব্যর্থ হলে, কিংবা অবহেলা করলে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কালবিলম্ব না করেই উল্লেখিত সংস্থাসমূহের (বিআইডব্লিউটিএ, রাজউক, নদী কমিশন, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরসহ বেশকিছু সরকারি সংস্থা) সমন্বয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে এবং অভিযানের যাবতীয় ব্যয়ভার আবেদনকারী (যৌথ জরিপের জন্য বিআইডব্লিটিএর কাছে আসলামুল হকের আবেদন) বা অভিযোগকারী বহন করতে বাধ্য থাকবেন।
হাইকোর্টে উপস্থাপনের জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের দেয়া প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়েছে। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদী দখল করেছেন বলে সংস্থার যৌথ জরিপে প্রমাণিত পেয়েছে। তাই প্রতিবেদনে ১০ দফা সুপারিশ করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।
কমিশনের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ গণমাধ্যকে বলেন, গত ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর যৌথ জরিপের পর গত ৯ নভেম্বর এ প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত হয়েছে। আজ (বৃহস্পতিবার), বা আগামী ২৯ নভেম্বর প্রতিবেদনটি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করা হবে।
এর আগে আরিশা অর্থনৈতিক জোন করতে ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্ত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদনের পর শ্যামলাপুর মৌজার (তুরাগ নদের তীর সংলগ্ন) ৫১ দশমিক ০১২১ একর জমির ওপর এই বেসরকারি অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। গত বছর ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই নির্মাণ কাজের উদ্বোধনও করেন। এ অবস্থায় বিআইডব্লিউটিএ গত ২৩ অগাস্ট আরিশা কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দিয়ে সাত দিনের মধ্যে নদীর জমি থেকে স্থাপনা উচ্ছেদ করতে বলে। একই সঙ্গে ভরাট করা মাটি সরিয়ে ভূমি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে বলা হয়।
আরিশা অর্থনৈতিক জোন সাত দিনের মধ্যে কাজটি করতে ব্যর্থ হলে বিআইডব্লিউটিএ উচ্ছেদ করবে। এই উচ্ছেদের খরচ আরিশাকে বহন করতে হবে। এই নোটিশ পাওয়ার পর গত ২৬ অগাস্ট এর জবাব দেয় আরিশা কর্তৃপক্ষ। জবাবে তুরাগের জমি দখলের অভিযোগ অস্বীকার করার পাশাপাশি বিরোধপূর্ণ এলাকায় যৌথ জরিপ করার প্রস্তাব দেয়া দেয়। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ এ বিষয়ে কোনো জবাব না দিলে হাইকোর্টে রিট করেন আসলামুল হক।
ওই রিটের শুনানির পর গত ২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট আরিশা অর্থনৈতিক জোনের নির্মাণ কার্যক্রমে স্থিতাবস্থা এবং নির্মাণাধীন জোন উচ্ছেদে বিআইডব্লিউটিএ’র কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদেশ দেন।
গত মার্চে বুড়িগঙ্গার পশ্চিমপাড়ে কেরানীগঞ্জের চরওয়াশপুরে আসলামুল হকের গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান চালায় বিআইডব্লিউটিএ। পরে হাইকোর্টে এসে তা আটকে দেন আওয়ামী লীগের এই এমপি। তখন হাইকোর্ট ১০ দিনের জন্য এই স্থিতাবস্থা দিয়ে বিআইডব্লিউটিএকে বিরোধপূর্ণ ভূমি নিয়ে যৌথ জরিপ চালাতে বলেন আদালত। এরপরই ঢাকার জেলা প্রশাসকের (ডিসি) নেতৃত্বে বিআইডব্লিউটিএ, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) প্রতিনিধিদের নিয়ে জরিপ চালানো হয়।
জরিপে বুড়িগঙ্গা, তুরাগের ১২.৭৮৬৪ একর, তীরভূমি ও প্লাবনভূমির ৭.৯২১২ একর ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ড্যাপের আওতাভুক্ত জমিসহ মোট ৫৪ দশমিক ০১৭৮ একর জমিতে মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্ট ও আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোনসহ বেশকিছু বাণিজ্যিক অবৈধ স্থাপনার প্রমাণ মেলে।
তাদের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমপি আসলামুল হকের স্থাপনা বিরোধপূর্ণ ভূমি নদীর তীরভূমির মধ্যে অবস্থিত। তাই আইনত তর্কিত জমিতে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা বা শ্রেণি পরিবর্তন করা আইনানুগ হয়নি। কিন্তু আসলামুল হকের মালিকানাধীন মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্ট ও আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন তা লংঘন করেছে। এছাড়া বন্দর আইন-১৯০৮, বন্দর বিধি-১৯৬৬ অনুযায়ী নদী বন্দর সংরক্ষকের অনুমতি ছাড়া বন্দর এলাকায় বা সীমানায় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কোনো কার্যক্রম গ্রহণের এখতিয়ার নেই। এ ধরনের কার্যক্রম বন্দর আইন-১৯০৮, বন্দর বিধি-১৯৬৬, অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ ১৯৭৬ এর সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্ট ও আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন নির্মাণে পরিবেশগত ছাড়পত্রের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদী ও নদীর তীরভূমি তথা নিম্নাঞ্চল ভরাট বা ক্ষতিগ্রস্ত করায় সর্বোপরি নদীর প্লাবন ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করা পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এবং প্রাকৃতিক জলাধার আইন, ২০০০ এর পরিপন্থী ও দণ্ডনীয় অপরাধ। আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন পূর্ণাঙ্গভাবে স্থাপিত হলে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। এমনকি নৌ-চলাচলের পথ ও সুযোগ আরও সঙ্কুচিত হবে। তাই বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদী রক্ষার স্বার্থে মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্ট ও আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোনের নির্মাণ কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
আসলামুল হক নিজে তার সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করলে এভাবে অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ এবং তার ব্যয় ওই এমপির কাছ থেকে আদায় করতে বলা হয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর তীরে স্থাপিত মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্ট ও আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন নির্মাণ কার্যক্রমের জন্য পরিবেশ অধিদফতর থেকে লাল শ্রেণিভুক্ত করে ছাড়পত্র নবায়ন করা হয়েছে। এ কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, যা ভবিষ্যতে আরও প্রকট আকার ধারণ করবে।
মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্ট ও আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন নির্মাণকে পরিবেশ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ এর সুস্পষ্ট লংঘন এবং ফৌজদারী অপরাধ। নদীর জমি জেনেও অবস্থানগত, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন না করে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়া যুক্তিসঙ্গত হয়নি, যা আইনের পরিপন্থী।
বিআইডব্লিটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রাজউকের সাথে আলোচনা করে বা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের অনুমতি সাপেক্ষে এ ছাড়পত্র দেয়া হয়নি।পরিবেশ অধিদফতর থেকে আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোনকে যেহেতু পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়া হয়নি, তাই বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন থাকলেও জোনকে ছাড়পত্র দেয়া পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ এর সুস্পষ্ট লংঘন।