আন্তর্জাতিক ডেস্ক: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল বলা যায় কি না’— সেই প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ১০ মাস হয়ে গেলেও জুলাইয়ের হত্যাকাণ্ডের জন্য দলটির কেউ দুঃখ প্রকাশ করেনি। উল্টো ভারতে বসে সাবেক স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উসকানি দিচ্ছেন।
প্রফেসর ইউনূস আরও জানিয়েছেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে আশা তার।
বুধবার (১১ জুন) যুক্তরাজ্যের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউজের রয়্যাল ইন্সটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স আয়োজিত সংলাপে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন প্রফেসর ইউনূস।
এতে তিনি আরও জানান, আগামী জুলাইয়ে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিতে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করা হবে এবং এটির ভিত্তিতেই আগামী নির্বাচন হবে।
অনুষ্ঠানে জুলাই ঘোষণাপত্রের জন্য দলগুলোকে এক করার বদলে ভোটারদের ওপর আস্থা রাখা হচ্ছে না কেন কিংবা জনগণকে সুযোগ না দিয়ে যে ঐকমত্যের কথা বলা হচ্ছে, সেটি কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপ কি-না, এমন প্রশ্নও করা হয়েছিল অধ্যাপক ইউনূসকে।
সম্মেলনে তাকে একজন প্রশ্ন করেন, “এপ্রিলের শুরুতে নির্বাচন ঘোষণা করেছেন আপনি। এ নিয়ে অনেক বিতর্ক। সেনাবাহিনী ও কিছু রাজনীতিকরা এ বছরের মধ্যে নির্বাচন চান। আওয়ামী লীগ দল ও শেখ হাসিনা নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে নিষিদ্ধ- যেটা অন্যতম বড় দল। সব মিলিয়ে অনেকেই বলছেন, নির্বাচনটি সুষ্ঠু হবে না”
জবাবে প্রফেসর ইউনূস বলেন, “আমার মতে এটি হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন। এটির সময় সঠিক ও জনগণ প্রস্তুত। যখন আপনি বহু বছর পর একটি নির্বাচন করছেন, ১৭ বছর পর আপনি একটি সত্যিকার নির্বাচন পাচ্ছেন। দেশে উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে যে ভোটাররা সত্যিই ভোট দিতে যাচ্ছেন”
তিনি আরও বলেন, “গত ১৭ বছরে ভোট দেওয়ার বয়স যাদের হয়েছে, তারা তাদের প্রথম ভোটটি দিতে পারেনি। তারা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছে ভোট দেওয়ার জন্য। তাদের কণ্ঠকে কখনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সেই উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে, যেটাকে আমরা বলছি যে নতুন বাংলাদেশ”।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আগামী নির্বাচনটি শুধুমাত্র নতুন সরকার নির্বাচনের জন্য সাধারণ ভোট নয়, এটি নতুন বাংলাদেশের জন্য ভোট।”
“আমরা এই অঙ্গীকারই করেছি, যেসব তরুণরা জীবন দিয়েছে তাদের স্বপ্নকে সম্মান করব। তাদের স্বপ্ন অনুযায়ী আমরা পুরোনো বাংলাদেশকে বিদায় বলে নতুন বাংলাদেশ তৈরি করতে চাই”— যোগ করেন ড. ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টা জানান, নতুন বাংলাদেশের জন্য তারা তিনটি বিষয় চিহ্নিত করেছেন। এর একটি হলো সংস্কার। আর তাদের লক্ষ্য হলে সবদিকে সংস্কার করা।
তিনি বলেন, “আমরা সব প্রতিষ্ঠানে সংস্কার করতে চাই। সেজন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কমিশন করেছি। যাতে মৌলিক পরিবর্তন করা যায়। অনেক সুপারিশ এসেছে। নির্বাচন, সংসদ, সংবিধান, সিভিল সার্ভিসসহ সবকিছু। আমাদের কাজ হলো সব দলের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা”
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “কখনো শুনেছেন এমন কমিশনের কথা? তারা সবার সাথে আলোচনা করে ঠিক করবে সব দল কোন সুপারিশগুলো গ্রহণ করবে। এটা কঠিন কাজ যে, বাংলাদেশের রাজনীতিক ও দলগুলোর একমত হওয়া”।
প্রশ্নকারী এ সময় বলেন, আমি বলবো রাজনীতিকদের জন্য একমত হওয়া কঠিন। দলগুলো তো বলতে পারে যে এটার মধ্যে গণতান্ত্রিক উপাদান নেই। আপনি ভোটারদের ওপর আস্থা রাখছেন না কেন। সংস্কার কমিশন বা রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের বদলে ভোটারদের ভোটের মাধ্যমে সংস্কার গুলো করা হচ্ছে না কেন।
জবাবে তিনি বলেন, “এমনটা যদি আমরা পারতাম তাহলে ভালো হতো, কিন্তু অনেক জটিল বিষয় রয়েছে। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো সব দলের সম্মতিতে পাওয়া সুপারিশগুলো আলাদা করা এবং এরপর সব দলের সাক্ষরের মাধ্যমে এটি উপস্থাপন করা। জুলাই ঘোষণাপত্র জাতির কাছে উপস্থাপন করা হবে এবং তার ভিত্তিতে নির্বাচন হবে,”
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, সংস্কার, সব অপরাধীর বিচার এবং তৃতীয়টি হলো নির্বাচন- এই তিনটি হলো তাদের দায়িত্ব।
‘আওয়ামী লীগ কি একটি রাজনৈতিক দল?’
অপর এক প্রশ্নকারী তাকে প্রশ্ন করেন “সমালোচকরা বলতে পারে যে কোনো দল ঘোষণাপত্রের সাথে একমত নাও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ আওয়ামী লীগ। সুতরাং আপনি সত্যিকারভাবে জনগণ তাদের সিদ্ধান্ত জানানোর কোন সুযোগ দিচ্ছেন না। এটা তো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। এটা ঐকমত্য নয়, এটা আজকের বাংলাদেশে এটা কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপ”
জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “সেই বিতর্কও আছে। বিতর্ক হলো আওয়ামী লীগ কি একটি রাজনৈতিক দল? তারা কী এভাবে তরুণদের রাস্তায় খুন করতে পারে? এভাবে গুম করতে পারে? এভাবে টাকা চুরি করতে পারে? এখনো কী তাদের রাজনৈতিক দল বলবেন আপনি? এটা কোন জাজমেন্ট নয়, এটা বিতর্ক।”
তিনি বলেন, “ইস্যুটি হলো ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালালো। জনগণ উৎসব করলো যে তারা এখন মুক্ত। প্রধানমন্ত্রীর বিদায়ের পর ভেবেছিলাম যে ওই পর্ব শেষ। কিন্তু যারা পালিয়ে গেছে তারা সেটি অব্যাহত রেখেছে। অন্য দেশ থেকে জনগণকে উস্কানি দেওয়া, রাস্তায় নামা… দশ মাস হয়ে গেলো দলটির কেউ এখনো দুঃখ প্রকাশ করেনি। বলেনি যে না, আমি এর জন্য দায়ী নই। কারও আদেশে কেউ মারা গেছে। আমি খারাপ বোধ করছি যে আমি এর অংশ ছিলাম, কেউ বলেনি।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের মিছিল ও অভ্যুত্থানের নেতাসহ অন্যদের হুমকি-ধামকি দেওয়ার কারণে আমরা নিরাপদ বোধ করছি না। আওয়ামী লীগ অভ্যুত্থানের নেতাদের হুমকি দিচ্ছে। তাই জাতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে দেশ ও রাজনীতির নিরাপত্তার জন্য একটি সময়ের জন্য আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত থাকবে, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত। তাদের নিষিদ্ধ করা হয়নি”।
কিন্তু বিচারের বিষয়টি কেন পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের হাতে দেওয়া হচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকার কেন এটি করছে-এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “যারা আমাদের সরকারে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, তারা আমাদের বিচারের দায়িত্ব দিয়েছে। তারা তিনটি দায়িত্ব দিয়েছে। আমরা সেটি গ্রহণ করেছি। সেজন্যই আমরা এগুলো করছি।”
সংলাপে ভারত ও চীনের সাথে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন আসলে তিনি জানান, সব সরকারের কাছ থেকেই তিনি সমর্থন পেয়েছেন।
ভারত ও শেখ মুজিবের বাড়ির প্রসঙ্গ
প্রধান উপদেষ্টা জানান, মাসের পর মাস নিষ্ঠুর ঘটনার পর ৫ই অগাস্ট এসেছে। সব ক্ষোভ এখন চলে গেছে ভারতে। কারণ শেখ হাসিনা সেখানে অবস্থান করছেন।
“আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বলেছি, আপনি তাকে রাখতে চাইলে রাখেন। কিন্তু আমাদের সহায়তা করুন। তিনি যেন বাংলাদেশী জনগণকে উদ্দেশ্য করে কিছু না বলেন। কারণ তিনি কথা বলছেন আর পুরো বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ হচ্ছে। মোদি বলেছেন, এটা সামাজিক মাধ্যম, আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। সেটা এখনো চলেছে”।- বলেন ড. ইউনূস।
সম্মেলনে একজন প্রশ্নকারী প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশ্যে বলেন, “৮ই আগস্ট আপনি বলেছিলেন যে, সবাইকে এক করা আপনার চ্যালেঞ্জ। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ধ্বংস হলো ছয় ঘন্টায় সিটি কর্পোরেশনের বুলডোজার দিয়ে। প্রশাসন নিরব ছিলো। এর ভিত্তিতে আপনি বিভাজন করছেন বা তাদের বাদ দিয়ে আপনি ঐক্য কীভাবে করবেন”?
জবাবে তিনি বলেন, “তখন অনেক প্রশ্ন ও ইস্যু সব একসাথে এসেছিলো এবং তখন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো। তাৎক্ষণিকভাবে আমরা সব সামাল দিতে পারিনি। আমরা এমন একটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি।” তিনি আরও বলেন, “এখন পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে। শৃঙ্খলা আনাটাই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ। কারণ, আমরা যে পুলিশ পেয়েছিলাম, যারা শিশুদের গুলি করেছিল, তারা হঠাৎ করে রাস্তা ফাঁকা করতে বললে, চলে যেতে বললে মানুষ প্রশ্ন করে, ‘আপনি কে?’ তারা আপনাকে (পুলিশকে) পেটাবে। তারা পুলিশকে বলবে, তুমি আমার ছেলেকে মেরেছ, তুমি আমার ভাইকে মেরেছ, আমার বোনকে মেরেছ। এখন তুমি আমাকে বলছ আমি কী করব?”
প্রধান উপদেষ্টা জানান পুলিশ তখন রাস্তায় নামতে ভয় পেয়েছে। তিনি বলেন “আমরা তখন একটা রুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম। আমরা জানতাম না কীভাবে এটাকে সামাল দেব। এখন আস্তে আস্তে পরিস্থিতি ঠিক হয়ে আসছে। যারা অপরাধের সাথে জড়িত ছিলো তাদের চিহ্নিত করে বাহিনী থেকে সরানো হয়েছে। এখন পুলিশ দেশে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে।”