পরীক্ষা শুরু হয়েছে বেশ কয়েক মিনিট হলো,
হঠাৎ দরজার কাছে থেকে একটি আওয়াজ আসলো, আসতে পারি স্যার?
হুমম! এসো, ভেতর থেকে স্যারের উত্তর আসলো।
কি বাবা দেরি কেন? এতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় দেরি করে আসলে হবে? সবাই হাসাহাসি করতে লাগলো, বোধয় সেই হাসিতে একটু ব্যঙ্গ ছিলো।সাকিব কিছুই বললো না, নিজের জায়গা খোঁজা শুরু করতেই, শেষের দিকের বেঞ্চ থেকে একটি মেয়ে ডাক দিলো, এখানে বোধয় আপনার সিট!
পুরো শ্রেণিকক্ষে সেই একটি সিটই ফাঁকা ছিলো, তাই বুঝতে পারাটা খুবই স্বাভাবিক। সাকিব আর সময় নষ্ট না করে গিয়ে বসলো নিজের যায়গায়।স্যার এসে প্রশ্ন এবং উত্তরপত্র দিয়ে গেলেন এবং বলে গেলেন, বাবা বেশি চিন্তা করো না আর যেটুকু পারো তার উত্তর করো।কিন্তু সাকিবের মাথা থেকে তো কিছুতেই চিন্তা বের হতে চাচ্ছে না।আর প্রশ্ন পাওয়ার পর মনে হচ্ছে সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে, সাকিবের মনে হলো তার জানা প্রশ্ন গুলোও সে পারছে না।কোনমতে শেষ হলো পরীক্ষা।
পরীক্ষা শেষে পাশের সিটে বসা মেয়েটি বললো, কী ব্যাপার আপনাকে অনেক চিন্তিত দেখাচ্ছে, আর একটা ধন্যবাদও তো দিলেন না সিট খুঁজে দেওয়ায়। সাকিব মৃদুস্বরে বললো দুঃখিত! ধন্যবাদ আপনাকে, বলতেই সাকিবের চোখের কোণ দিয়ে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।আর ওখানে থামলো না, দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল সে।মেয়েটি একটু অবাক হলো, আর হওয়াটাই স্বাভাবিক।
বাইরে বেরিয়ে সাকিব খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লো, কি হবে এবার! বাড়িতে গিয়ে কি বলবো? একটি শঙ্কা কাজ করতে লাগলো সাকিবের মনে।করবেই না কেন! এটা তো আর সাধারণ পরীক্ষা নয়, এটা ভর্তি পরীক্ষা। এর আগে কয়েক যায়গায় পরীক্ষা দিয়েছে সাকিব কোথাও উত্তীর্ণ হতে পারেনি।এটাই শেষ পরীক্ষা ছিল।
পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরতেই সাকিবের বাবা প্রশ্ন করলেন, কেমন হয়েছে পরীক্ষা?
হয়েছে মোটামুটি, উত্তর দিলো সাকিব। মোটামুটি মানে! একরকম ধমক দিয়েই বললেন সাকিবের বাবা!
সাকিব বলল, বাবা যাওয়ার সময় রাস্তায় একটু সমস্যা হয়েছিলো, তাই পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে একটু দেরি হয়ে গেছে।
সাকিবের বাবা বললেন, মনে রেখো ইন্জিনিয়ারিং এ চান্স না পেলে তোমার পড়াশোনা বন্ধ!
সাকিবের মা বললেন, হাত-মুখ ধুয়ে আয় বাবা খেয়ে নে। ক্ষিদে নাই মা এখন খাবো না, বলে হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে চলে গেল সাকিব।একটু পর রিয়ার কল আসলো, সাকিব পরীক্ষা কেমন দিলে? হয়েছে মোটামুটি, তোমার? হুমম খুব ভালো হয়েছে, বললো রিয়া।রিয়া আর সাকিবের সম্পর্ক প্রায় দুই বছরের, আচ্ছা রিয়া পড়ে কথা হবে, বলে ফোনটা রেখে দিলো সাকিব।
সাকিব ভাবতে লাগলো কি করবে এখন, সে কখনই ইন্জিনিয়ার হতে চাইনি, ছোটবেলা থেকেই ওর সাহিত্য ভালো লাগতো, কিন্তু ওর বাবা একপ্রকার জোর করেই ওকে এসএসসি ও উচ্চ মাধ্যমিকে সাইন্স নিতে বাধ্য করেছিলেন।মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও সাকিবকে মেনে নিতে হয়েছে।পড়াশোনায় বরাবরই ভালো সাকিব, এসএসসি ও এইচএসসি তে জিপিএ -৫ পেয়েছে।এরই মধ্যে তার লিখা কয়েকটি কবিতা ও গল্প প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায় কিন্তু বাবাকে সাহস করে বলতে পারনি।সাকিব একদিন বাবাকে বলল, বাবা আমি এতো চাপ নিতে পারছি না।বাবা বেশ কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিলো ওকে।
এরই মধ্যে চলে আসলো ফল প্রকাশের দিন।সাকিব উদাসিন মনে অপেক্ষা করছে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের। বাবা কি সত্যিই আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দিবে? এমন চিন্তা করছে সে।ফলাফল প্রকাশিত হলো, সাকিব এবারো উত্তীর্ণ হতে পারে নি। একটু পড়েই বাবা এসে যাচ্ছেতাই বলে গেল সাকিব কে! একটু পর ফোন আসলো রিয়ার, সাকিব আমি চান্স পেয়েছি, তোমার কি খবর? সাকিব মৃদুস্বরে বললো ওহ্, অভিনন্দন রিয়া! হুমম, ধন্যবাদ। তোমার কি খবর বলো! আমি চান্স পাইনি রিয়া, একটু কান্নার স্বরে বললো সাকিব। ওহ্, আচ্ছা সাকিব! পরে কথা হবে আম্মু ডাকছে, বলে ফোন রেখে দিলো রিয়া! হয়তো সাকিব ওকে কিছু বলতো কিন্তু আর বলার সুযোগ পেল না! বিকেলে একটু বাইরে ঘুরতে বের হলো সাকিব, ঘরের মধ্যে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল৷ কিন্তু বাইরে বের হয়ে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা অর্জন করলো সে, এতোদিন যারা সাকিবকে ভালো ছাত্র বলে প্রশংসা করতো তারাই আজ ওকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছে।প্রায় সকল সহপাঠীই চান্স পেয়েছে।সবাই ব্যস্ত মিষ্টি খাওয়া নিয়ে, এদিকে দুইদিন হলো রিয়া কল দেয়নি, এবং সাকিব ফোন দিলেও ধরছে না। অবশেষে ফোন ধরে বললো, আমাকে আর কল দিয়ো না সাকিব আর যোগাযোগও করার চেষ্টা করো না,বলেই ফোনটা রেখে দিলো রিয়া, কিছু বলার সুযোগও দিলো না।চারপাশের মানুষের এমন অবহেলায় দম বন্ধ হয়ে আসছিলো তার! আপন মানুষ গুলোও এমন খারাপ আচরণ করছে।
বাস্তবতা টা বুঝতে কোন ভুল হলো না সাকিবের! মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, সেকেন্ড টাইম পরীক্ষা দিবে এবং নিজের একটা পরিচয় তৈরী করবে।বাবা কে বলল বাবা আমি আবার পরীক্ষা দিতে চায়, বাবা প্রথমে না বললেও পরে রাজি হলো।
শুরু হলো সাকিবের নতুন জীবনযুদ্ধ।
বছর ঘুরে ভর্তি পরীক্ষার সময় এলো, পরীক্ষাও সম্পন্ন হলো। এরপর আসলো ফলাফল প্রকাশের দিন।সকাল থেকে সাকিব একটু উত্তেজিত।তবে দুশ্চিন্তা আগের মতো নেই কারণ তার যে হারানোর মতো কিছুই নেই।
ফলাফল প্রকাশ হলো, হ্যাঁ সাকিব এবার ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।ভর্তি হলো নিজের পছন্দের বিষয় বাংলা সাহিত্যে।বাবা কে না জানিয়েই বাংলা সাহিত্যে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল সে।
বাবা এবার আর বকা দিলেন না।ভর্তি হয়েছে মাস খানেক হলো, একদিন সাকিব শুয়ে আছে বিছানাই, তার বাবা এসে ওর হাত দুটো জরিয়ে ধরে বললো বাবা সাকিব! তুই আমাকে ক্ষমা করে দে! না বুঝে নিজের ইচ্ছাটা তোর ওপর চাপিয়ে দিয়ে তোর জীবনটা ধ্বংস করে দিতে লেগেছিলাম, এখন তোর যা মন চাই তাই করবি আমি কোন বাধা দিবো না বাবা।সাকিব বলল, বাবা এসব কি বলছো, আমি তোমার সন্তান.. তুমি আমার জন্য সবসময় ভালোটাই চেয়েছো, হয়তো আমার মনের বিরুদ্ধে।তুমি শুধু আমার জন্য দোয়া করবে।বলে দুজনেই বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো।
এখন আর কেউ সাকিবের দিকে বাকা চোখে তাকাই না।কারণ সাকিব আজ একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সবার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে সে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে।কিন্তু সাকিব ঠিকই বুঝতে পেরেছে জীবন বাস্তবতা।
লেখক: মোঃ তুষার আলী
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়