মুরাদ হাসান, রূপগঞ্জ: বেকার যুবক রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের নবগ্রাম এলাকার টিটু মিয়া। পোল্ট্রি ব্যবসা শুরু করেন ৬ বছর আগে। তিনি বলেন, “ভালই চলছিল ব্যবসা। হঠাৎ করেই ২৫ হাজার মুরগী অজ্ঞাত রোগে মারা যায়। ব্যবসার পতন শুরু হয়। এরপর এলো করোণার থাবা। বেচাকিনি একেবারে বন্ধ। যান চলাচলও বন্ধ। নিজেই খামু কি আর মুরগীকে ই খাওয়ামু কি! বড় বিপদে আছি। এভাবে চললে নিঃস্ব হয়ে যাব।” “বাপরে শেষ কাইল্যা ৩ শতক জমি বেইচ্যা মুরগীর ব্যবসা শুরু করছিলাম। খাইয়া-দাইয়া ভালাই চলছিলো। ব্যবসা কইরা আবার ৪ শতক জমিও কিনছি। এহনতো কপালে হাত। করোনা আমাগো কাল অইয়া দাঁড়াইলো। ব্যবসা-পাতি নাই। এই অবস্থা চললে ভিটা-বাড়ি সব বেচন লাগবো। অহন আল্লাহ যদি আমাগো দিকে একটু চায়, তাইলেই শান্তি অইবো।” এমন হতাশা আর আক্ষেপের সুরেই কথাগুলো বললেন রূপগঞ্জের পোল্ট্রি শিল্প এলাকাখ্যাত ভোলাব ইউনিয়নের পোল্ট্রি ব্যবসায়ী ষাটোর্ধ্ব ফরমান আলী। রূপগঞ্জের এ ইউনিয়নেই রয়েছে প্রায় ২৫০ পোল্ট্রি খামার। এছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আরো শতাধিক পোল্ট্রি খামার রয়েছে বলে উপজেলা প্রাণী সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। করোনার প্রভাবে রূপগঞ্জের ধুন্ধুমার বাণিজ্যখ্যাত এলাকা ভোলাবো পোল্ট্রি শিল্পে ধ্বস নেমেছে। ফলে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা লোকসান গুনছেন খামারী মালিকরা। সম্ভাবনাময় এ শিল্প বন্ধের আশঙ্কায় প্রহর গুনছেন গোটা উপজেলার ৩৬০ খামারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত দেড় হাজার শ্রমিক ও তাদের পরিবার। এ শিল্প থেকে শুধু ভোলাবো পোল্ট্রি খামারগুলো থেকে মাসে ৪ কোটি আর বছরে ৫২ কোটি টাকা লেনদেন হয় বলে পোল্ট্রি মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে। এ শিল্প বন্ধ হয়ে গেলে বড় ধরণের ঝূঁকির মধ্যে পড়বে রূপগঞ্জের অর্থনীতির চাকা এমনটাই আশঙ্কা করছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিনে ভোলাব ঘুরে খামারী মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোলাবোর পোল্ট্রি শিল্পের বাণিজ্য কম করে হলেও দুই যুগ আগের। শুরুতে কয়েকজন ব্যবসা শুরু করলেও এক দশক আগে ভোলাবো এলাকায় ঘরে ঘরে পোল্ট্রি শিল্প গড়ে উঠে। একসময় ভোলাবোতেই গড়ে উঠে ৪০০ পোল্ট্রি খামার। কয়েক বছর আগে হঠ্যাৎ বার্ড ফ্লু নামক ঝড় এসে এক ধাক্কায় এ সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২৫০-তে। এবার করোনার ঝড়ে কতটুকু টিকবে সেটা নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সন্দিহান।
খামারী মালিকরা বলেন, করোনার প্রভাবে পোল্ট্রি মুরগির বিকিকিনিতে এক প্রকার ধ্বস নেমেছে। বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা প্রভাবে পোল্ট্রি মুরগির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সাধারণ ক্রেতারা পোল্ট্রি কেনা থেকে বিরত থাকছেন। ফলে খামারীরা উৎপাদিত মুরগীর দাম পাচ্ছেন না। ছোট ছোট খামারীরা ইতোমধ্যে উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। বড় ব্যবসায়ীরা উৎপাদন প্রক্রিয়া সচল রাখতে রীতিমত হিমসিম খাচ্ছেন। খামারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানকার ব্রয়লার-লেয়ার মুরগী ও উৎপাদিত ডিম ডাঙ্গা পোল্ট্রি শিল্প মালিক সমিতির মাধ্যমে রাজবাড়ি, ভৈরব, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাইকারী যায়।
শীতলক্ষ্যা পোল্ট্রি খামারের মালিক মনির হোসেন বলেন, ভোলাবোর ২৫০ খামার থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক লাখ কেজি ব্রয়লার মুরগীর মাংস উৎপাদিত হয়। এক কেজি ব্রয়লার মুরগীর মাংস উৎপাদনে খরচ হয় ৭৫ টাকা। বর্তমানে বাজার পড়ে যাওয়ায় প্রতি কেজি ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর লেয়ার (কক}মুরগীর মাংস উৎপাদিত হয় প্রায় ৩ লাখ কেজি। ডিমের বাজারও পড়তির দিকে বলে জানান তিনি।
স্থানীয় খামারীরা জানান, ভোলাবোতে প্রতিদিন এক লাখ ডিম উৎপাদিত হয়। প্রতিটি ডিম উৎপাদনে খরচ পড়ে সাড়ে সাত টাকা। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ছয় টাকা। আগে প্রতিটি ডিম বিক্রি করা যেতো ৮ টাকায়। সে হিসাবে এক লাখ ডিম বিক্রি হতো ৮ লাখ টাকা। যা মাসে গিয়ে দাঁড়ায় ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ চিত্র শুধু এক ভোলাবো ইউনিয়নের। এছাড়া উপজেলার আরো শতাধিক খামারে মাংস ও ডিম উৎপাদিত হয়।
লোকসানের কারণে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হয়েছে বলে জানিয়েছেন শীতলক্ষ্যা পোল্ট্রি খামারের মালিক মনির হোসেন দেওয়ান। তিনি এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের আশু সুদৃষ্টি কামনা করেছেন। ভাই ভাই পোল্ট্রি খামারের মালিক আলমগীর হোসেন দেওয়ান বলেন, ভোলাবোর পোল্ট্রি খামারের ডিম সারাদেশে যায়। আগে প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ ডিম পাইকারী যেতো। এখন করোনার প্রভাবে ২০ থেকে ২৫ হাজার ডিম বিক্রি হয়। তা-ও অনেক কষ্টে বলে-কইয়ে দিতে হয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে এখানকার পোল্ট্রি খামারী মালিকদের পথে বসতে হবে। বিশ্বাস পোল্ট্রি খামারীর মালিক শফিকুল ইসলাম বলেন, বার্ড-ফ্লু আইসা একবার বড় ক্ষতি করে গেছে। এবার করোনা আইসা আরো ক্ষতি কইরা দিলো। পাইকরা ডিমও নিতে চায়না, মুরগীও নিতে চায়না। উত্তরপাড়া এলাকার পোল্ট্রি খামারী শাহীন মিয়া বলেন, আমরা ছোট ব্যবসায়ী। করোনার কারণে মুরগী এখন বিক্রি হয় কম। তাই প্রতিদিনই জ্জ টা মুরগী জবাই করে নিজেরাও খাই, আবার আত্মীয়স্বজনকে দেই। যতোদিন করোনা থাকবো তকোদিন আর বাচ্চা তুলবোনা।
ভোলাবো ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন বলেন, রূপগঞ্জে অর্থনীতির চাকা সচল রাখে জামদানি শিল্পের পরে এ পোল্ট্রি শিল্প। অথচ এ শিল্পের দিকে কারো কোন নজর নেই। শিল্পটি আজ ধ্বংসের মুখে। রূপগঞ্জের বরপা লাইফ এইড হাসপাতালের পুষ্টিবিদ ডা. আফরুন্নেছা মুনা বলেন, পোল্ট্রির মাংস ও ডিম খেলে কোনো ক্ষতি নেই; বরং উপকার। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু লোক পোল্ট্রির মাংস ও ডিম নিয়ে যে অপপ্রচার চালাচ্ছে তার কোনো ভিত্তি নেই। তিনি সবাইকে দুধ, ডিম, মাছ, মাংস খাওয়ার পরামর্শ দেন।
রূপগঞ্জ উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. জাহাঙ্গীর আলম রতন বলেন, ভোলাবো পোল্ট্রি শিল্প দু’দশকের। এখানকার হাজার-হাজার মানুষ এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন এ শিল্পে। নানা কারণে শিল্পটি আজ ধ্বংসের পথে। করোনা এখানকার ব্যবসায়ীদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মমতাজ বেগম মম বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। যেহেতু এ শিল্প রূপগঞ্জের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির চাকা ঘুরায়, সেহেতু সবার উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। ###
তারিখ :১৩.০৪.২০ ইং
মুরাদ হাসান
রূপগঞ্জ প্রতিনিধি।