ছোটগল্পঃ মায়ার বাঁধন
মোঃ তুষার আলী
সকাল বেলা রাজা নিজেকে আবিষ্কার করলো রেল স্টেশনের পাশে। অবশ্য এটা ওর প্রায় নিয়মিত রুটিন।বেশিরভাগ রাতই তার এই স্টেশনে কাটে।মাঝে মধ্যে পাশের বস্তিতে যায়।সেখানে এক বৃদ্ধা মহিলাকে নানি ডাকে সে।রক্তের কোন সম্পর্ক নেই অবশ্য। বৃদ্ধা মহিলার নাকি রাজার মতো একটা নাতনি ছিলো, তবে উনার ছেলে তাকে একা রেখে বউ, বাচ্চা নিয়ে বিদেশে গিয়েছে।ফেলে রেখে গিয়েছে একা।
খোঁজ খবরও তেমন নেয়না।রাজাকে দেখলে নাকি উনার নাতনির কথা মনে পড়ে।তাই অনেক স্নেহ করে রাজাকে।মাঝে মধ্যে সে বৃদ্ধার সাথে দেখা করতে যায়।বৃদ্ধা রাজার নাম রেখেছেন মানিক।অবশ্য নামটা ভালোই লাগে ওর।এই পৃথিবীতে আপন বলতে যে রাজার কেউ নেই থাকা বলতে এই নানি আর স্টেশনে থাকা কুকুরগুলো।রাজা নিজেকে কুকুরগুলোর সরদার ভাবে।কারণও রয়েছে, ও যখন স্টেশনে যায় তখন তার চারিদিকে কুকুরগুলো গোল হয়ে বসে পরে। রাজা মাঝে মধ্যে ওদের পাউরুটি খাওয়ায়।তাই বোধয় ওর প্রতি কুকুরগুলোর এতো ভক্তি।কাছে পেলেই ওর গাল চেটে দেয়, অঙ্গভঙ্গি দ্বারা একটা ভক্তির ভাব প্রকাশ করে।রাজা তার মা-বাবাকে কখনো দেখেনি।ছোটবেলা থেকেই সে স্টেশনে থাকে, যখন ওর একটু বুদ্ধি হয় তখন থেকে ও এভাবে দিন যাপন করে আসছে। রাজার বয়স চৌদ্দ-পনেরো বছর হবে। রাজা নামটা ওর নিজের দেওয়া।
ছোটবেলায় এক বুড়ির কাছে রাজা-বাদশার গল্প শুনতো সে।নিজেও রাজা হতে চাইতো।তাই নাম রেখেছে রাজা। অবশ্য ওকে ছোটবেলায় যে বুড়িটা মানুষ করেছেন তিনি বছরখানেক হলো পৃথিবী থেকে গত হয়েছেন।রাজা পেটের জন্য যখন যে কাজ পায় সে কাজই করে।তবে ও অনেকটা ভবঘুরে টাইপের।মাঝে মধ্যেই যেখানে ভালো লাগে সেখানে চলে যায়।কিছুদিন ঘুরে আবার সেই চিরচেনা স্টেশনে ফিরে আসে।অবশ্য এতে তাকে অসুবিধায় পড়তে হয়।ওর শিস্য অর্থাৎ কুকুরগুলো অনেক নালিশ করে। এতো দিন সে কোথায় ছিলো, কেন তাদের আদর করেনি, কেন ওদের জন্য খাবার নিয়ে আসেনি, এসব আরকি।রাজা একটু মুচকি হেসে ওদের আদর করে দেয় তাতেই ওরা আবার আগের মতো হয়ে যায়।রাজা হয়তো কুকুরগুলোর ভাষা বুঝতে পারে। বেশ কয়েকদিন এখানে ওখানে ঘুরে গতরাতে ফিরেছে সে।মন চাইলো একটু তার নানির সাথে দেখা করবে।গিয়ে দেখলো মাস খানেক আগে সে যেই গোলাপ ফুলের গাছটা লাগিয়েছিলো সেটাতে ফুল ফুটেছে।বেশ সুন্দর লাগছে অবশ্য।অবশ্য ওর কাছে সবই সুন্দর লাগে।রাতে স্টেশনে ফিরলো।রাত বারোটার দিকে দেখলো একটি বাচ্চা মেয়ে বয়স হয়তো পাঁচ-ছয় বছর হবে, বসে বসে কান্না করছে।কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে মেয়েটি বললো সে বাবা-মার কাছে যাবে।সে নাকি হারিয়ে গেছে।রাজা বললো আমি তোর মা-বাবাকে খুঁজে দিবো কাঁদিস না।রাজা মেয়েটিকে রাজকুমারী বলে ডাকে।এতদিনে সে একটি বোন পেয়েছে।
এতোদিন রাজার কেউ ছিলো না, এখন একটা বোন হয়েছে।তাকে ভালো রাখতে হবে।এই নিয়ে যেন তার হাজারো ব্যস্ততা।কিভাবে রাজকুমারীকে ভালো রাখা যায়।সে রাতে কিছু খাবার ছিলো সেগুলো খাওয়ালো তারপর কুকুরগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।গান শুনিয়ে বোনকে ঘুমিয়ে দিলো রাজা।পরেরদিন খোঁজ করে কোন সন্ধান পেল না রাজকুমারীর মা-বাবার।এভাবে মাস খানেক পার হলো। রাজকুমারীকে সবসময় সাথেই রাখে রাজা।যেখানেই যাক না কেন ওকে সাথে নিয়ে যায়।মাত্র কয়েকদিনে অনেক আপন হয়ে গেছে দুজন দুজনের।রাজকুমারীর মুখে ভাই ডাকটা শুনতে ভালোই লাগে রাজার।ভবঘুরে স্বভাবটা এখন আর নেই রাজার।কারণ এখন যে তার একটা বোন আছে, তিনবেলা ওকে খাবার খাওয়াতে হবে।তার জন্য কাজ কর্মও করা লাগবে।একদিন সকাল বেলা ঘুমথেকে উঠে অন্য এক অভিজ্ঞতা অর্জন করলো রাজা।একজন মহিলা ও পুরুষ দাড়িয়ে আছে, সঙ্গে পুলিশও আছে।
তারা নাকি রাজকুমারীর মা-বাবা ওকে নিতে এসেছে।রাজার বুকটা অজানা কোন কারণে কেঁপে উঠলো।অসহ্য এক যন্ত্রনা অনুভব করতে লাগলো।রাজকুমারীকে যেতে দিতে ইচ্ছে করছেনা ওর।কিন্তু রাজকুমারী তো ওর আপন কেউ না, আবার সে কি পর কেউ? জানতে পারলো ওর নাম মিম, দূর্ঘটনা বশত স্টেশনে সে হারিয়ে গেছিলো।অনেক খোঁজ করেও ওকে পাইনি।তারপর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলো ওর বাবা, গতকাল তাকে একজন লোক ফোন দিয়েছিলো, বলেছিলো স্টেশনে আছে উনার মেয়ে।খোঁজ পেয়ে এখানে এসেছেন।যাওয়ার সময় গলাধরে অনেকে কেঁদেছে রাজকুমারী।আস্তে আস্তে যত দূরে যাচ্ছে ততই দুচোখ বেয়ে পানি অঝর ধারায় গড়িয়ে চলেছে রাজার চোখে।রক্তের সম্পর্কের বাইরেও যে মানুষের সম্পর্ক হয়, নিঃস্বার্থ ভাবে কাউকে ভালোবাসা যায়, অচেনা একটা মেয়েকে নিজের ছোট বোন ভাবা যায় তা আজ রাজা বুঝতে পারছে।আর হয়তো কখনো বোনের সাথে ওর দেখা হবে না।ওর কান্না দেখে কুকুরগুলোও কাঁদছে।এই সম্পর্ক যে মায়ার বাধনে সৃষ্টি।
লেখক : শিক্ষার্থী
রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ , রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়