1. abrajib1980@gmail.com : মো: আবুল বাশার রাজীব : মো: আবুল বাশার রাজীব
  2. abrajib1980@yahoo.com : মো: আবুল বাশার : মো: আবুল বাশার
  3. farhana.boby87@icloud.com : Farhana Boby : Farhana Boby
  4. mdforhad121212@yahoo.com : মোহাম্মদ ফরহাদ : মোহাম্মদ ফরহাদ
  5. shanto.hasan000@gmail.com : রাকিবুল হাসান শান্ত : রাকিবুল হাসান শান্ত
  6. masum.shikder@icloud.com : Masum Shikder : Masum Shikder
  7. shikder81@gmail.com : Masum shikder : Masum Shikder
  8. riyadabc@gmail.com : Muhibul Haque :

“নরসুন্দা নদীতে শৈশবের সাঁতারের দিনগুলি” কলমেঃ আবুল বাশার রাজীব

  • Update Time : সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০
  • ১৪০০ Time View

তখন আমি অনেকটাই ছোট

বয়স হবে হয়ত দশ-এগারো কিংবা বারো-তের সঠিক মনে করতে পারছিনা । তখনও  সাঁতার জানিনা। সাঁতার শেখার খুব ইচ্ছা। আমাদের কিশোরগঞ্জের নরসুন্দর নদী তখন হোসেনপুরের ব্রক্ষ্মপু্ত্রের সাথে সংযুক্ত ছিল। পানি ছিল স্বচ্ছ, টলটলে ও পরিষ্কার। মোটামুটি ঢেউও থাকত মুক্ত বাতাস ও কিছুটা স্রোতের জন্য। মাছ শিকারীরা বিভিন্ন মাছা বেঁধে মাছ ধরত বর্শি দিয়ে। আর মাছা নদীর পাড় থেকে ২৫-৩০ ফুট  দূরে থাকায় মাছায় আসা-যাওয়ার জন্য কচুরিপানা দিয়ে ভেলা বানিয়ে রাখত। কচুরিপানা রোদে শুকিয়ে গেলে বেশ শক্ত হত এবং ভেলায় উঠলে ডুবতনা। তারপরও প্রতিদিন নতুন নতুন কচুরিপানা দিয়ে ভরাট করে এটাকে মডিফাই করা হতো।

কচুরীপানা দিয়ে বানানো ভেলা

তখনকার সময় আমাদের এলাকায় গুজব প্রচলিত ছিল গাঙ্গের(নদীর) গভীরে ও কাঁচারী মসজিদ ঘাটের নীচে অদ্ভুদ সব প্রানী আছে। যেমনঃ জিঞ্জির, ডেগ(হাড়ি), সোনার তরী সোনার বৈঠা ইত্যাদি। পানিতে নামলে পায়ে প্যাচ দিয়ে গভীর তলদেশে নিয়ে ডুবিয়ে মারবে। ইয়া বড় বড় গজার মাছ আছে যেগুলো আসলে জীন-ভুত; তারা মাছ সেজে ঘুরে বেড়ায় এবং সুযোগ পেলেই ঘাড় মটকে দেয়। আর যারা এক বাপের এক সন্তান তাদের তো পানিতে নামাই বারণ ছিল। তাই এসব গল্প শুনে শুনে ভয়ে নদীর পানিতে নামতে সাহস হতোনা। কেবল পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যারা সাঁতরে নদীর মাঝখানে যেত তাদের সাঁতার কাটা দেখতাম, আর মনে মনে আফসোস করতাম কবে যে আমিও সাঁতরে মাঝ নদী থেকে ঘুরে আসব। তাই আমরা যারা সাঁতার জানতামনা; তারা  সাঁতার কাটতাম  নদীর সাথে লাগানো ছোট্ট পুকুরটিতেই এবং ওটাকে আমরা বলতাম ছোট গাঙ। সেই ছোট্ট গাঙে গোসল করেই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাতাম।  এই পুকুরে বালি থেকে বুদবুদ বা ভুরভুর করে পানি উঠত। এই বালিতে কোন কাদা ছিলনা। অনেকেই এখনো মনে করে এই পুকুরের নীচে কোন খনিজ সম্পদ অাছে। আর আমরা মনে করতাম পুকুরের নীচে সেই অদ্ভুদ প্রানীগুলো বা কোন  দৈত্য-দানব থাকায় হয়ত এমনটি হয়। যাইহোক, আমরা তখন দুই হাতে মাটিতে ভর দিয়ে হাটু পানিতে সাঁতার শিখতে চেষ্টা করতাম। আর যদি বড় কেউ সাথে থাকত তবেই একটু বেশি পানিতে মানে মূল নদীতে গিয়ে সাঁতার কাটতাম। আর বড়দের বকা-ঝকা খেতাম। তোরা এখানে কি করিস ছোট গাঙে গিয়ে সাঁতার কাট যত ইচ্ছা।  তাই নদীর মাঝখানে যাওয়ার সুপ্ত একটা ইচ্ছা অপূর্ণই ছিল।

এক সময়ের খরস্রোতা নরসুন্দা নদীতে পাল তোলা নৌকা

একদিন সেই সুযোগ পেয়ে গেলাম। আমার সমবয়সী বন্ধু মাসুদ কাকা আর আমি দুজনেই সাতার জানিনা তখন, আমাদের চেয়ে কয়েক বছরের সিনিয়র দুইজন সাতার জানা বড় ভাই জাহাঙ্গীর ভাই ও ঈদু কাকার সাথে কচুরিপানা দিয়ে তৈরী একজন মাছ শিকারীর গোলাকার ভেলায় করে ঢেউয়ের অনুকুলে বাঁশের কঞ্চি/খুটি দিয়ে বৈঠা মেরে মেরে ভেসে ভেসে পার হয়ে গেলাম  মাঝনদী। ঠিক সেসময় কঞ্চিটা/খুটিটা অজান্তেই  হাত থেকে ছিটকে গিয়ে দূরে চলে যায়।হাতের আর  কাছে খুজে পাওয়া গেলনা। পরিকল্পনা ছিল ওপার থেকে ঘুরে আসা। খুটিটি হারিয়ে যাওয়ায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেই। আমরা তখন ঢেউ প্রতিকূল থাকায় কিছুটা ভয়ও পেয়ে গেলাম। এখন পাড়ে ফিরব কিভাবে চিন্তায় পড়ে গেলাম। তখন আমাদের সিনিয়র দুজন সাহস যোগাতে চেষ্টা করতে লাগলেন। তারা ভেলা থেকে নেমে দুই হাত ভেলায় রেখে দুই পা দিয়ে ঝাপটে সাঁতার কেটে কেটে তীরে ফিরিয়ে অানতে চেষ্টায়রত। আর আমরা কাত হয়ে হাত দিয়ে বৈঠা মারতে থাকলাম। কিন্তু গতি খুবই ধীর ছিল ঢেউ প্রতিকূলে থাকায়। আর আমরা মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম পানির নীচের অদ্ভুদ প্রানীরা আক্রমন করে বসে কিনা! খুটিটা ওরাই নিয়ে গেল কিনা!

শৈশবে বন্ধুদের সংগে নদীতে সাঁতার কাটা

তখন সেই সময় নদীর ঘাটে গোসল করতে আসা কেউ একজন আমার বাড়িতে খবর দেয় মাঝ নদীতে আমরা আটকা পড়েছি তীরে অাসতে পারছিনা।  সাথে সাথে পাড়ায় রটে যায় এই খবর। মানুষজন একে একে খবর পেয়ে ছুটে আসে আমাদের দেখতে। নদীর পাড়ে  অনেক মানুষের ভীড় জমে যায়। আর আমাদেরকে নিয়ে একটা হৈচৈ কান্ড ঘটিয়ে ফেলে। একে তো সাতার জানিনা, তার উপর মানুষের হায়হুতাশ সব মিলিয়ে আমরা তখন আরও ভড়কে যাই। তখন আমাদের সিনিয়র দুইজন বকা খাওয়ার ভয়ে ভেলাকে তীরে ভেড়ানোর জন্য সব ভয় জয় করে ভেলার বিপরীত দিকে লাফ দিয়ে পানিতে পরে  ঢেউ তৈরী করে, আবার ভেলায় উঠে,  আবার লাফ দেয়, এভাবে কৃত্রিম  ঢেউ তৈরি করে  একটু একটু তীরের দিকে আগাতে থাকি।কিন্তু আমরা তখনও মাঝ নদী পার হয়নি। এভাবে দীর্ঘক্ষণ চেস্টা চললে হয়তো নিজেরাই তীরে পৌঁছে যেতাম। কিন্তু পাড়ের মানুষের চিৎকার চেঁছামেছিতে আমরাও অস্থির ও আতংকিত হয়ে গেলাম। সেই সঙ্গে ভেলার মালিকও বর্শি আর চিপ নিয়ে এসে হাজির, “আর চিৎকার করতে লাগল। কতবড় সাহস আমাকে না বলে চুরি করে  আমার ভেলা নিয়ে গেছিস! পাড়ে আয় , আজ তোদের খবর আছে!” এলাকার অন্য লোকেরা তাকে থামিয়ে শান্ত করেন।

নদীর মাঝখানে আটকা পড়া

যাইহোক, খবর পেয়ে তাৎক্ষনিক আমাদের বাড়ি থেকে আমার ছোট চাচা ও আমাদের বিস্কুট ফেক্টরীর শ্রমিকরা ছুটে আসেন আমাদের উদ্ধারের জন্য। তখন ফ্যাক্টরীর আঙুর ভাই, কবির কাকা ও এলাকার মঞ্জু কাকা সাঁতরে এসে আমাদের কচুরীপানার ভেলাকে তীরে নিয়ে যায় এবং  আমাদের উদ্ধার করে। আমরা তীরে এসে কোনরকম জান বাঁচিয়ে দিলাম একটা ভোঁ দৌঁড়।পিছনের হাজারো  বকাঝকা, তিরস্কার তখন কি আর আমরা শুনি!

কোনরকম জান বাঁচিয়ে দিলাম একটা ভোঁ দৌঁড়

আমরা চারজন ভয়ে আর বাড়ি ফিরিনা। এদিক সেদিক ঘুরতে লাগলাম আর পালাতে থাকলাম। আর আমাদের চার ফ্যামিলির লোকজন খোঁজে খোঁজে হয়রান। বিভিন্ন লোকজন মিলে আমাদের খুজে পেয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে যার যার বাড়িতে নিয়ে যায়। তার পরে কত যে বকুনী খেয়েছি তার সীমা নেই। আর নদীতে আসা,  পানিতে নামা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছুদিনের জন্য। অার মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম যত দ্রুত সম্ভব সাতার শিখব এবং কিছুদিনের মধ্যে সাঁতারও শিখে গেলাম।

সাতার শিখে নদীতে নামা শুরু করলাম। অল্প দূরে গিয়ে আবার ফিরে আসি। এভাবে অাস্তে সাহস বাড়তে লাগল। আজগুবি গল্পগুলোকে চেষ্টা করলাম ভুলে যেতে। কিন্তু মনে মনে একটা আতংক ছিল কখন জানি পানির নীচ থেকে পায়ে ধরে দেয় টান।  তাই বেশীরভাগ সময়ই উপরে ভেসে থাকতাম এবং পাগুলো যেন নীচের দিকে না যায় সেভাবে সাতার কাটতাম। এর পর থেকে দলবেঁধে নদীর মাঝখান থেকে সাঁতরে আসতাম। নদীর মাঝখানে ছিল একটা বাঁশ কুপে রাখা। একজন শিকারী বাশটি কুপেছিলেন কলাগাছের ভেলাকে সেই বাশে বেঁধে রেখে বর্শি দিয়ে মাছ ধরার জন্য। সেই বাঁশে গিয়ে ধরে থেকে বিশ্রাম নিতাম ও আবার তীরে ফিরে আসতাম। এভাবে সাঁতারে  আরও পারদর্শী হতে থাকলাম দিনে দিনে।

একদিন ১০-১২ জনের দল প্রস্তাব দিল চল আজকে নদী পার হয়ে ওপারের মসজীদ ঘাটে চলে যাই। আমি বললাম মাঝ নদীর কালো পানি ও মসজীদ ঘাটে যেতে আমার ভয় হয়। সবাই আমাকে সাহস যোগাল এবং সেদিন সত্যি সত্যি নদী পার হয়ে গেলাম।  কিন্তু মসজিদ ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছতে না পৌঁছতেই মনের সুপ্ত আতংক জেগে উঠে৷ এই বুঝি পায়ে ধরে দিল কেউ টান! অবশেষে ঘাটে উঠি বিশ্রাম নিতে থাকি। ফিরে আসার জন্য আর পানিতে নামতে সাহস হচ্ছিলনা। একে তো ক্লান্ত, তার উপরে মনের ভিতরের ভয় সব মিলিয়ে নদীটাকে বিশাল বড় মনে হচ্ছিল।  একজন বলল বেশী ভয় পেলে হেটে হেটে কলেজের বাশের সাঁকো দিয়ে নদীর ওপর পারে ফিরতে। কিন্তু চিন্তা করলাম সবাই আমাকে ভীতুর ডিম ভাববে। তাই সাহস করে সাতরেই নদীর অপর পারে ফেরার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু শর্ত দিলাম আমাকে ফেলে রেখে কেউ সাঁতরে যেতে পারবেনা। একসাথে সাতার কাটতে হবে সবাইকে। কয়েকজন থাকবে পিছনে ও কয়েকজন সামনে আর বাকিরা দুই পাশে। এই শর্তে এবং এভাবেই এপারে ফিরে এলাম। সেদিন নিজেকে মনে হয়েছিল সুপার ম্যান। আজ সাঁতারকেটে নদীর ওপার থেকে ঘুরে এসেছি। যারা তখনও ওপারে যাওয়ার সাহস করতে পারেনি, তাদের সামনে নিজেকে হিরো বলে জাহির করতে লাগলাম। এর পর থেকে প্রায় প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরেই দলবেঁধে  নদী পার হয়ে কাঁচারী মসজিদ ঘাটে গিয়ে উঠতাম। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আবার এপারে ফিরে আসতাম।

একদিন সবাই সাঁতরে মসজিদ ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছতেই ঐঘাটে গোসল করতে থাকা মুরুব্বীরা ধমকাতে লাগল ঘাটে না ভীড়তে। তখন আমরা বিশ্রাম ছাড়াই এ পারে ফিরে আসা শুরু করলাম।তখন অনেক কষ্ট হয়েছে কেননা বিশ্রাম নিতে পারি নাই। কিছুদূর এসে আর শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারছিলাম না। অবশেষে মরা ভেসে (চিৎ সাতার),  কাত হয়ে, চিত হয়ে,  উপুর হয়ে বিভিন্ন স্টাইলে অবশেষে তীরে ফিরলাম। আর মনে মনে বললাম আর নদী পার হবনা। কিন্তু পরদিন সব ক্স্ট বেমালুম  ভুলে গেলাম; আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এখন থেকে আমরা মসজীদ ঘাটে না উঠেই ঘাটের কাছে গিয়ে এক সাঁতারেই তীরে ফিরব। তাই করলাম এবং সফল হলাম। প্রথম প্রথম ক্লান্ত হয়ে গেলেও পরে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। তখন নদীর ওপার  যাওয়া আসা পান্তা ভাতের মতো হয়ে গিয়েছিল।

নরসুন্দা নদীর সাথে লাগানো ছোট্ট পুকুর(ছোট গাঙ) যেটি বর্তমানে লেকসিটি ও মুক্ত মঞ্চ নামে পরিচিত।ছবি: রেজুয়ান

আমাদের সাথে সাঁতারকাটা সেই প্রায় সমবয়সী বড়ভাই ও বন্ধুদের কথা ভীষণভাবে মনে পড়ে! যেমনঃ ঈদু কাকা, আজিজুল কাকা, জাহাঙ্গীর ভাই,আহাদুল্লা কাকা, মুন্না, খোকন, আবুকা, খায়রুল, তারেক, শফিক, তাজুল, প্রয়াত ওয়াসিম (মান্নান কাকার ছেলে) এবং আরও অনেকেই। বিশেষকরে বন্ধু ওয়াসিমকে খুবই মিস করি, যে অল্প বয়সে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে।

ওপারে ভাল থাকিস ভাই, ওয়াসিম।

লেখক: মোহাম্মদ আবুল বাশার রাজীব

Please Share This Post in Your Social Media

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ দেখুন..